![উপমহাদেশ আজ সুবিধাভোগীর শ্রেণিরাষ্ট্রে পরিণত](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/15/rofiq_125977.jpg)
আহমদ রফিক, ১৫ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : ভারতীয় উপমহাদেশ বাস্তবে এবং ইতিহাসবিদদের বিচারে বহুজাতি, বহুভাষী ও অনুরূপ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এক উর্বর ভূখণ্ড। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন পরিযায়ী মানবগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষায়। বেশির ভাগই এই মাটিতে স্থায়ী বসবাস গড়ে তুলে ভারতীয় পরিচিতি লাভ করেছে। ব্যতিক্রম ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী। তারা এসেছে, শাসন-শোষণ-লুণ্ঠন করে একসময় তাদের স্বদেশে ফিরে গেছে।
নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের বিচারে ভারতের বৈশিষ্ট্য তার বহুত্ববাদী বৈচিত্র্যে ও স্বাতন্ত্র্যে। আর তা পরস্ফুিট জাতি, ভাষা, ধর্ম, জীবনাচরণ ও সংস্কৃতির নানা দিক থেকে। এদের স্থিতি সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা আধুনিক যুগের বিশেষ বিশেষ প্রদেশগুলোকে কেন্দ্র করে। যেমন—পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বেলুচিস্তান বা সীমান্ত প্রদেশ থেকে আসাম, বঙ্গদেশ ওড়িশা প্রভৃতি আধুনিক শাসনের ছোট ছোট ভূখণ্ড, যেগুলো প্রদেশ নামে পরিচিত; কিন্তু ভাষিক জাতিসত্তার বিচারে অনেকগুলোই বিশেষভাবে স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত।
এদিক থেকে দক্ষিণ ভারতের রয়েছে সুনির্দিষ্ট ভাষিক জাতিগত পরিচয়—তামিল, তেলেগু, মালয়ালম, কানাড়ি প্রভৃতি ভাষাভিত্তিক জাতি-অধ্যুষিত প্রদেশ। অবশ্য বাদ নয় পশ্চিমের গুজরাট, মহারাষ্ট্র এবং খানিকটা পুবের ওড়িশা। আর বাংলা, আসাম তো আছেই। আধুনিক যুগে অবিভক্ত ভারতে লীগ-কংগ্রেস রাজনীতির তথা হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের সুষ্ঠু সমাধান ছিল অখণ্ড বহুজাতিক ভারতীয় ফেডারেশন, স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক উল্লিখিত প্রাদেশিক ইউনিটগুলো নিয়ে। স্বশাসনের দাবি ও ভাষিক জাতিসত্তার স্বীকৃতি ছিল অনেকের কাম্য।
কিন্তু লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তানি উন্মাদনা, বাঙালি মুসলমানের প্রতিযোগিতাহীন স্বতন্ত্র ভুবনের স্বপ্ন এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির রক্ষণশীলতা ও অনুদারতা—এই দুইয়ে মিলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও দাঙ্গার রক্তাক্ত আবহে সুবুদ্ধির উদারতা সব কিছু ভেস্তে যায়। এ ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষ দায় অনস্বীকার্য। নেপথ্যে শ্বেতাঙ্গ শাসকশ্রেণির কূট চতুরতা, বিভাজননীতি।
তাই একটি রাজনৈতিক সত্য অনস্বীকার্য যে এই চাতুর্যের খেলায়, জিন্নাহ বনাম গান্ধী-নেহরুর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা দাবার খেলায় তাঁরা ওই শাসকশক্তির চালে মাত হয়ে যায়। ক্ষুব্ধ, জেদি জিন্নাহ তাঁর ভাষায় ‘পোকায় খাওয়া’ পাকিস্তান নিতে রাজি, কিন্তু অখণ্ড ভারতে তার অবস্থান কিছুতেই নয়। বিষণ্ন গান্ধী-নেহরুর ছুঁচো গেলার মতো বিস্বাদমুখে দেশভাগ মেনে নেওয়া। তাঁদের কথা—দাঙ্গার রক্তস্নান তো বন্ধ হোক ভারত ভাগের বিনিময়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও রক্তপাত তো বিভাজিত দুই ভূখণ্ডে অব্যাহত থেকেছে। এমনকি বন্ধ হয়নি দীর্ঘকাল পরও ত্রিধাবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশ—ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে।
জিন্নাহর দাবি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বিভাগোত্তরকালে ভেসে গেছে আরব সাগরের নোনা পানিতে। বৃথাই ‘জিয়ে সিন্দ’ কিংবা বালুচ ও পাখতুনদের জাতীয়তাবাদী মুক্তিসংগ্রাম আর রক্তধারা। শুরুতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি, অনাদায়ে বিচ্ছিন্নতার ব্যর্থ মুক্তিসংগ্রাম। শক্তিমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দাপটে বালুচ ও পাখতুন মুক্তিসংগ্রামীদের রক্তদান সুফল আদায় করতে পারেনি। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ একাধিক কারণে।
ভারত বিভাগ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ইতিহাস লেখকদের কেউ কেউ এমন কথা বলেছেন যে দুই বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিবিদ গান্ধী-জিন্নাহ এবং অন্য দুই বয়স্ক রাজনৈতিক নেতার বয়সের কারণে ক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্য অস্থিরতা দেশবিভাগ অপরিহার্য করে তোলে। কথাটা অন্য কারো মতে গান্ধীর জন্য খাটে না, বাকি তিনজনের ক্ষেত্রে সত্য হলেও।
দুই.
ইতিহাসের পরিহাস যে তারা সদ্য বিদেশি শাসনমুক্ত স্বদেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক সুশাসন কায়েম করতে পারেননি। ভারত একটি সেক্যুলার সংবিধান প্রণয়ন করেও সেই ধারা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, তার অবশেষ পরিণতি বর্তমান হিন্দুত্ববাদী, সম্প্রদায়বাদী বিজেপি শাসন। এ শাসন চরম প্রতিক্রিয়াশীল। এর রাজনীতি সমাজকে সম্প্রদায়বাদী চেতনায় দূষিত করে চলেছে।
আর পাকিস্তান তার জন্মলগ্ন থেকেই সম্প্রদায়বাদী শাসনের ধারা প্রবর্তন করে দমননীতির মাধ্যমে দেশ শাসন করেছে। গণতন্ত্রী শাসনে জিন্নাহর রুচি ছিল না, একনায়কতান্ত্রিক শাসনে ছিল তাঁর প্রগাঢ় আকাঙ্ক্ষা। সেই ধারা তাঁর মৃত্যুর পর সামরিক বা কখনো বেসামরিক স্বৈরশাসনে পরিণতি লাভ করেছে। সেখানে ছিল পাঞ্জাবি-স্বার্থপ্রধান রাজনীতি। আর ছিল সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন রাজনীতির প্রভাব, অস্ত্র সাহায্য, অর্থ সাহায্য ও রাজনৈতিক স্বার্থের প্রভাব। পাকিস্তান এখনো হত্যা ও রক্তপাতের রাজনীতি এবং স্বৈরতন্ত্র বা সমরতন্ত্রী শাসনে সেই আদি ভুলের মাসুল গুনছে। কবে পাকিস্তানে রাজনৈতিক সামাজিক রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে, তা একমাত্র সময়ই বলতে পারবে।
পাকিস্তান আমলে এজাতীয় সামরিক ও সমরতন্ত্রী স্বৈরতন্ত্রী শাসন সাংবিধানিক পরিণতি পায় ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণায় (১৯৫৬)। পাকিস্তানি রাজনীতি পূর্বাপর এই বৈশিষ্ট্যেই চলেছে। এর মধ্যে আরেকটি দিক ছিল বাংলাভাষী বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গকে শাসন-শোষণ। দুই পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বৈষম্য এত দ্রুত বাড়তে থাকে যে পূর্ববঙ্গে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বাস্তবায়নের রাজনীতি (প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন) প্রবল হয়ে ওঠে। আর তা দমনে পাক শাসন গণহত্যার সূচনা ঘটালে যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত হয়ে ওঠে (১৯৭১)। পূর্ববঙ্গে মুক্তিসংগ্রামের ধারায় একুশের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একাকার হয়ে যায়। পূর্ববঙ্গ হয়ে ওঠে স্বাধীন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্র।
শুরুতে প্রণীত সেক্যুলার সংবিধানের (১৯৭২) মাধ্যমে এর পরিচয় হয়ে ওঠে ভাষিক জাতিরাষ্ট্রে। অবশ্য ক্ষুদ্র আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলোকে স্বীকৃতি না দিয়ে। পূর্বোক্ত দুই চেতনার সমন্বয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের ছোটখাটো দেশটির পক্ষে যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল যথার্থ সেক্যুলার গণতন্ত্রী জাতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার।
কিন্তু প্রগতিশীলতার পথে এর রাজনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত না হওয়ায় এবং পাকিস্তানি রাজনীতির সাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকে সমাজ পুরোপুরি মুক্ত হতে না পারার কারণে বাংলাদেশের পক্ষে পূর্বোক্ত গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রের চরিত্র অর্জন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দেশটিতে এবং এর শাসনব্যবস্থায় বিপুল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও থেকে থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা এর সেক্যুলার চরিত্রে আঘাত করতে থাকে।
অন্যদিকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এর শ্রেণি শাসনের দল-নির্বিশেষ প্রাধান্য। ‘প্রাধান্য’ না বলে এককতা বলাই সংগত। পাকিস্তানি শাসনামলে সম্প্রদায়বাদী শ্রেণি শাসনের প্রবলতা একই রকম থেকেছে। যে শাসন উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান সামন্তবাদী শ্রেণির। সঙ্গে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনার মিশ্রণ, যে জন্য তার সাংবিধানিক পরিণতি ইসলামী প্রজাতন্ত্রে।
এ শাসন স্বল্পস্থায়ী—প্রায় আড়াই দশকের হলেও এর আত্মিক প্রভাব থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্ত হতে পারেনি। এ অক্ষমতা দুঃখজনক বা দুর্ভাগ্যজনক হলেও এর বাস্তবতা অস্বীকার করা কঠিন। কারণ এর পেছনে রয়েছে অবিভক্ত ভারতে বিরাজমান সম্প্রদায়বাদী, ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতির প্রবলতা, যা মূলত ১৯৪০-এর অবৈজ্ঞানিক দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক লাহোর প্রস্তাবের রাজনৈতিক পরিণাম।
এমন এক রাজনৈতিক মতাদর্শের তীব্র প্রচার স্বল্পকালীন হলেও বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তাগত ধ্যানধারণাকে বিভ্রান্ত করেছিল। বাঙালি মুসলমানের ক্ষেত্রে কারণটা শুধুই ধর্মীয় চরিত্রের ছিল না। এর পেছনে বড় কারণ ছিল যুক্তবঙ্গের দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রকট আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, সেই সঙ্গে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উচ্চম্মন্যতা-হীনম্মন্যতার দ্বন্দ্ব।
এ দ্বন্দ্বের কারণে বাঙালি মুসলমান গণতন্ত্র ও প্রগতিশীল মতাদর্শের পরিবর্তে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদী পথে প্রতিযোগিতাহীন আত্ম-উন্নয়নের স্বনির্ভরতাকে সঠিক পথ বিবেচনা করে ভারত ভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন তাকে প্রতারিত করে, যে জন্য একাত্তরে এসে নব্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, যে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে।
তিন.
একুশের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তব ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটা এবং এর অনুরূপ সাংবিধানিক পরিচয় সত্ত্বেও শাসনযন্ত্রের প্রকাশ ঘটে ভিন্ন ধারায়। একুশের যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সমাজে, সংস্কৃতিতে, অংশত রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, তার বাস্তবায়ন ঘটেনি শাসনব্যবস্থায়।
দুই দুটো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উপপ্লব ঘটার পরও কেন এই পিছুটান—এর কার্যকারণ নিয়ে বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে ভাবিত হতে বড় একটা দেখা যায় না। যা ঘটেছে তার বিরুদ্ধে তাঁদের কোনো প্রতিবাদ নেই, বিচার-বিশ্লেষণের আগ্রহ নেই। এর দায়টা তো পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক-বাহক শ্রেণির, যারা একাধিক দলের তকমায় দেশ শাসন করছে।
এই শ্রেণিতে রয়েছে নানা ঘরানার পেশাজীবী (সামরিক ও বেসামরিক), সেই সঙ্গে বৃহৎ ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি, বিশদ বিচারে শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী এবং অনুরূপ উপশ্রেণি। এদের শক্তির উৎস এদের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনীতিবিদ শাসকশ্রেণি। এদের হাতে রাষ্ট্রিক শক্তির দড়িদড়া। এদের পেছনে রয়েছে পূর্বোক্ত উপশ্রেণি, বিশেষ করে বৃহৎ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।
আইন প্রণয়ন, আইনের শাসন ও বাস্তবায়ন—সব কিছুই চলে এদের স্বার্থসিদ্ধির ধারায়। রবীন্দ্রনাথ একসময় তির্যক ভঙ্গিতে অনেকটা এ রকম মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে শাসকশক্তির সঙ্গে বাণিজ্যিক শক্তির গান্ধর্ব বিয়ে ঘটে গেছে। ফলে যে অসমতার ও বৈষম্যের সৃষ্টি, তা ঘুচাতে সামনে রয়েছে এক ধরনের লড়াই—কবির ভাষায় ‘বৈশ্যে-শূদ্রে, মহাজনে-মজুরে’।
আধাপ্রতীকী ভাষায় হলেও কথাগুলো প্রগতি রাজনীতির মতাদর্শ ও মর্মবস্তুর সঙ্গে মেলে। এককথায় বিশেষ সুবিধাবাদী শ্রেণির শাসন থেকে মুক্তি বা তার পরিবর্তন ঘটাতে দরকার শ্রেণিসংগ্রাম। একুশ থেকে একাত্তর হয়ে শ্রেণি বিশেষের স্বার্থে যে শক্তিমান শাসনব্যবস্থার উদ্ভব, তার মাধ্যমে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ গণতন্ত্রী-প্রজাতন্ত্রী চরিত্রের জাতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার বদলে উল্লিখিত শ্রেণি বিশেষের শ্রেণিরাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এটা সাধারণ মানুষের এবং সচেতন বুদ্ধিজীবীদের আকাঙ্ক্ষিত না হলেও এমনটিই ছিল রাজনৈতিক বাস্তবতা। কারণ মুক্তিযুদ্ধ নামের লড়াইটি বিভিন্ন শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত হলেও যুদ্ধের রাজনৈতিক চালিকাশক্তি ছিল মধ্যবিত্তপ্রধান শিক্ষিত শ্রেণির রাজনৈতিক দল, যাদের পেছনে সমর্থন রয়েছে পূর্বোক্ত পেশাজীবী উপশ্রেণির।
রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতির সাধারণ নিয়ম বলে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন ঘটাতে যে শক্তিমান শ্রেণি মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তারা যদি জনবান্ধব চরিত্রের না হয়, তাহলে নব্য রাষ্ট্রে তাদের শ্রেণিশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের আর্থ-সামাজিক স্বার্থপূরণে দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক শাসন ওই ইতিহাস নির্ধারিত পথ ধরেই চলেছে।
এ পথচলায় ছিল পাকিস্তানি শাসনের প্রেতচ্ছায়ার প্রভাব। শুরুতে শ্রেণিস্বার্থবাদী শাসন, পরে দুই জেনারেলের সামরিক ও কথিত বেসামরিক স্বৈরশাসন এবং বাহাত্তরের সেক্যুলার সংবিধানের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদী ধারায় পরিবর্তন। দ্বিতীয়জনের কূটচাতুর্যে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আরোপিত। প্রথম সংবিধানের যথেচ্ছ কাটাকুটি, সেখান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিদায়, পরিবর্তে সংযোজন সামাজিক ন্যায়বিচার। যে ন্যায়বিচারের দেখা মেলেনি। বরং একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসনই প্রধান হয়ে ওঠে। বিচারিক ন্যায়নীতির চরম বরখেলাপের কুখ্যাত উদাহরণ পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরকে গোপন একদেশদর্শী বিচারে ফাঁসিতে হত্যা। এমন বহু ঘটনায় জিয়াউর রহমানের শাসনকালে অন্ধকার কেঁপে কেঁপে উঠেছে অসহায় আর্তনাদে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কি ব্যতিক্রম? অন্তত আরেক মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার মঞ্জুর হত্যায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে এখনো মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ওঠে। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো, মঞ্জুর হত্যার সঠিক তদন্ত, আসল অপরাধী শনাক্তকরণ ও সঠিক বিচারিক শাস্তি—কোনোটিই সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে এ ধরনের নৈরাজ্যিক ঘটনা অনেক ঘটেছে। ক্বচিৎ কোনোটির বিচার হয়েছে—সঠিক বা বেঠিক। তবে বেশি ভাগেরই সুবিচার হয়নি।
সে জন্যই বলছিলাম, স্বাধীন বাংলাদেশে নামেই একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে গর্ব ও অহংকার বক্তৃতা-বিবৃতিতে, ভাষণে। ওই দুটোই নির্বাসিত শাসনব্যবস্থা থেকে। বলছিলাম, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় পাকিস্তানি শাসনের প্রেতচ্ছায়ার কথা। মিলটা বড় বেশি প্রকট। সামরিক শাসন, বেসামরিক স্বৈরশাসনেরই প্রাধান্য লক্ষ করার মতো।
অথচ পঞ্চাশে ভাষিক আবেগের প্রবলতায়, ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী আবেগের ব্যাপকতায় যে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক চেতনার আপাত-প্রকাশ ঘটেছিল, তার অবসান ঘটতে বেশি সময় লাগেনি। তাই এখন প্রশ্ন—ওই বাঙালি জাতীয়তাবোধ কতটা নিখাদ ছিল, ছিল কতটা আবেগ-উচ্ছ্বাসের ওপরতলীয় প্রকাশ। চেতনায় এর দাগকাটা অবস্থান ছিল কতটা গভীর?
বর্তমান রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি নানা ঘটনার মাধ্যমে বিপরীত দিকটাই তুলে ধরছে। একুশের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে প্রতিফলিত হয়নি। পরিণামে সমাজে ঔপনিবেশিক রাজভাষা ইংরেজি ও রাজভাষা সংস্কৃতির ব্যাপক প্রকাশ বুঝিয়ে দিচ্ছে বাংলা ভাষার পিছু হটার বাস্তবতা। মাতৃভাষা বাংলার অবস্থান সমাজে প্রথম নয়, দ্বিতীয় স্থানে। বাংলা চর্চার প্রতি অবহেলাও খুব স্পষ্ট। ইংরেজি-বাংলার দু-আঁশলা কথকতা বাংলাবিষয়ক হীনম্মন্যতার প্রতিফলন বলা চলে।
এসবের দায় শিক্ষিত শ্রেণির, তাদের নানা ধারার পেশাজীবী শ্রেণির বাংলা সম্পর্কিত মানসিক দীনতার। অন্যদিকে সংবিধানের বিপরীতে শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাকে ঠেকিয়ে রাখায় ওই একই মানসিকতার প্রকাশ। শাসক এই শ্রেণিটির সদিচ্ছার অভাব, বিদেশি রাজভাষার প্রতি একান্ত অনুরাগ জাতীয় পর্যায়ে এবং জীবিকার খাত থেকে বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে হটানোর জন্য দায়ী।
তাই দফায় দফায় বিভিন্ন সময়ে ভাষা সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে রক্ত ঝরানো অর্জন সত্ত্বেও বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। বাস্তবে তা হয়ে উঠেছে শিক্ষিত সমাজের, সুবিধাবাদী-সুবিধাভোগী সমাজের স্বার্থবাহী শ্রেণিরাষ্ট্র। জনবান্ধব ও নিম্নবর্গীয়দের স্বার্থপূরণের রাষ্ট্র তো নয়ই, ত্রিধাবিভক্ত উপমহাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে হয়ে উঠেছে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদী সুবিধাভোগীর শ্রেণিরাষ্ট্র। (কালের কণ্ঠ)
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী