
ঢাকা, ১২ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : ড. সেলিম জাহান নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক। এর আগে তিনি ইউএনডিপির পভার্টি প্র্যাকটিস ব্যুরো ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। সেলিম জাহান ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত গ্লোবাল হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টের কোর সদস্য (লেখক) ছিলেন। ইউএনডিপিতে যোগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ ও কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যাল্ডের স্কুল অব পাবলিক পলিসির ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা, আইএলও, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। সেলিম জাহানের ১০টির বেশি বই এবং দেশি-বিদেশি জার্নালে দেড় শতাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার রচিত গ্রন্থ ‘বেলা অবেলার কথা’। মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য, উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে একটি দৈনিকের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। কোন বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে আমাদের এ অর্জিত হয়েছে?
ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, আমাদের গড় প্রত্যাশিত আয়ু যেখানে ৭২ বছর, সেখানে ভারত ও পাকিস্তানের ৬৬ বছরের মতো। এরপর আমাদের অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩৮, সেখানে ভারত ও পাকিস্তানের ৪৮ ও ৮২। এদিকে আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় তাদের তুলনায় অর্ধেক। মনে রাখতে হবে যে, তাদের তুলনায় অর্ধেক মাথাপিছু আয় নিয়ে আমরা সামাজিক সূচকগুলোয় এগিয়ে রয়েছি। বাংলাদেশের এ অগ্রগতির পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে বলে আমি মনে করি। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক খাতে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাজের কারণে শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমে আসছে, পুষ্টিমান বেড়েছে, গর্ভবতী মায়ের রক্তস্বল্পতার হার কমেছে, এর ফলে প্রত্যাশিত আয়ু বেড়েছে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যদিও তা ঠিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত নয় কিন্তু স্বাস্থ্য খাত এর সুবিধা পেয়েছে। যেমন বিশুদ্ধ পানীয় জলের ক্ষেত্রে যদি জনগণের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা যায়, সেই সঙ্গে অন্যান্য পয়োনিষ্কাশনের ব্যাপারে যদি অগ্রগতি হয়, তাহলে স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ে। দ্বিতীয়ত. শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, আমার মনে হয় সেখানে মেয়েদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ বেড়েছে। যদি ২৫ বছরের পরিসংখ্যান দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে— প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিকে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করা দরকার যে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ফল ভালো। শিক্ষায় মেয়েদের অগ্রগতির কারণ গ্রামবাংলায় ভৌত কাঠামোর উন্নতি। এতে মেয়েরা অনেকটা নিরাপত্তার সঙ্গে ও নিরাপদে স্কুলে যেতে পারছে। কোনো কোনো বেসরকারি সংস্থা, যেমন ব্র্যাক দুটো জিনিস করেছে— এক. মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা, দুই. তাদের কাপড় সরবরাহ করা। ছেলেরা যেকোনো ধরনের পোশাকে বাইরে যেতে পারে কিন্তু মেয়েদের ন্যূনতম একটা পোশাক লাগবে। মেয়েদের জন্য অন্যান্য প্রণোদনা, যেমন বৃত্তির ব্যবস্থাও একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তিন. মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের অন্তর্ভুক্তির ফলে সমাজও এর স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে। প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে সবাই বুঝতে পারছে যে, শুধু ছেলেদের নয়, মেয়েদেরও শিক্ষায় অংশগ্রহণ করা দরকার এবং তারও একটা সুফল আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যেকোনো সমাজে সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ হচ্ছে যদি সে বিনিয়োগটা মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে করা যায়। কারণ এ বিনিয়োগের প্রভাব বহুমাত্রিক। শ্রমবাজারের পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও এর প্রভাব পড়ে। কারণ একজন শিক্ষিত মা জানবেন শিশুর পুষ্টির ক্ষেত্রে কী করা প্রয়োজন, শিশুটি অসুস্থ হলে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবেন, সন্তানের শিক্ষাকে অন্য রকমের মূল্য দেবেন। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচক, মানব উন্নয়নের মান ও মানব উন্নয়নের ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে নীতিমালার একটা প্রভাব আছে। তবে সেই প্রভাবের পরেও সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। সেই সঙ্গে আমি মনে করি, বেসরকারি সংস্থাগুলোরও বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে।
বর্তমানে যে কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করছি, যে হারে এগোচ্ছি, তা কি যথাযথ? এছাড়া পরবর্তীতে আমাদের কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে?
আমার মনে হয়, যে হারে এগোচ্ছি, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে এগোতে হবে। অন্যথায় আমাদের সামনে যারা রয়েছে, তাদের ছুঁতে পারব না। আবার আমরা যে হারে এগোচ্ছি, তা বজায়যোগ্য করতে হবে। তা না হলে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। কারণ আমরা জানি, আমাদের অর্থনীতিতে ভঙ্গুরতা আছে। সমাজ ব্যবস্থায় এক ধরনের নাজুকতা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষত যেসব জনগোষ্ঠী প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে, তারা এটি দ্বারা প্রভাবিত। মানব উন্নয়ন সূচকে মান নিশ্চিত করতে হলে কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া দরকার। একটি হলো, নিশ্চিতভাবে আমাদের মাথাপিছু প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। কারণ মনে রাখা দরকার, আমাদের জনসংখ্যার পরিমাণ বড়। যে দেশে আমাদের তুলনায় অর্ধেক জনসংখ্যা রয়েছে, সেখানে ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি বাড়লে তাদের মাথাপিছু আয় যে হারে বাড়বে, আমাদের ওই হারে বৃদ্ধি পাবে না। তবে যেকোনো প্রবৃদ্ধি বাড়ালে মানব উন্নয়ন হবে না। ধরা যাক, আপনি ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি বাড়াচ্ছেন কিন্তু এ প্রবৃদ্ধির উৎসটা কী? প্রবৃদ্ধিটা কি সেবা খাত থেকে আসছে না শিল্প খাত থেকে? নাকি তার উৎসভূমিটা হচ্ছে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি? আমাদের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের জাতীয় আয়ে কৃষির যে ভূমিকা কিংবা কৃষির যে অবদান তা বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে কমে এসেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে সিংহভাগ বহন করছে। আরেকটি কথা হচ্ছে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে বেশির ভাগ দরিদ্র মানুষের বাস। যদিও আমরা দেখতে পারছি যে, নগরদারিদ্র্য বাড়ছে। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য গ্রামীণ অর্থনীতিতে ও কৃষিকাজে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। খাদ্যের লভ্যতা কিংবা কম মূল্যে খাদ্য পাওয়া যেতে পারে— এটি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বড় কারণ নয়। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কারণ সেখানে বড় ধরনের কর্মনিয়োজন হবে। দরিদ্র মানুষ এখানে বাস করে। তাদের কর্মে নিয়োজনের মাধ্যমে আমাদের প্রবৃদ্ধির প্রকৃতিটা অন্য রকম হবে। দারিদ্র্য বিমোচন অভিমুখী প্রবৃদ্ধি আমাদের খুব দরকার। এটা সমতার কারণেও দরকার। আমাদের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, তা যদি শুধু একটি বিশেষ খাত থেকে আসে, যার সঙ্গে বাকি অর্থনীতির কোনো যোগাযোগ নেই, তাহলে হবে না। এ কথাটা আমি একটু জোরের সঙ্গে বলতে চাই। এখন পর্যন্ত আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল উৎস দুটি— এক. পোশাক শিল্প, অন্যটি অদক্ষ শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স। সমস্যাটা হলো, পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রতিযোগীর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যেমন— ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এগিয়ে আসছে। বিশ্ববাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হলে নিশ্চিতভাবে নিজেদের দক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতা বাড়াতে হবে। অদক্ষ শ্রমিকরা দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন কিন্তু তারা কত সংখ্যায় কর্মে নিয়োজিত থাকবেন এবং কত দিন পর্যন্ত অর্থ পাঠাতে পারবেন, এটা নির্ভর করছে যে দেশে তারা যাচ্ছেন, সেই দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতির ওপর।
অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে শুধু একটি বা দুটি খাতের ওপর নির্ভরশীল থাকলে বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো রকম নাজুকতা তৈরি হলে আমাদের ওপর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। দুই. এটির সঙ্গে যদি বৃহত্তর অর্থনীতির যোগাযোগ না থাকে, তাহলে এর সুবিধাটা বৃহত্তর অর্থনীতি পাবে না। একটা উদাহরণ দিই। অদক্ষ শ্রমিকদের কাছ থেকে যে অর্থ আসে, সেটা যদি শুধু ভোগ বা সামাজিক অনুষ্ঠানের পেছনে ব্যয় করা হয় তাহলে অর্থনীতিতে উৎপাদনের যে ভিত্তি তৈরি করা দরকার, তা হবে না। আমার মনে হয়, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এ প্রবৃদ্ধি যাতে বহুধা খাত থেকে আসতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি আপনি এক ধরনের বজায়ক্ষম প্রবৃদ্ধি চান, তাহলে এটি কিন্তু বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। দ্বিতীয়ত. শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা কিছু অর্জন করেছি, তবে এক্ষেত্রে যে প্রশ্ন এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে শিক্ষার মান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর প্রচুর শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসছেন, তাদের কাছে সনদও আছে। এখন প্রশ্নটা হচ্ছে, তারা কী শিখছেন? আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা বেরিয়ে আসবেন, তারা যে কেবল দেশের অভ্যন্তরে সমসাময়িক অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবেন তা নয়, তাদের প্রতিযোগিতাটা হবে বিশ্বের সঙ্গে। আর এটা যদি করতে হয় তাহলে যে দক্ষতা তারা অর্জন করে এসেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। আমি যে বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তা হলো, তরুণদের সৃষ্টিশীল হতে হবে। সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব তৈরি করতে হবে। কারণ আগামী দিনে যে ধরনের উৎপাদন হবে সেখানে আপনি হয়তো একটা অংশ উৎপাদন করবেন, আমি হয়তো একটা অংশ করব, আরেকজন হয়তো অন্য অংশটা উৎপাদন করবে। সুতরাং ব্যক্তিকেন্দ্রিক উৎপাদন বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড ক্রমে কমে যাবে। উৎপাদনটা হবে দলকেন্দ্রিক, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। তাই একটা গোষ্ঠীর মধ্যে কী করে নিজের সৃষ্টিশীলতা বজায় রেখে কাজ করা যায়, সেটি কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন। তৃতীয়ত. সংযোগ। ধরুন, বাংলাদেশে বসে আমরা কয়েকজন একটি কাজ করছি। এক্ষেত্রে আমাকে কিন্তু মনে রাখতে হবে বাইরের বিশ্বে এ-জাতীয় কাজ কারা করছে, কীভাবে করছে। সেখানে আমরা প্রতিযেগিতা করতে পারি কিনা কিংবা ওদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের কী করতে হবে। চতুর্থত. আত্মবিশ্বাস। এর অভাবে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতা করতে পারব না। মূলত প্রতিবন্ধক হচ্ছে মানের উন্নয়ন নিশ্চিত করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য— সব জায়গায় মানের উন্নয়ন করতে হবে। ধরুন, আপনি এক হাজার নতুন হাসপাতাল তৈরি করলেন কিন্তু সেখানে যদি ডাক্তার, নার্স না থাকে তাহলে কিন্তু সুবিধাটা পাচ্ছেন না। অন্য প্রতিবন্ধক হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এটা কেবল পরিবেশগত সমস্যা বা প্রতিবন্ধক নয়, এটি একটি উন্নয়ন প্রতিবন্ধক। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কেবল পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে না, এটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ওপরও প্রভাব ফেলবে। যেমন— জলবায়ু যদি পরিবর্তন হয় তাহলে কৃষকের ওপর একটা প্রভাব পড়বে, পরবর্তীতে এটি কৃষি উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করবে। দেখা যাবে উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। চতুর্থত. আমরা জানি, উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সবলতা একটি বড় ব্যাপার। যে প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন পরিকল্পনা করবে, উন্নয়ন পরিকল্পনাকে কাজে লাগাবে, উন্নয়ন পরিকল্পনার ফলাফল মূল্যায়ন করবে, সেখানে যদি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা থেকে যায়, তাহলে সবসময় তা প্রতিবন্ধকতার কাজ করবে। পঞ্চমত. সম্পদ। একে আমি বড় ধরনের প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে করি না। খুব কম সম্পদে উন্নয়নের গতিময়তা বহুদেশে সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে বলব, দেশজ খাত থেকে সম্পদ আহরণের যথেষ্ট সুযোগ বাংলাদেশে আছে। এর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার কিন্তু আমরা করছি না। যেমন— আপনি যদি কর ব্যবস্থার দিকে তাকান দেখতে পারবেন, আমাদের কর ব্যবস্থা কিন্তু প্রগতিশীল নয়। ধনী ও দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে করের যে আপাতন, সেখানে যে ধরনের প্রগতিশীলতা থাকা দরকার ছিল, তা কিন্তু নেই। সুতরাং এ ব্যবস্থাটাকে প্রগতিশীল করা যেতে পারে। দেশের উপরের দিকে যে সম্পদ এবং যে আয় রয়েছে, সেখান থেকে আরো সম্পদ আহরণ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত. সম্পদের অপচয়। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার পাশাপাশি সেখানে দুর্নীতি ও অন্যান্য সমস্যা রয়েছে। সুশাসনের সঙ্গে এ বিষয়গুলোও সম্পৃক্ত। একে রোধ করতে হবে। তৃতীয়ত. সম্পদের দক্ষ ব্যবহার। আমার মনে হয়, মানব উন্নয়নের মান ও ব্যাপ্তিকে ত্বরান্বিত ও বজায়ক্ষম করার জন্য এ প্রতিবন্ধকগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার।
মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার কমা ইত্যাদিসহ আমরা যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি, এগুলো সব পরিমাণগত উন্নতি। এক্ষেত্রে যানজট, স্বাস্থ্যসেবার মানের উন্নতির দিকে নজর দেয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
কিছু বিষয় রয়েছে, তা উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গেই আসবে। যানজট নিয়ে আমরা সবাই বিরক্তি প্রকাশ করে থাকি কিন্তু কয়েক বছর আগে ঢাকা নগরীতে দূষণের যে মাত্রা ছিল, এখন খানিকটা কমেছে। যানজট প্রসঙ্গে বলব, একটা দেশের যখন উন্নতি হয় বা দেশটি যখন একটি স্তর থেকে অন্য স্তরে যায় তখন এ ধরনের কিছু বিষয় আমরা স্বাভাবিক ফলাফল বলতে পারি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বর্তমানে ঢাকার যানজটের অবস্থাটা একটি স্বাভাবিক ফল। আমরা ঠিকমতো যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ করছি না বলে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা রয়েছে। এটি দূর করা গেলে যানজটের সমস্যা থাকবে না। আরেকটি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বাংলাদেশে সবসময়ই বৃষ্টি হয়। আগে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। এখন বিভিন্ন জায়গার জলাশয়গুলো বুজিয়ে দিয়ে সেখানে আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এতে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের এ কষ্ট ও ভোগান্তি যদি দূর করতে না পারি, প্রবৃদ্ধি যতই অর্জিত হোক, এ অবস্থাকে আমি উন্নয়নের স্বাভাবিক ফল মনে করি না। এটি সত্যিকার অর্থে জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। চূড়ান্ত বিচারে উন্নয়নের আসল উদ্দেশ্য জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা। আর মান বাড়াতে হলে এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া দরকার। পরিমাণগত দিক থেকে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ কিনা, সেটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রবৃদ্ধির প্রকৃতিটা কী, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কর্মনিবিড় প্রবৃদ্ধি হতে পারে আবার কর্মহীন প্রবৃদ্ধিও হতে পারে। শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে কিন্তু শিক্ষার মান কেমন, তা একটি বড় প্রশ্ন। স্বাস্থ্যের মান থেকে শুরু করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যদি ভোগান্তি থাকে, সেটাও একটি বড় প্রশ্ন।
একসময় বলা হতো, আমাদের উন্নয়ন নীতিটা হচ্ছে ধনিক শ্রেণীর সহায় নীতি। এখনো ওই উন্নয়ন নীতি বিদ্যমান। আপনার কি মনে হয়, নীতিটা ঠিক আছে? যদি না হয় তাহলে পরিবর্তনটা কোথায় হওয়া দরকার?
ধনিক শ্রেণী সন্নিবিষ্ট উন্নয়ন যেটা, তা কিন্তু কোনো জায়গাতেই কাজ করে না। পঞ্চাশের দশকে বলা হয়েছিল, অসমতার একটি ইতিবাচক দিক আছে। তা হলো, সমতা যদি থাকে তাহলে সমাজের ধনিক শ্রেণীর যারা আছেন, তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বেশি হবে, ভোগের প্রবণতা কমবে। এতে বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত বেশি হবে। এটা বিনিয়োগের ফলে প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি হবে। তারপর একটা সময় আমরা দেখব যে পুনর্বণ্টন কী করে করা যায়। শুধু বাংলাদেশে নয়, এ তত্ত্ব কোথাও কাজ করে না। এটা কাজ না করার মূল কারণ হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ধনিক শ্রেণী সঞ্চয়ও বেশি করে না, আর যেটা সঞ্চয় করে তা ঠিক উৎপাদন বা বিনিয়োগের কাজে ব্যবহার করে না। তারা সেটা উচ্চস্তরের ভোগের কাজে ব্যবহার করেন। কোনো কোনো দেশে ওই বিনিয়োগযোগ্য পুঁজিটাও বাইরে চলে গেছে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, কীভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে, তার ওপর প্রবৃদ্ধির বণ্টন নির্ভর করে। শ্রমঘন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে শ্রমিকের ভাগটা বেশি হবে। আবার পুঁজিঘন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে যিনি পুঁজি সরবরাহ করেছেন, তার ভাগটা বেশি হবে। সুতরাং আগে প্রবৃদ্ধি তারপর বণ্টন— এ তত্ত্বটা কাজ করে না। আপনাকে স্থির করতে হবে আপনি একটা সমবণ্টনসম্পন্ন প্রবৃদ্ধি চান। তাহলে উৎপাদন ব্যবস্থায় কতখানি পুঁজি লাগবে, কতজন দক্ষ শ্রমিক লাগবে, কত অদক্ষ শ্রমিক লাগবে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিভিন্ন দেশে যখন উন্নয়ননীতি গ্রহণ করা হয় তখন সেখানে দুটো অভিমুখী ব্যবস্থা থাকে। একটি ধনিক শ্রেণী, অন্যটি নগরকেন্দ্রিক। আমরা মনে করি যে, নগরেই সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে, নগরের কাঠামো বাড়াতে হবে, নগরেই বিনিয়োগ বেশি হতে হবে। ধনিক শ্রেণী ও নগরকেন্দ্রিকতা পরস্পর সম্পৃক্ত। তবে আমার মনে হয়, দুটোকেই আলাদা করে দেখা দরকার। ধনী ব্যক্তিরা গ্রাম থেকে নগরে চলে আসছেন। সুতরাং এ অবস্থান থেকে দূরে সরে আসার প্রসঙ্গে আমি প্রথমেই বলব, ধনিক শ্রেণীভিত্তিক যে উন্নয়ন, তা কখনই বজায়ক্ষম হবে না। কারণ এ-জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণের ফলে সমাজের মধ্যে অসমতা তৈরি হবে এবং সেই অসমতার চিহ্ন নানা সময়ে নানা দিক থেকে প্রতিফলিত হবে। এই অসমতা বৃদ্ধির কেবল অর্থনৈতিক নয়, এর কিন্তু একটা সামাজিক দিকও রয়েছে। কারণ অসমতা যদি অসহনীয় ও দৃষ্টিকটু পর্যায়ে চলে যায় তখন নিচের দিকে যে জনগোষ্ঠী রয়েছে, তারা কিন্তু প্রশ্ন তুলবে— এ অসমতা কেন হবে? এতে সামাজিক দিক দিয়ে এক ধরনের ভঙ্গুরতার সৃষ্টি হবে। এটি নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত। আমার মনে হয়, সমাজে যারা উপরের দিকে আছেন, তাদের সুরক্ষিত অবস্থানের জন্যই সমতাসম্পন্ন উন্নয়নের দিকে যাওয়া দরকার। বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি, অসমতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ায় নানা ধরনের বিক্ষোভ, বিস্ফোরণে সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সংঘাতগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার অনেকটাই কিন্তু এ অসমতার কারণে। যদিও এর পেছনে আরো অন্য কারণ রয়েছে। সুতরাং এই যে ধনমুখী বা নগরমুখী পরিকল্পনা, এটা কাজ করবে না। আমাদের নগরকেন্দ্রিক থেকে পল্লীকেন্দ্রিক যেসব শ্রেণী আছে, তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এতে যে শুধু দরিদ্র শ্রেণীর উপকার হবে তা নয়, ধনিক শ্রেণী ও নাগরিক যে শ্রেণী রয়েছে, তাদের দীর্ঘমেয়াদি একটা সামাজিক সুরক্ষার জন্যও আপনি এটা করছেন।
দরিদ্রদের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে, কৃষিতে ভর্তুকি দেয়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে কিন্তু কার্যক্রমগুলো খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না—
আপনাকে আগে দেখতে হবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালার মধ্যে কী আছে। আপনার প্রশ্নের সূত্র ধরে বললে, আপনি সমস্যাগুলোর সমাধানে একটি বিন্দুতে এসে কাজ করতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু সমাজে নানা গোষ্ঠী রয়েছে, যারা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। যেমন— প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। তাদেরও সামাজিক সুরক্ষা, নিরাপত্তা দিতে হবে। নজর দিতে হবে সামষ্টিক নীতিমালার দিকে। সামষ্টিক নীতিমালার মধ্যে দেখতে হবে আমাদের আর্থিক, বাণিজ্যিক নীতিমালায় কী আছে, দরিদ্র শ্রেণীকে আমরা কতটা সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছি। দেখতে হবে ঋণের সিংহভাগ ধনিক শ্রেণীর কাছে চলে যাচ্ছে কিনা। তেমনিভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন, তারা ক্ষমতা বা অন্য কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, খুব সামান্য পরিমাণে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে পারছেন না, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ফলে অন্য রকম এক ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য নানা রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলছি কিন্তু আমাদের সামষ্টিক যে নীতিমালা, তার মধ্যে যদি দরিদ্র শ্রেণী বা পল্লী অঞ্চলের প্রতি বিরূপ ব্যাপার থেকে থাকে তাহলে একটি দ্বন্দ্ব থেকে যাবে। ক্ষত যেটা আছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ক্ষত সারতে জায়গায় জায়গায় মলম লাগালে চলবে না। এতে ক্ষত সারবে না। আপনি হয়তো প্রশ্ন করবেন, কেন? আমাদের দারিদ্র্য তো কমেছে। যেখানে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশ ছিল, এখন তা ১৩ শতাংশে এসেছে। প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের মধ্যে সবসময় একটা সম্পর্ক থাকবে কিন্তু দারিদ্র্য আরো কমিয়ে আনা যায় যদি সামষ্টিক ক্ষেত্রে সে-জাতীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রবৃদ্ধি হলে জনগণ এর সুযোগ গ্রহণ করে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে কর্মকুশলতা, উদ্ভাবনী শক্তি আছে, সেখানে নিশ্চিতভাবে জনগণ প্রবৃদ্ধির মধ্যে অংশগ্রহণ করে। নীতিমালাগুলোকে আরো ব্যাপ্ত করা যেতে পারে। তাহলে প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার ১৩ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশে নেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে চীন হচ্ছে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১৯৯০ সালে যেখানে ওদের দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৬৪ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে এটি নেমে আসছে ৪ শতাংশে। সামষ্টিক নীতিমালার সঙ্গে লক্ষ্যভিত্তিক নীতিমালা নিয়ে দেশটি তাদের দারিদ্র্যের হার কমিয়ে এনেছে। আমি বলব, চীনের জন্য এটা একটা বড় প্রাপ্তি ও অর্জন।
(সৌজন্যে : বণিক বার্তা)
এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ