![আসামের ভাষিক-জাতি সঙ্কটের সেকাল-একাল](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/10/mojharul_125215.jpg)
মযহারুল ইসলাম বাবলা, ১০ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : আসামে বসবাসকারী অধিবাসীরা প্রধানত দুই পৃথক অঞ্চলে শতাব্দীর অধিককাল ধরে বসবাস করে আসছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমীয়রা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ, পাশাপাশি বাঙালিও সেখানে রয়েছে লক্ষাধিক। অপরদিকে বরাক উপত্যকা জুড়ে রয়েছে কেবল বাংলাভাষী বাঙালিরা। তবে কিছু মণিপুরিও সেখানে আছে। ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক উপত্যকায় অসমীয়া এবং বাঙালি দুই জাতির প্রাধান্যে অসমীয়াদের বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব বহুপূর্ব থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল। আসাম অসমীয়দের একক অঞ্চল অতীতেও ছিল না। আজও নয়। আসামের বাঙালিরা কংগ্রেস দলের সমর্থকরূপে কংগ্রেসের ছায়াতলে ছিল। কংগ্রেসও আসামের ভোটব্যাংক বাঙালিদের পাশে থাকলেও রাজনৈতিক স্বার্থে অসমীয়া জাত্যভিমানকে রাজনৈতিক স্বার্থে পক্ষে পেতে ইতিহাস খ্যাত মারাত্মক অন্যায়টি করে ১৯৬১ সালে; বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের সশস্ত্র পন্থায় দমন করে। আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ১১ জন বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস ভুল বুঝতে পেরে দ্রুত নিজেদের শুধরে নিলেও আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনে ১১জন আত্মদানকারীর স্মৃতি বাঙালিদের মানস এবং ভারতের ভাষাভিত্তিক সংগ্রামের ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি। আজও ওই দিনটিকে বাংলাভাষীরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। আসামের রাজনীতিতে অসমীয়দের ভাষিক ও সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধনে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি কংগ্রেসকে হটিয়ে আসামের ক্ষমতা লাভ করে। ক্ষমতা গ্রহণের পর অসমীয়া এবং বাংলাভাষীদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের ফায়দা হাসিলে তৎপর হয়ে সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত চালিয়েছে। অসমীয়দের বিদেশী হটাও আন্দোলনে হিন্দু বাঙালিদের সুবিধায় রেখে বাংলাভাষী মুসলমান বিদ্বেষী করে তুলেছে। অর্থাৎ ভাষিক সংঘাতকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত করে আসামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তুলেছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ভোটের রাজনীতিতে বাংলাভাষী হিন্দুদের পাশে রেখে বাংলাভাষী মুসলমানদের অধিকার হরণের আয়োজন সম্পন্ন করে জাতিগত সমস্যাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত করার ষড়যন্ত্র করে চলেছে।
রাজ্যের ক্ষমতাসীন বিজেপি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে আইন করে দুই সন্তানের অধিক পিতা–মাতাদের স্থানীয় স্বশাসিত পর্ষদের ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার বঞ্চিত করেছে। দু’য়ের অধিক সন্তানের পিতা–মাতারা ব্রাত্যরূপে পরিগণিত হয়েছে। এতে সবচেয়ে বিপদের মুখে পড়েছে বাংলাভাষী মুসলিম সম্প্রদায়। কেননা তাদের প্রত্যেকের সংসারে দু’য়ের অধিক সন্তান থাকায় তারা শিক্ষা, চাকরি, পদোন্নতিসহ বিবিধ অধিকার–সুযোগ হারিয়েছে। রাজ্যের নাগরিকত্ব প্রদানে বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে নাগরিকত্ব হরণের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। মুসলিম বাঙালিদের নাগরিকত্ব প্রদান না করে তাদের বিতাড়ণের আয়োজনও সমান তালে চলছে। ইতিমধ্যে তাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। অতীতের ভাষিক সংঘাতকে বিজেপি এখন সাম্প্রদায়িক বিভাজনে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে চলেছে। এতে আসামে বাঙালি খেদাও–মুসলমান বাঙালি খেদাও আন্দোলনে পরিণত হতে চলেছে।
ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসাম ছিল স্বতন্ত্র এক প্রদেশ। বাংলাদেশের সিলেট জেলা ছিল আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গে পূর্ববাংলা এবং স্বতন্ত্র আসামকে একীভূত করে ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল’ নামক পৃথক প্রদেশ সৃষ্টি করেছিল, রাজনৈতিক অভিপ্রায়ে। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বঙ্গভঙ্গ রদ হবার ফলে আসাম পুনরায় পূর্বাবস্থায় স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হয়। অখণ্ড বাংলা প্রদেশ থেকে বিহার, ওড়িষ্যা এবং ছোট নাগপুরকে বিচ্যুত করে বাংলা প্রদেশকে সঙ্কুচিত করা হয়। এমন কি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় দিল্লিতে। বাংলা প্রদেশের ওপর ব্রিটিশদের বিদ্বেষের মূলে ছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি সচেতন বাঙালি জাতির অগ্রসর চেতনা। যেটি ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়াতে সক্ষম বিবেচনায় লর্ড কার্জন বাংলা ভাগের গর্হিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগে আমাদের সিলেট জেলার বৃহৎ অংশ আসাম প্রদেশের অনুকূলে থেকে যায়। সেখানকার সকল মানুষের ভাষাই ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানের ভূখণ্ড বৃদ্ধিতে দেশভাগে পাকিস্তানি নেতারা পূর্ব বাংলাকে সঙ্কুচিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। যে কারণে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বহরমপুরসহ খোদ যশোর রোড ধরে কলকাতা পূর্ববঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি। অর্থাৎ পূর্ববাংলাকে দুর্বল অংশে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত দেশভাগে সম্পন্ন করেছিল অবাঙালি পাকিস্তানিরা। আজকে আসামে যাদের বহিরাগত বাঙালি বলা হচ্ছে, বৃহত্তর সিলেট খণ্ডনে তারা তো বংশ পরম্পরায় নিজ মাতৃভূমিতেই রয়েছে। কেবল ভাষা ও জাতীয়তার বিদ্বেষে তাদের মেনে নিতে পারছে না অসমীয়রা। আর এই জাতি বিদ্বেষকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ রূপান্তরে বিষ সিঞ্চন করে চলেছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি।
ভারতবর্ষে অসমীয়রা পৃথক ভাষা–সংস্কৃতির স্বতন্ত্র জাতি। তাদের ভাষা–বর্ণমালাও স্বতন্ত্র। অতীতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা মৌর্য, গুপ্ত, মুসলিম শাসনাধীনে কখনো ছিল না। ১৮২৬ সালের পূর্বে ব্রিটিশরাও আসামে প্রবেশ করতে পারেনি। ১৮২৬ সালে কাছাড়ের দিক দিয়ে বর্মী–মগদের আগ্রাসনের মুখে অহোম রাজ্য উদ্ধারে অসমীয়দের আমন্ত্রণে ইংরেজরা আসামে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল। বর্মী–মগদের বিতাড়নে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় সহজে আসাম ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে আসে। ১৮৩২ সালে পূর্বেকার অহোম রাজ্যের রাজসিংহাসনে ব্রিটিশরা অধিষ্ঠিত করে রাজবংশের এক প্রতিনিধিকে। কিন্তু এর মাত্র চারবছর অতিক্রান্তে ইংরেজ শাসকেরা রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করে আসাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে কব্জা করে নেয়। অহোম রাজ্যের একমাত্র ভাষা ছিল অসমীয়া। সে ভাষায় সাহিত্য–সংস্কৃতির ছিল উন্নত পরিমণ্ডল। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য–ইতিহাস ছিল। ভারতবর্ষের মৌর্য, গুপ্ত, মুসলিম, ব্রিটিশ শাসনের যুগের সঙ্গে যার কোনো সদৃশ ছিল না। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ১৮৩৬ সালের পূর্বে অসমীয়া ভাষায় তাদের ইতিহাস রচিত হয়েছিল। কিন্তু ১৮৩৬ সালেই ব্রিটিশ কর্তৃক অসমীয়া ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করে। শিক্ষাঙ্গনে, আদালতে সর্বত্রে অসমীয়া ভাষা পরিত্যক্ত হয়ে বাংলা ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করে। এই কাজে ব্রিটিশদের ইন্ধন জুগিয়েছিল ব্রিটিশরাজের অধীন বাঙালি রাজকর্মকর্তা–কর্মচারীরা। ব্রিটিশদের বোঝানো হয়েছিল অসমীয়া ভাষা বাংলা ভাষারই একটি উপভাষা। অসমীয়া কোনো স্বতন্ত্র ভাষা নয়।
বাঙালি রাজকর্মকর্তা–কর্মচারীদের পরামর্শেই ব্রিটিশরা অসমীয়া ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষাকে সরকারি একমাত্র ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৮১৭ সালে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারী কর্তৃপ অসমীয়া ভাষায় অনূদিত বাইবেল বাংলা ভাষায় প্রকাশ করে। এতে প্রমাণ করাও সহজ হয় বাংলা বর্ণমালাই অসমীয়া বর্ণমালা। একমাত্র ‘র’ ব্যতীত অসমীয়া বর্ণমালায় আর কোনো পৃথক বৈশিষ্ট্য নেই। অসমীয়া ভাষা বাংলা ভাষার উপভাষার অমর্যাদায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ওড়িষ্যাতেও বাঙালি রাজ–কর্মচারীরা উড়িয়া ভাষার ক্ষেত্রে একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। ওড়িষ্যায় বসবাসকারী সচেতন বাঙালিদের হস্তক্ষেপে ওড়িয়া ভাষা জীবন ফিরে পেয়েছিল।
আসামে অসমীয়া ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা হারানোর পর সঙ্গত কারণে অসমীয়রা প্রবল বাংলাভাষা ও বাঙালি বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। ব্রিটিশদের আসাম রাজ্য দখলদারিত্বে অসমীয়রা একাধারে পরাজিত হলো ইংরেজদের দ্বারা, বাঙালিদের দ্বারাও। অসমীয়া ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকান মিশনারীরা দীর্ঘকাল আন্দোলন করে। অসমীয়া ভাষায় অসংখ্য গ্রন্থ লিখে ও প্রকাশ করে তারা প্রমাণ করে যে অসমীয়া একটি পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র ভাষা। বাংলা ভাষার উপভাষা নয়। কলকাতার হিন্দু কলেজ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন এই ভাষা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবশেষে ব্রিটিশ শাসকেরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অসমীয় অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে অসমীয়া ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদান করে। তবে সামান্য হের–ফেরে প্রবর্তিত অসমীয়া ভাষার বর্ণমালা বাংলাই থেকে যায়। ভাষা এবং বর্ণমালার ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপে অসমীয়মাত্রই বাঙালি বিদ্বেষী হয়ে পড়ে। অসমীয় জাতিসত্তার ওপর এমন হস্তক্ষেপ অন্যায় বলেই গণ্য করা যায়।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা তুর্কি–মোগলদের অধীনে কখনো ছিল না। পশ্চিমের সমস্ত আগ্রাসন প্রবল ভাবে তারা প্রতিহত করেছিল। গৌড়বিজেতা মহম্মদ বিন বখতিয়ারকে পর্যন্ত তারা প্রতিহত করেছিল। হটিয়ে দিয়েছিল মীর জুমলাকেও। একমাত্র আগ্রাসী বর্মী–মগদের প্রতিহত করতেই ব্রিটিশদের পক্ষে আসামের দখলদারিত্বের পথ সুগম হয়। পরিণাম যে শুভ হয়নি, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে ব্রিটিশরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা দখলে বার বার পরাস্ত হয়েছিল। একমাত্র আগ্রাসী বর্মী–মগদের আগ্রাসন ঠেকাতে তাদের আসাম বিজয় সম্ভব হয়েছিল।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পশ্চিমাঞ্চল কামরূপ কেন্দ্রানুগ না হয়েও বাংলা প্রদেশের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিল। কোচবিহারকেও কামরূপ বলা হতো। অসমীয়া ভাষার কবি–সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষক ছিল কোচ নৃপতি। বার্মার শান রাজ্য থেকে পাহাড়–পর্বত, নদী–নালা ডিঙিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রবেশ করেছিল অহোমদের আদি জাতি। এরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল না। ছিল প্রবল হিন্দুবিরোধী। বংশ পরম্পরায় এদের চিন্তা–চেতনা, নীতি–নৈতিকতার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এরা ক্রমেই হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে এবং নিজেদের স্থানীয় আদিবাসী রূপে ভাবতে শেখে। তিন–চারশত বছরের ব্যবধানে এরা পার্শ্ববর্তী ভারতীয় লোকাচার–সংস্কৃতি অনুসরণ করে স্বতন্ত্র ভাষা–সংস্কৃতির আচার গড়ে তোলে।
আসামের বাঙালি বিদ্বেষী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬০ সালে। শিলং–এ অসমীয়া ভাষা রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষার ঘোষণার পরমুহূর্তে পার্বত্য জাতিসত্তার মানুষেরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তবে বাঙালিরা অসমীয়া ভাষার পাশাপাশি বাংলাভাষাকে সরকারি ভাষার সমমর্যাদার দাবি তোলে। অসমীয় প্রচার মাধ্যমগুলো বাঙালিদের প্রকৃত দাবিকে আড়াল করে অসমীয়া ভাষার প্রতি বাঙালিদের অশ্রদ্ধার মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে। এতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ প্রকাশে বাঙালিবিরোধী সহিংস হয়ে ওঠে অসমীয়রা। বিক্ষোভকারী পার্বত্য খাসী জাতিসত্তার কাউকে নাগালে না পেয়ে তাদের সহিংস লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বসবাসকারী বাঙালিরা। অথচ ব্রহ্মপুত্র ও কাছাড়ের বাসিন্দারা অসমীয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষার ঘোষণায় নিশ্চুপ ছিল। অথচ তাদেরকেই সহিংসতার শিকার হতে হয়েছিল।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই অসম রাজ্যে অসমীয়দের প্রাধান্য থাকবে। বিশেষ করে যে সকল অঞ্চলে তাদের সর্বাধিক বসবাস। সে সকল অঞ্চলে তাদের ভাষার অবাধ প্রচলন থাকবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বরাক উপত্যকায় সুদীর্ঘকালের বসবাসকারী বাংলাভাষীদের ওপর জোরপূর্বক অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেয়া, তাদের উচ্ছেদ–উৎপীড়ন করাকে সমর্থন করা যায় না। অসমীয়দের ভয় দুই বাংলার জনসংখ্যার প্রভাবে তাদের না–সংখ্যালঘুতে পরিণত হতে হয়! এতে আসাম রাজ্যটি হয়ে পড়বে বাংলার উপনিবেশ। তাদের দশা ত্রিপুরা ও কাছাড়ের আদিবাসীদের অনুরূপ হয় কি–না এই আতঙ্ক অসমীয়দের মধ্যে আজও ক্রিয়াশীল। মেঘালয়ের ন্যায় কাছাড়কেও আসাম রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করাকে তারা বোধকরি সানন্দে গ্রহণ করবে। পলাশীর যুদ্ধের পর একমাত্র গোয়ালপাড়া ইংরেজরা দখল করলে ইংরেজদের সঙ্গে অসমীয়দের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গোয়ালপাড়া বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও আসাম রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত। অথচ গোয়ালপাড়া অখণ্ড বাংলারই অংশরূপে সুদীর্ঘকাল বাঙালি অধ্যুষিত। ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে সুরমা ও বরাক উপত্যকাসহ আসাম রাজ্যে বাঙালিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। অসমীয়দের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় ১৯৪৭–এর স্বাধীনতা এবং অপরিণামদর্শী দেশভাগে। তখন থেকেই অসমীয়দের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। ইংরেজ বিদায় নেয়ায় দেশভাগে আসামে বাঙালিরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। অসমীয়দের সকল অপ্রাপ্তির দুয়ার উন্মোচিত হয় অনাবিল প্রাপ্তিতে। রাজ্য সরকার, বিধানসভা, প্রশাসন, আদালত, শিক্ষাঙ্গন সর্বত্রে অসমীয়দের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালিরা তাদের অধিকার–মর্যাদা পুনরুদ্ধারে অসমীয়দের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। অসমীয়রা ইংরেজদের ন্যায় বাঙালি বিতাড়নেও সক্রিয় হয়ে ওঠে। যার ধারাবাহিকতা আজও চলমান।
নিজ ভাষার দাবিতে যে অসমীয়রা আন্দোলন–সংগ্রাম করেছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগে তারাই বাংলাভাষী এবং পার্বত্য জাতিদের ভাষা–সংস্কৃতি হরণে তৎপর হয়ে ওঠে। আসাম রাজ্যের কাছাড়, মিকির, বোড়ো অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষার অধিকার অসমীয়রা স্বাধীনতার (১৯৪৭) পর হতে এ যাবৎ স্বীকার করতে নারাজ। স্বাধীনতার পর আসাম রাজ্যের অঙ্গচ্ছেদ ঘটে। নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয় প্রভৃতি রাজ্য সৃষ্টি করা হয় ভাষা সমস্যার অজুহাতে। ভারতের শাসকশ্রেণি ভাষা সমস্যার বিষয়টি সামনে আনলেও নেপথ্যে যে ভিন্ন অভিসন্ধি ছিল–না তা কিন্তু নয়। যে অসমীয়রা নিজেদের রাজ্যের নিরঙ্কুশ অধিকারে অপর জাতিসত্তাদের অনুপ্রবেশকারী বলছে, তাদের পূর্ব–পুরুষেরা দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তিব্বত, মায়ানমার থেকে এসে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বসতি স্থাপন করেছিল। তারা প্রকৃতই ছিল না যেমন আসামের তেমনি তাদের ভাষাও ছিল না অসমীয়া। ইংরেজ শাসনাধীনে উত্তর ও পূর্ব অঞ্চল সুরক্ষিত হলে, দক্ষিণ অঞ্চল বাংলাভাষী এবং উত্তর–পূর্ব অঞ্চল নেপালীভাষী ও হিন্দিভাষী রাজস্থানীরা বসতি গড়ে তোলে। অগ্রসর বাংলাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মাতৃভাষার শিক্ষা–প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হলেও নেপালীভাষী ও হিন্দিভাষী রাজস্থানীরা ভাষার প্রশ্নে অসমীয়া ভাষা–সংস্কৃতি নীরবে মেনে নেয়। সে কারণে তাদের প্রতি অসমীয়দের বিরাগ নেই। রাজনৈতিক চিন্তা–চেতনায় অগ্রসর বাঙালিরা অসমীয়া ভাষার কর্তৃত্ব স্বীকার না করে অসমীয়দের প্রতিপক্ষ বহুকাল–বহুযুগের।
আসামে বাঙালি খেদাও আন্দোলনে বিদেশী অনুপ্রবেশকারী দাবি তুলে বাঙালিদের জনগণনা বা নির্বাচনে ভোটের অধিকার হরণের জোর চেষ্টা চলছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অনুপ্রবেশকারী ঠেকানোর দাবিও তুলেছে। এতে ভারতের শাসকশ্রেণির সহানুভূতি অসমীয়রা পেয়েছে। বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এই জাতিগত বিভাজনকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের হাতিয়ারে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কংগ্রেসের পরাজয় ও বিজেপির উত্থানের মূলেই ছিল হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা। বিজেপি বাঙালি হিন্দুদের প্রশ্নে ছাড় দিতে আপত্তি না তুললেও বাঙালি মুসলমানদের বিতাড়নে অসমীয়দের ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। পুনরায় রাজ্যের ক্ষমতা লাভে মরিয়া বিজেপি তুরুপের তাস রূপে মুসলিম বাঙালি বিদ্বেষী আওয়াজ তুলে তাদের বিতাড়নে অসমীয়দের ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে।
ভাষা ও সম্প্রদায়গত সংমিশ্রণে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে দাঙ্গা–সংঘাত সংঘটিত হয়েছিল। অসংখ্য বসতবাড়ি অগ্নিসংযোগসহ সহিংস সেই দাঙ্গায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯৮৩ সালের নির্বাচনের চারবছর পূর্বেই আসামের বহিরাগতদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের ভোটাধিকার বঞ্চিত ও বহিস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয় অসু (অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন) এবং আপসপ (অল অসম গণসংগ্রাম পরিষদ)। আসামের ভাষা সংঘাতের সমাধানে অন্নদাশঙ্কর রায় ‘অ’মোর চিকুনি দেশ গ্রন্থে লিখেছেন, “আসামকে অবিভক্ত রেখে সেখানকার মাইনরিটির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে এমন এক মীমাংসাসূত্র আবিষ্কার করতে হবে যেটা আসামের বাইরেও প্রয়োজ্য। আসাম এ বিষয়ে সৃষ্টিছাড়া নয়। অন্যত্র একই সমস্যা। কোথাও কম, কোথাও বেশি। অসমীয়া ভাষাগোষ্ঠীকে মেজরিটি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মেজরিটি মানে টোটালিটি নয়।”
আসামের অর্থনীতিতে অবদান রাখা বাঙালিদের প্রশ্নে আসামের উগ্রবাদী উলফা তাদের একটি দলিলে স্বীকার করেছেণ্ড “বহিরাগতরা কঠোর পরিশ্রমী ও আসামের উৎপাদনক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা আছে এবং তাঁরা আসামের জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।” (টাইমস অব ইন্ডিয়া ২৯ জুলাই ১৯৯২)
জাতিসত্তার প্রধান উপাদান ভাষা। আর এই ভাষাকে কেন্দ্র করে আসামে ভাষার সংঘাত দীর্ঘ মেয়াদে ঘটে এসেছে। রাজ্যের শাসক দল বিজেপি জাতিগত সমস্যাকে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টিকে আদা–জল খেয়ে নেমেছে। আসামের ঐক্যবদ্ধ হিন্দু–মুসলিম বাঙালিদের বিভাজিত করার চক্রান্ত করে চলেছে ধর্মের বিভাজনে। জাতিগত সংঘাত সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশে। আসামের বাঙালিরা যদি সেটা উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হয় তবেই বিজেপির হিন্দুত্ববাদী তৎপরতা বন্ধ হবে। নচেৎ ভাষিক সমস্যাকে আড়াল করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আসাম উত্তপ্ত হলে সাংবিধানিক ধর্মনিরপে ভারতের সাংবিধানিক অস্তিত্ব বিলীন হতে খুব বেশি সময় নেবে না।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
(সংগৃহীত)