![সবুজ রঙের আত্নীয়তা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/09/bibika-deb_125078.jpg)
বিবিকা দেব, ০৯ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : ঊষশীর মনটা হঠাৎ বিষণ্ন। কাগজ কলম নিয়ে চেয়ারে বসে আছে। কিছু লেখবে বলে। কিন্তু লেখতে পারছে না। উড়ো উড়ো মনটা কিছুতেই স্থির করতে পারছে না। চেয়ার থেকে উঠে পায়চারী করে। বাহিরে মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোটা জলের বৃত্ত তৈরী করে। কাগজ কলম বাদ দিয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করে। মনটা উদাস অনেক দূরে। মেঘেদের স্পর্শে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। স্থির চোখের দৃষ্টি। এমন এক আষাঢ়ী দিনে বাড়িতে নতুন একটা মুখের প্রতিচ্ছবি ভাসে । ঊষশী তখন ক্লাস ফোরে পড়ে । বড় বোনের বিয়ে অনেক ধুমধামে সম্পন্ন হয়। বছর ফিরতেই নতুন একটা মুখের পদার্পণ। ঊষশী দূরন্ত নয়! কিন্তু সহজ সরল। ক্লাসের অন্যান্য ছেলে মেয়েরা যেভাবে স্কুল জীবনটা হেসে খেলে পার করে। ঊষশী তা করেনি। সব সময় নির্জন গাছের ছায়ায় থাকতে ভালোবাসে।
একদিন মা বললো ঊষশী দোকানে যাও। কেরোসিন তেল আনতে হবে। ঊষশীর মুখে কোন উত্তর নেই। অনেক বৃষ্টি সাথে রেষারেষির মেঘের গর্জন। ঊষশী বৃষ্টি খুবই ভালোবাসে। কিন্তু বজ্রপাত ভীষণ ভয় পায়। ভেতরে ভেতরে ভয় পেতে থাকে। তবুও অগত্যা যেতে হলো। এক হাতে এটলাস ছাতা অন্য হাতে টাকা আর কেরোসিনের তেলের বোতল। দুরু দুরু বুকে রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে । হাঁটতে হাঁটতে বিশাল একটা বট গাছের নিচে দাঁড়ালো ছাতা সমেত। এমন সময় বিকট একটা বজ্রপাতের শব্দ হলো। ঊষশী প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে পরিচিত এক কাকার বাড়ী পৌঁছায়। কাঁদতে থাকে অনবরত। কাকীমা এসে জড়িয়ে ধরে। বৃষ্টি ও বজ্রপাত কমতে থাকে। ঊষশী কেরোসিন তেল কিনে বাড়ী ফিরে।
বেশ কয়েক মাস পরে বট গাছের ডালপালা শুকিয়ে যেতে থাকে। ঊষশী বুঝতে পারে বিধাতা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। না হয় সেদিন কোন না কোন বিপদ হতে পারতো। তেমনি একদিন স্কুল ছুটির পর অনেক বাতাস ও বৃষ্টি প্রবাহিত হয়। পাঠ্যবই ভিজবে বলে, নিজের গায়ের জামা খুলে বই জড়িয়ে দৌড়াতে থাকে। বাতাস যত জোরে বইতে থাকে, ঊষশী তত বইকে আগলে রাখে।
বর্ষার জলে নদী, খালবিল, পুকুর কানায় কানায় পূর্ণ হয়। তখন দেখতে খুবই ভালো লাগে। যেন যৌবনে পূর্ণবতী হয়েছে। শুরু হয় মাছের লাফালাফি আর ব্যাঙ–ব্যাঙানির দাপাদাপি। অন্য মৌসুমে ব্যাঙদের কম দেখা যায়। কিন্তু ভরা বর্ষায় কুনোব্যাঙ, সোনাব্যাঙ, গেছো ব্যাঙের দেখা মিলে। তাদের সৃষ্ট অনবদ্য ছন্দ, সন্ধ্যার আঁধারে ঝিঁ ঝিঁ পোকার অবিরাম সুর। বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। থেমে থেমে দমকা শীতল বাতাস। বিজলীর এক ঝলক আলোয় পুলকিত পৃথিবী।
বৃষ্টির দিনে স্কুলে যাওয়ার পথে পা পিছলে চিৎপঠাং। তখন বৃষ্টির উপর খুব অভিমান হতো। কিন্তু যখন মুষল ধারে একটানা বৃষ্টি হতে দেখে তখন খুব ভালো লাগে। সমস্ত কষ্টের রাগ অভিমান বৃষ্টির জলের সাথে মিশে নদীতে প্রবাহিত হয়। মনটা একদম শান্ত স্থির হয়ে যায়। বৃষ্টির সাথে সাথে বাতাসে গন্ধরাজ। কদম ফুলের সুভাস বয়ে আনে। সেই বৃষ্টিতে হালদা নদীর দুকূল ছাপিয়ে বন্যায় রুপান্তর হয়। রাস্তা ভেঙে নদীর পানিতে ডুবে যায়। আশে পাশের কয়েকটি গ্রাম। স্কুল কলেজ হাট বাজার বন্ধ হয়ে যায়।
বিপাকে পড়ল গ্রামবাসী। যোগাযোগ বিছিন্ন। নৌকা দিয়ে কোন রকম ব্যবস্থা করে নেয়। যাবতীয় যাতায়াত সবকিছু নৌকার মাধ্যমে। নদীর পানি আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। গরু বাছুর ছাগল মরে পেট ফুলে ভেসে চরে আটকে আছে। চারদিকে পঁচে দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠে। তহুরার ছাগলটার কপালে একই মরণ জুটল। পোষ্যপ্রাণীকে তহুরা বড় ভালোবাসে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে! মানুষের বাড়ী বাড়ী কাজ করে। বিনিময়ে বাসি ভাত, তরকারি জোটে। ছাগলটা বর্গা নিয়ে লালন পালন করে। তিন মাসের পেট নিয়ে পানির প্রচণ্ড স্রোতে ভেসে গিয়ে মরে ফুলে উঠেছে। ভেবে ছিল, বাচ্চা হলে বড় করে কয়টা টাকার মুখ দেখবে। অতি আশার কোন ফল হলো না!
যুদ্ধ চলাকালিন তহুরা বারো বছরের চঞ্চল কিশোরী। বাবা ছিলেন মুক্তিফৌজ। সমগ্র পূর্ব বাংলা আগুনে জ্বলছে। তহুরার বাবাকে না পেয়ে ঘর–বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়! তহুরা আর ছোট ভাই খোকাকে নিয়ে মা রাতের অন্ধকারে নদীর ওপারে লুকিয়ে থাকে। ভোর হতে–ই গ্রামে ফিরে আসে। তহুরার মা হাঁস মুরগি পালতেন। হাঁস মুরগির ডিম বিক্রি করে তহুরা আর খোকার লেখাপাড়ার খরচ জোগাড় করতেন।
একদিন বদল রাজাকার দুজন লোক নিয়ে কচি মুরগি কিনতে আসে। উঠানে দাঁড়িয়ে তহুরার মাকে তালাশ করে। তহুরা বলে মা’তো নেই। মা জমি থেকে শাক আনতে গেছে। বদল রাজাকার ও দুই সিপাহীর চোখ লালসার কামনায় ভরে উঠে। বদল রাজাকারের ইশারায় কিশোরী তহুরাকে টেনে হিচড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়! তহুরার বুক ফাটা আর্তনাদ হাওয়ায় মিশে যায়। দুচোখ বেয়ে শুধু নোনা জল গড়িয়ে পড়ে অবিরাম। একজনের পর একজন তহুরার ক্ষত বিক্ষত শরীরের উপর হামলে পড়ে।
জ্ঞানহীন অবস্থায় একদিন একরাত কেটে যায়। পরের দিন সকালে তহুরার জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ খোলতে পারে না। চোখের পাতা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। খুব জ্বলছে চোখ দুইটা। নিজেকে শোয়া দেখে তহুরা ভাবলো, মা শাক আনতে গেছে। শুয়ে আছি দেখলে মা বকাবকি করবে। তহুরা উঠতে গিয়ে উঠতে পারে না। প্রচণ্ড ব্যথায় শরীরটা ককিয়ে উঠে। পেছনটা রক্তে ভিজে গেছে। জমাট বেঁধে কালছিটে দাগ পড়েছে। নিজের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে শিউরে উঠে। কান্নায় হালদার মিঠা পানিও লোনা হয়ে উঠে। দীর্ঘদিন ক্যাম্পে বন্দি ছিল। ঘোরের মধ্যে কেটেছে রাত দিন।
দেশ স্বাধীন হলো। দেশ শক্রমুক্ত হলো। কিন্তু তহুরার শরীর কলঙ্ক মুক্ত হলো না। যত দিন পার হচ্ছে, তাহুরার পেটটা উপর দিকে ফুলে উঠছে। বাড়ীতে মা ঠাঁই দেয় না। বাবাও লাল সবুজের বিজয় পতাকা কাঁধে নিয়ে গ্রামে ফিরেছে। কিন্তু নিশ্চুপ। গ্রামবাসীর কাছে তহুরা নষ্টা মেয়ে মানুষ। প্রসব যন্ত্রণায় তহুরা যখন ছটপট করতে থাকে। আঁকড়ে ধরে বারান্দায় বাঁশের খুঁটি। প্রবল রক্তের স্রোতে পেটে ফুড়ে মানুষ নামের শুয়ো পোকা জন্ম হলো! শুয়ো পোকার অস্তিত্বে তহুরার রাগ, ঘৃণা প্রচণ্ড ভাবে জমে আছে। শুয়ো পোকার আর্তচিৎকার ও নড়ে উঠার আগে ছেড়া কাঁথায় মুড়িয়ে হালদার জলে বিসর্জন দিয়েছে।
পা টলছে কিন্তু হাঁটতে পারছে না। শুয়ো পোকার শরীরটা এতদিন খুব ভারী হয়ে ছিল। এখন শরীরটা তুলার চেয়েও হালকা লাগছে। হালদার জোয়ার ভাটায় পাপী শুয়ো পোকার স্থান হয়নি। কচুরি ফেনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। দুপুর গড়াতে শুয়ো পোকার চারপাশে মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে। গ্রামবাসী সবাই জানে নষ্টা তহুরার পাপের ফসল। এর মধ্যে তহুরার বাবা এসে শুয়ো পোকা ও ছেঁড়া কাঁথা সমেত হালদার পাড়ে নরোম মাটি দিয়ে কবর দেয়। সেদিনের পর থেকে তহুরার নদীর পাড়ে বসবাস শুরু হয়। ছনের ছাউনিতে এক চালা কুঁড়ে ঘর। কোন রকম রাতটুকু পার করে। দিনের বেলায় এবাড়ী থেকে ও বাড়ী ঘুরে ঘুরে কাজ করে। বিনিময়ে একমুঠো ভাত ও পুরানো পরনের কাপড় জোটে।
রাতের আঁধারে মানুষ রুপী খটাশের আনাগোনা বেশ স্পষ্ট। সুযোগ বুঝে ছোবল মারার অপেক্ষায় থাকে। তহুরা নিজেকে রক্ষা করার জন্য সাথে একটা ধারালো দা রাখে। বাড়াবাড়ি দেখলে ঘাড়ের উপর কোপ বসাবে।
অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। তহুরার বয়স বেড়েছে। কালো চুলের সাথে শাদা রঙের আত্মীয়তা হয়েছে। গ্রামের চেয়ারম্যানের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধার লিষ্টে নাম উঠে ছিল। পেয়ে ছিল সরকারি ভাতা। স্বীকৃতি পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধার। কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে নষ্টা বীরঙ্গনা হিসেবে পরিচিত। ঊষশীর কাছে তহুরা নারী মুক্তি যোদ্ধা। সে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে। তাদের সহযোদ্ধা এ নারীরা।
ঊষশীর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বাবাকে বলে কিছু টাকা ব্যবস্থা করবে। গ্রামের বেকার মহিলাদের নিয়ে আত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জন্য। সেলাই থেকে শুরু করে বাটিকের কাজ ও কুটির শিল্প গড়ে তুলবে। হস্ত শিল্পের সব ধরনের কাজের চাহিদা থাকবে। তহুরা থাকবে দেখা শুনার দায়িত্বে। যাতে কোন মানসিক চাপ না পড়ে। ঊষশীর ভাবতে ভালো লাগে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে সে কাজ করবে।
যোদ্ধার কথা ভাবতেই শরীরের সমস্ত লোম শিউরে উঠে। চোখের মানসপটে নিজেকে যোদ্ধা বলে মনে হয়। তহুরার মতো আরো অনেক যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে কাজ করবে। যাতে থাকবে না কোন বৈষম্য ভেদাভেদ। দীর্ঘ নিঃশ্বাস বুক থেকে বেরিয়ে যায়। ঊষশী দ্রুত গতিতে এগোয়। লক্ষ্যে স্থির। আকাশে মেঘবালিকার কানাকানিতে হয়তো আবারো বৃষ্টি নামবে। সকল জীর্ণতা মুছে যাবে। গড়বে দেশ নতুন উদ্যোমে।
(সংগৃহীত)