![নেতা : রকমভেদ সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/13/ahidul-alam_125714.jpg)
ডা. কিউ.এম. অহিদুল আলম, ১৩ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : আমাদের সময়ে হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণী থেকে ইংরেজী বিষয়ে হরেক রকমের বাংলা থেকে ইংরেজী ট্রানশ্লেষণ করানো হত। প্রবাদ আকারের কিছু ট্রানশ্লেষণ ছিল। এগুলোতে শাব্দিক অনুবাদ হতো না। বিষয়টির অর্থ অনুযায়ী অনুবাদ হতো। আমরা বাংগাল মানুষ। এসব অনুবাদ মুখস্থ করতাম। যেমন তেলে মাথায় তেল দেওয়া। বিলাতে আমি যখন নিউক্যাসল শহর অতিক্রম করছিলাম তখন মনে হলো তেলে মাথায় তেল দেওয়ার ইংরাজী অনুবাদ কেন Carrying coal to Newcastle হলো। নিউক্যাসল উত্তর লন্ডনের কয়লা সমৃদ্ধ একটি শহর। বিলাতের শিল্প বিপ্লব শুরুই হয়েছিল কয়লা দিয়ে। সারা বিশ্বে কয়লার হেডকোয়ার্টার ছিল নিউ ক্যাসল। তাই কেউ যদি নিউক্যাসলে কয়লা নিয়ে যায় এটা গ্রহণযোগ্যও নয়, বিবেচনা প্রসূতও নয়। তাই তেলে মাথায় তেল দেওয়ার ইংরাজী অনুবাদ বৃটিশরা ওভাবেই করে গিয়েছেন। আমরাও ওভাবেই শিখেছি। ছাত্র জীবনের আরেকটি ট্রানশ্লেষণ ছিল “সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই।” অযোধ্য এখন রামের জন্মভূমি ও বাবরী মসজিদ ভাংগার বিজেপি কর্মীদের গর্জনের জন্য বিখ্যাত, রাম রাজত্বে অযোধ্যায় যে সমৃদ্ধি ছিল ওটাও কয়জন হিন্দু জানে। তাই তো প্রবাদ হয়ে গিয়েছে সারারাত রামায়ন পড়লাম ভোরে উঠে বলে–সীতা কার বাপ? যা হোক “সেই রামও নেই–সেই অযোধ্যাও নেই।” এর ইংরাজী অনুবাদ শিখেছি Those days are gone.
সম্প্রতি আমাদেরই প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরার তিনবার নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এর আর্থিক অবস্থা নিয়ে এক খবর ভারতীয় পত্রিকার শিরোনাম হয়। শ্রী মানিক সরকার ত্রিপুরার মার্ক্সবাদী কমিউনিষ্ট মুখ্যমন্ত্রী। সারা বিশ্বে যখন ধনবাদের ধাক্কায় মার্ক্সবাদ ও কমিউনিজম শব্দদ্বয় সাগরের অতল তলে চলেছে তখনও ভারতের দক্ষিণের কেরালা ও আমাদের প্রতিবেশী ত্রিপুরায় কমিউনিস্ট রাজত্ব চলছে। এই দুই রাজ্যের মানব সূচক ইনডেক্স ভারতের অন্য রাজের উপরে এবং বাংলাদেশেরও উপরে। গত বিশ বছরে ত্রিপুরায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্পে যে উন্নতি হয়েছে তা সর্বভারতীয় গড় এর উপরে। সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন নেতার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে।
মানিক সরকার ভারতের ইন্ডিয়া টুডের জরীপে সবচেয়ে দরিদ্র মুখ্যমন্ত্রী। তার এই অবস্থা আমাদের দেশের নেতারা তো হেসেই উড়িয়ে দেবেন। বলবেন–পাগলামি আর কি?
আজকের এই প্রবন্ধের অবতারণার কারণ শুধু বোঝার জন্য যে এখনো দুই একজন নেতা আছেন যারা রাজনীতিকে অর্থ অর্জনের সহজ পন্থা মনে না করে সমাজ ও মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। সম্প্রতি সম্পদের বর্ণনা দিতে গিয়ে মানিক সরকার এর দুই ব্যাংকে ৩৯৩০ রুপী ও ২৪১০ রুপী পাওয়া গেছে। তার নিজস্ব কোন বাড়ি নেই। তিনি কোন ইনকামট্যাক্স দেন না। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যে বেতন পান তা পুরোটা কমিউনিস্ট পার্টিকে দান করে দেন। তিনি অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর আনুসাংগিক সুবিধাদি ভোগ করেন।
তার স্ত্রীর নাম পানচানি ভট্টচার্য, তিনি অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী। তার ব্যাংকে পাওয়া গেছে তিন একাউন্টে ২০১৪০ রুপী, এক লাখ চব্বিশ হাজার ১০১ রুপী, ৮৬৪৩৩ রুপী,মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রীর তিনটি এফডি আর রয়েছে–২লাখ, ৫ লাখ ও ২.২৫ লাখ রুপীর। তার স্বর্ণ আছে ২০ ভরি, স্ত্রী বাবা থেকে ৮৮৮.৩৫ স্কয়ার ফুট অর্থাৎ ১গন্ডা থেকে সামান্য বেশী জায়গা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। এই জায়গাতে তাদের একটি বাড়ী আছে যার বর্তমান বাজার মূল্য ২২ লাখ রুপী।
মানিক সরকার ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন দর্জি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিক ম পাশ করেন। তখন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ২০০৮ সাল থেকে পলিটবুরো কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, তখন থেকেই মুখ্যমন্ত্রী।
দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কেরালায় ১৯৫৭ সালেই কমিউনিস্টরা সরকার গঠন করেন। কিন্তু ধনবাদী নেহেরু সেই সরকার ভেঙ্গে দেন। এই জেরে ওখানে মার্ক্সবাদী আন্দোলন আরো শক্ত ভিত গড়ে তোলে যা এখনো মোটামুটি বিদ্যমান। ১৯৬৭ সালে কেরালায় অচ্যুট মেননা নামে এক কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী হন। তিনি তৎকালে ইন্দিরা গান্ধীর অন্দরের কয়েকজন পরামর্শ দাতাদের একজন ছিলেন। তিনি কয়েকবার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কেরালায় ১৯৮৮ সালে আমাকে তৎকালীন একজন মন্ত্রী অচ্যুট মেননের বাসায় নিয়ে গেলেন তার গ্রামের বাড়ীতে। উল্লেখ্য যে কেরালায় খুব কম মানুষ নিজের ভিটে ছেড়ে রাজধানী বা বড় শহরে বসতি করেন। কারণ গ্রাম শহর সবখানে প্রায় সমান শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুবিধা। যা হোক আমরা অচ্যুট মেননের বাড়ী পৌঁছলে উনার স্ত্রী বসতে বললেন অত্যন্ত সাধাসিধে ড্রইং কাম ডাইনিং রুমে। স্ত্রী বললেন– মেনন সাহেব রেশন আনতে গিয়েছেন। কেরালায় প্রত্যেক পরিবার রেশন পেত তখন। প্রাক্তন এই মুখ্যমন্ত্রী নিজ রেশন নিজে আনতে যান।
আমরা আজকে সামাজিক যে স্তরে আছি সেখানে নেতাদের অবস্থান কি? পাতি নেতারা ও ভোগবাদের বদৌলতে গাড়ী–বাড়ী মাদক নারীতে আসক্ত। প্রত্যেক নেতা স্বীয় আঙ্গিকে একজন Land, Lord, উঠতি নেতাদের দোষ নেই। তারা বড় ভাইকে শুধু ফলো করেন। একজন মানিক সরকার বা একজন অচ্যুট মেনন জাতের নেতা এই সমাজে পাওয়া যাবে কি? ত্রিপুরা ও কেরালার প্রধান খাদ্য আমাদের মতোই ভাত–মাছ, কিন্তু সামাজিক দর্শন গ্রহণে কত পার্থক্য। এই প্রবন্ধ পড়ে স্বাভাবিকভাবেই পাঠকরা বলবেন–আমরা আমাদের মতোই চলব। “সেই রামও নেই সেই অযোধ্যাও নেই”। তবুও আছে ছিটে ফোটা দুই একজন মানিক সরকার বা অচ্যুট মেনন।
(সংগৃহীত)