![ভিআইপি লেইন প্রস্তাবনা গরিবের ঘোড়া রোগ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/11/bikash-ch_125484.jpg)
বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, ১১ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : গরিবের ঘোড়া রোগ বলে একটা প্রবাদ আছে। বাংলাদেশ গরীব দেশ এ কথা এখন আর বলা যাবে না। ধনী দেশ তাও না। বলা হয় মধ্যম আয়ের দেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম কিছুদিন আগে তার ২০১৮ ইনক্লুসিভ উন্নয়ন ইনডেক্স রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪–এ বলে উল্লেখ করেছে। তথ্যটি যে সুখকর তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশকে যে ’বটমলেস বাস্কেট’ বা তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অবজ্ঞা করা হতো সেই পরিস্থিতি থেকে আমরা অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছি। দেশের উন্নয়নের ধারা অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে যা প্রতিবেশী অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে, এমন কী কোন কোন দেশের কাছে উন্নয়নের এই ধারা ঈর্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও উন্নয়নের সূচক উর্দ্ধমুখী বলে আমরা যতই আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করি না কেন, সাধারণ জনগণের দিকে তাকালে টের পাই আমাদের এই দাবী কতটা ঠুনকো। দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, ফ্লাইওভার হয়েছে, আকাশ ছোঁয়া ভবন হয়েছে, বিল্ডিং গড়ে উঠেছে, দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে এখনো লাখো লাখো মানুষ অর্ধহারে দিন কাটায়, তাদের থাকার আশ্রয় রাস্তায়, ফুটপাতে, পার্কে গাছের নীচে, বেঞ্চের উপর, রেল বাস স্টেশনের বারান্দায়, সরকারী ফ্লাটগুলির সিঁড়ির গোড়ায় কিংবা অবাসযোগ্য বস্তীতে। নতুন কোন কাজের সংস্থান হচ্ছে না, শিক্ষিত–অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উর্দ্ধমুখী। সরকারী অফিসে দশটি পিয়নের পদের জন্যে হাজারো গ্রাজুয়েশনধারী প্র্রার্থী হুমড়ি খেয়ে পড়ে চাকরীর আশায়। সীমিত সংখ্যক হাতেগোনা অর্থবানদের সোজা বা বাঁকা পথের আয় ধরে যদি গোটা দেশের জনগণের আয়ের পরিমাপ করা হয় এবং সেই অংকের পরিমান গড়ের হিসাবে ফেলে আমরা যদি আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করি, তাহলে যে তা কেবল নিজেকে ফাঁকি দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
দেশের যখন এই দশা তখন শুনি ভিআইপি রোডের কথা। ভিআইপিদের জন্যে বিমান বন্দরে পৃথক ব্যবস্থা আছে, আছে নানা অনুষ্ঠানে, খেলার মাঠে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠাগুলিতেও দেখা যায়, কিন্তু ভিআইপিদের জন্যে পৃথক সড়ক সেটি আর কোন দেশে আছে কিনা আমার এই স্বল্প জ্ঞানে জানা নেই। কাজে এবং বেড়াতে অনেক দেশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশে গাড়ী পথে ঘুরে বেড়ানোরও সুযোগ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তির উর্বরমস্তিষ্কে উদ্ভাবিত এই ’ভিআইপি লেইন’ ইউরোপের কোন উন্নত দেশে, এমন কী এশিয়ার যে সমস্ত দেশে গেছি সেখানেও চোখে পড়েনি। প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কাতেও না। কিন্তু বাংলাদেশে এই ভিআইপি লেইন চাই এবং তার প্রস্তাবনা এসেছে খোদ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছ থেকে। প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কাছে। কারণ হিসাবে তারা উল্লেখ করেছেন, দেশের ভিআইপি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জরুরি সেবার যানবাহন চলাচলে রাজধানীতে ভীষণ সমস্যা দেখা দেয়। আর সে কারণে আলাদা লেইন নিতান্ত জরুরি। এই সংবাদ প্রকাশ পাবার সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়া সহ বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই প্রস্তাবকে ’অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক’ আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানানোর পাশাপাশি প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। কারণ হিসাবে টিআইবি বলে, “এই ধরনের প্রস্তাব সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, বৈষম্যমূলক ও ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহারের শামিল। এ প্রস্তাব সংবিধানে বর্ণিত সুযোগের সমতা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং ধর্ম, গোষ্ঠী প্রভৃতি কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্য প্রদর্শন না করার মহান নীতিগুলোর লঙ্ঘন।’’ সংস্থাটি আরো উল্লেখ করে, ‘আলাদা লেইন করে ভিআইপি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহ কোনো বিশেষ মহলকে অসাংবিধানিক ও অনৈতিক সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য আত্মঘাতীমূলক। সরকার এ ধরনের অনিয়মকে কোনোভাবেই উৎসাহিত করবে না, আমরা এই প্রত্যাশা করি’’। অন্যদিকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সুলতানা কামাল এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে প্রস্তাবকারীদের ধিক্কার জানিয়েছেন। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি করতে যাচ্ছি, তখন শুনতে হচ্ছে মন্ত্রীরা তাদের জন্য সড়কে আলাদা লেইন চান। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে যদি তাদের মনে এমন চিত্র থেকে থাকে, তাহলে তাদেরকে ধিক্কার জানাই।” তিনি বলেন, “এই দেশটিকে একটি বিভাজিত সমাজ এবং দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় আমাদের রাজনৈতিক শক্তি। প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন বিভাজনের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এ কথাটি আসছে এমন সময়, যখন বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া দল ক্ষমতায়।”
আমাদের সমাজে এমনিতে অনেক বৈষম্য, বলা চলে প্রতিটি ক্ষেত্রে। এই সামাজিক বৈষম্যের কারণে সুবিধাভোগীরা বরাবরই রাষ্ট্রের তাবৎ সুযোগ–সুবিধা ভোগ করে আসছেন। অথচ বৃহৎ গোষ্ঠী, আমজনতা বঞ্চিত হয়ে আসছেন সব ক্ষেত্রে। এই সুবিধাভোগী বা ভিআইপিদের মধ্যে আছেন ঋণ খেলাপী, ব্যাংক লুটেরা এবং অনেক অপকর্মের হোতা। যেহেতু তারা ভিআইপি বা সুবিধাশ্রেণীভুক্ত তাই তারা বরাবর থেকে গেছেন আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ আইনের আওতায় এলেও এক পর্যায়ে আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। তাই আবারো এই সুবিধাভোগী শ্রেণীর জন্যে বাড়তি সুবিধার কথা উঠে এলে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় উঠে গোটা দেশ জুড়ে এবং তা সঙ্গত কারণে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এই পৃথক লেইনের বিপক্ষে নই। ইউরোপ সহ উন্নত দেশগুলিতে এই ধরণের বিশেষ লেইন আছে। প্রায় প্রতিটি হাইওয়েতে। কিন্তু এই বিশেষ লেইনটি ভিআইপিদের জন্যে নয়। এই বিশেষ লেইনটি কেবল মাত্র ইমার্জেন্সী বা জরুরি বিভাগের গাড়ি চলাচলের জন্যে। মূল সড়কে যদি কোন কারণে ট্রাফিক জ্যাম থাকে তাহলে এই এমার্জেন্সি লেইনে চলবে ’কেবল’ এম্বুলেন্স, পুলিশের গাড়ি এবং দমকলবাহিনীর গাড়ি, এর বাইরে কেউ না। সে দেশের রাজা হলেও না। বাংলাদেশে যদি এই লক্ষ্য নিয়ে এই বিশেষ লেইন করা হয় তাহলে তাকে স্বাগত জানাবো। কিন্তু এখন যে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন উঠে আসছে, তা হলো, ধরা যাক, আমাদের দেশে এমন মহৎ লক্ষ্য নিয়েই এই এমার্জেন্সি রোড বানানো হলো, কেউ কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে তাতে কেবল জরুরি বিভাগের গাড়ি চলবে? আমাদের তথাকথিত ভিআইপিরা কি ওই সমস্ত এমার্জেন্সি লেইন দিয়ে তাদের গাড়ি চালিয়ে দেবেন না? প্রধান মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির কথা না হয় বাদই দিলাম, নিরাপত্তার কারণে। এমন কী মন্ত্রীদের কথাও বাদ দেই। তারাও না হয় ওই এমার্জেন্সি লেইন দিয়ে চলাচল করলেন। রাজা উজির বলে কথা। কিন্তু অন্য ভিআইপিরা কী করবেন? আমাদের দেশে তো ভিআইপির সংখ্যা কম নয়। হাতের কড়ায় এই শ্রেণীকে গুনে শেষ করা যাবেনা। মন্ত্রীর পর আছেন এম, পি, আছেন আমলা, সেক্রেটারী, সিনিয়র সেক্রেটারী, পুলিশ অফিসার, বিভিন্ন বিভাগের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, আছে সেনাবাহিনী, তারপর আছেন রাজনৈতিক নেতা, উপনেতা, ছাত্রনেতা এবং এনাদের ছেলেমেয়েরা, এমন কী তাদের আত্মীয় স্বজন। যে সমস্ত পুলিশ নিয়ম রক্ষার দায়িত্বে থাকবেন, তাদের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে এদের ঠেকায়! তাই দেখবো এই এমার্জেসি লেইনে দামি দামি গাড়ি, কে কার চাইতে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে তার প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে ভিড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে আটকে পড়া সাধারণ জনগণ।
সাধারণ জনগণ কেবল গাড়িপথে নয়, সব পথেই ভোগান্তির শিকার। বাসে উঠার জো নেই, নৌ পথে একই দশা, ট্রেনের দশাও ভিন্ন নয়। রীতিমত যুদ্ধ করে যেতে হয় অফিসে, কাজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। একদিন নয়, প্রতিদিনের এই দৃশ্য। অন্যদিকে রাজধানী সহ দেশের প্রধান প্রধান নগরীগুলোতে সাধারণ নাগরিকদের হাঁটার পথ নেই। যে ফুটপাত সেই ফুটপাতে যে পা রাখবে তার কোন উপায় নেই। ফুটপাত দখলে গেছে হকারদের। তারা দখল নিয়েছে এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা স্থানীয় মাস্তান পার্টির কাছে বখরা দিয়ে। সাধারণের এই যে নিত্য দিনের সমস্যা তা দেখার, সমাধানের কোন উদ্যাগ নেই কোন পক্ষ থেকে। অন্যদিকে লজ্জাজনকভাবে প্রস্তাব আসছে ভিআইপি বা বিশেষ শ্রেণির জন্যে পৃথক রাস্তার। ভিআইপিরা ফ্রি রোড চান, সাধারণ জনগণ ফ্রি রোড চান না, তারা অল্পতেই তুষ্ট। তারা চান নিরাপদ সড়ক, যানজট মুক্ত সড়ক যাতে প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা এই ভিড়ে আটকে থাকতে না হয়। সংশ্লিষ্টরা এই দিকটায় নজর দেবেন সে আশায় রইলাম।
লেখক: হল্যান্ড প্রবাসী
(সংগৃহীত)