বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

বিএনপির বিরতিহীন লন্ডন পল্টন-গুলশান এক্সপ্রেস

বিএনপির বিরতিহীন লন্ডন পল্টন-গুলশান এক্সপ্রেস

মোস্তফা কামাল, ১২ ফেব্রয়ারি, এবিনিউজ : বিএনপির লন্ডন-পল্টন-গুলশান জার্নির মধ্যেই কারারুদ্ধ হলেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এতে এক দশক পর আবারও ‘চরম পরীক্ষায়’ পড়ল দলটি। এই কারাবাস দীর্ঘমেয়াদি হবে, না জামিনে দ্রুত তিনি ফিরে আসবেন, এটাও বড় বিষয়। তবে এ পরীক্ষায় ভালো মার্কস পাওয়ার পথ রুদ্ধ নয়। বরং ভুল শুধরে রাজনৈতিক চালে ঘুরে দাঁড়ানোর বাড়তি পথও তৈরি হতে পারে। তা নির্ভর করছে কর্মকৌশলের ওপর। আইনি লড়াই, শীর্ষ নেতৃত্বের শূন্যতা, খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ফয়সালার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। সেই টেনশনের বদলে সরকার অ্যাবসলিউট রিলাক্সে রয়েছে চোখ বুজে এমনটিও মনে করা যায় না। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং একটি বড় দলের প্রধানকে কারাগারে পাঠানোর পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বড় কোনো অবনতি হয়নি। তা স্বস্তির সঙ্গে ভাবনারও বিষয়। রায়কে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় কর্মীদের তৎপরতা মানুষকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সরকারের হিম্মত প্রমাণ হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও প্রকাশ পেয়েছে।

বিএনপির অভিযোগ, এটি খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রেখে আবারও একদলীয় নির্বাচনের ষড়যন্ত্রের অংশ। এর বাইরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা রায়টিকে দেখছেন সুদূরপ্রসারী হিসেবে। যা শুধু খালেদা জিয়াকে নয়, নতুন অঙ্কে ঢেলে দিয়েছে রাজনীতিকেও। মা-ছেলে তথা শীর্ষ দুই প্রধানের অনুপস্থিতিতে দল ঘুরে না দাঁড়িয়ে টিকে থাকলেও তা রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। জেলে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়া সিনিয়র নেতাদের বলেছেন, তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে দল চালাতে। এরই মধ্যে এ চর্চা শুরুও হয়েছে। একই মামলায় তারেক রহমানেরও ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- হয়েছে। এ দ-াদেশ মাথায় নিয়ে সুদূর লন্ডন থেকে আগের চেয়েও তৎপর তিনি। গুলশান-পল্টন লোকালে চললেও লন্ডনের গতি বেড়েছে বলে তথ্য রয়েছে সরকারের কাছে। এর একটা বিহিত চাচ্ছে সরকার। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিতে ভাঙনের শঙ্কাও জোরদার। আন্দোলনে ব্যর্থ হলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির একজন নেতাও অংশ নেননি। অথবা সরকারের সঙ্গে যাননি। সেবার যাননি বলে এবার যাবেন নাÑ এমন নিশ্চয়তা এখন পর্যন্ত নেই। যাবেনই এমন সুনির্দিষ্ট তথ্যও নেই। তবে এবার দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ার গুঞ্জন বেশ জোরালো।

দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়ার কারাদ-ে আওয়ামী লীগে তৃপ্তির পাশাপাশি উদ্বেগের তথ্যও রয়েছে। খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়ে যাচ্ছে কিনাÑ এই ভয়মুক্ত নয় সরকার। খালেদা জিয়া ও তার ছেলে দুর্নীতিবাজÑ এটা আদালতে প্রমাণ হওয়া জরুরি ছিল, তা হয়েছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দেশে-বিদেশে এটা প্রচারের যথার্থ সময়। তার ওপর খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য ব্যস্ত থাকতে হবে নেতাদের। এই তৃপ্তির উল্টোদিকে রায়ের আগে-পরে খালেদা জিয়া ও বিএনপির নেতারা রাজনৈতিকভাবে পরিপক্বতার সঙ্গে এগোনোর চেষ্টা করছেন। খালেদা জিয়া বা বিএনপির মতো বৈশিষ্ট্যের কারো এ চেষ্টা ভাবনার বিষয় ক্ষমতাসীনদের কারো কারো কাছে। বিষয়টি রহস্যাবৃত সরকারসহ কোনো কোনো মহলে। তারা কখনো মনে করছেন, রায়ের আগে-পরে কর্মসূচি ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশে দলটি পরিপক্ব আচরণ করছে। আবার কখনো মনে করছেন সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তোড়েই বিএনপি কাবু হয়েছে। এর পেছনে বিএনপির দেশি-বিদেশি বিশেষ পরামর্শের তথ্য জানে সরকারও। খালেদা জিয়ার কারাদ-, বিএনপির ওপর দমন নিয়ে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি বিভিন্ন শক্তির প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও এর লেশ পাচ্ছে সরকার। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদ-াদেশের ঘটনায় দেশে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আরেকটু চড়া।

এসবের রসায়নে কারাবন্দি খালেদা মুক্ত খালেদার চেয়ে জনপ্রিয় হয়ে যান কিনাÑ সরকারি মহলে এ তাড়না ভর করাও অস্বাভাবিক নয়। তার কারাবাস আদালতি বিষয় হলেও বাৎচিত চলছে বাজারদরে। এসব আলোচনায় সবকিছুকে ছাপিয়ে এ সময় সবচেয়ে বেশি আলোচিত চরিত্র খালেদা জিয়াই। যে যার মতো বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন। কারো মতে, এটা আইনি বিষয়। আদালত সঠিক রায়ই দিয়েছেন। কারো কাছে এটি একদম রাজনৈতিক মামলা। নির্বাচনে যাতে খালেদা অংশ নিতে না পারেন সেই উদ্দেশ্যেই মামলার রায় দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া আইনি লড়াই বা রাজনৈতিক চাতুরীতে কারামুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে? রাজনৈতিক টানাপড়েন ও আইনি প্যাঁচে খালেদা জিয়াকে গত ৯ বছরে তিনটি আবাসস্থল পরিবর্তন করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদে বাতিল করা হয় খালেদা জিয়ার মইনুল হোসেন রোডের বাসভবনটি। এটি নিয়েও তখন সরকারের সঙ্গে বিএনপির ব্যাপক আইনগত ও রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া বাধ্য হন সেনানিবাসের বাসভবনটি ছেড়ে দিতে। তিনি ওঠেন গুলশানের বাড়িতে। ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি মামলায় দ-িত হয়ে তার বসত এখন নাজিমউদ্দিন রোডে পরিত্যক্ত কারাগারে। খালেদা জিয়ার এ অবস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন ছুড়ে বলেছেন, উনি (খালেদা) এখন কোথায়?

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সহযাত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। আবার একইভাবে ওয়ান-ইলেভেনের সময় কারা অন্তরীণও ছিলেন তারা। রাজনীতিতে তাদের মধ্যে যেমন বিরোধ সংঘাত ছিল, আবার কখনো কখনো পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও দেখা গেছে সৌহার্দের সম্পর্কও। কিন্তু রায়টির মধ্য দিয়ে তারা যেন যোজন যোজন দূরে চলে গেলেন। একজন ক্ষমতায় থাকলেন, আর একজন চলে গেলেন কারা অন্তরালে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে দুই নেত্রী ও দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের যে কফিন তৈরি হয় খালেদা জিয়ার কারাদ-ে সেই কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হলো কিনা সেই প্রশ্নও বাদ পড়ছে না আলোচনায়। তর্ক-বিতর্কে সেনাসমর্থিত সরকারের সময় দুনেত্রীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলার ইতিহাস উঠে আসছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে নিজেদের সব মামলা তুলে নিয়ে খালেদা জিয়ার মামলাগুলো চালু রাখেন।

অন্যদিকে এ রায়ের পর রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ব্যক্তিগত আলোচনায় ক্ষমতাসীনদের হাজার, শতকোটি টাকার চুরি-কেলেঙ্কারির বিষয়টি বেশ জম্পেশ। বিদ্যমান শত শত দুর্নীতি, বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি আর অনিয়মের বিচার হবে কিনা, তা নিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এর জবাবও রয়েছে। যুক্তিও কড়া। এ পক্ষের যুক্তি হচ্ছে, খালেদা জিয়া একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ দলের প্রধান। যিনি আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে চান। তিনি এক টাকার দুর্নীতি করলেও সেটি হাজার কোটি, লাখো কোটি টাকার দুর্নীতির চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। শেয়ারবাজার-ব্যাংকিং খাতের লুটপাটকে খালেদা জিয়ার দুর্নীতির সঙ্গে মেলানো যাবে না। তাদের মতে, হাজার কোটি টাকার বিচার হয়নি বলে খালেদা জিয়ার দুই কোটি টাকার বিচার হতে পারবে নাÑ এটিও আমলযোগ্য নয়। (সৌজন্যে : আমাদের সময়)

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত