বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

প্রশ্নপত্র ফাঁস : প্রতিরোধ অসম্ভব নয়

প্রশ্নপত্র ফাঁস : প্রতিরোধ অসম্ভব নয়

মুহাম্মদ মুসা খান, ১৫ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভালবাসা দিবস। সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল বসন্ত বরণের বর্ণিল ছবি আর ভালবাসার কথামালা। পাশাপাশি ছাপানো আরেকটি সংবাদের সাথে একটি ‘ছবি’ সব পাঠকের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। সেটা হলো, শিক্ষার্থী ভর্তি একটি বাসে হানা দিয়ে পুলিশ কর্তৃক চট্টগ্রামের এক স্কুলের ৫৪ জন ছাত্র–ছাত্রীকে আটকের পর ‘ফাঁসকৃত প্রশ্ন দেখার’ অভিযোগে ২৪ জনকে জেলা প্রশাসক মহোদয় বহিষ্কার করেছেন। আর পুলিশী পাহাড়ায় বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের মাথা নীচু করা ‘ছবি’ যেন পুরো জাতির লজ্জায় মাথা নীচু করার প্রতিচ্ছবি। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ফাঁসকৃত প্রশ্ন পেয়ে যখন খুশীতে বাকবাকুম করছিল, ঠিক তখনই পুলিশ হানা দেয়। প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীদের যেভাবে বহিষ্কার বা গ্রেফতার করা হলো, তাতে তাঁদের দায়–দায়িত্ব কতটুকু? হ্যাঁ ফাঁস করা প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দেয়া আদৌ সমর্থন যোগ্য নয়, বরং অনৈতিক। কিন্তু সারাদেশে যখন প্রশ্ন ফাঁস হয়, তখন শিক্ষার্থীরা চুপ করে বসে থাকবে, সে যুক্তিও কি অযৌক্তিক নয়? মূল হোতাদের গ্রেফতারের ব্যর্থতার দায় কি শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করে পুষিয়ে নেয়া হচ্ছে? এত প্রশ্ন ফাঁসের খবরের প্রমাণ পাওয়ার পরও এই পরীক্ষা (পদার্থ বিজ্ঞান) বাতিল করা হচ্ছে না কেন? বা পুরো এস.এস.সি পরীক্ষাই বাতিল করা হচ্ছে না কেন?

এ প্রসংগে এমিরেটস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কয়েকটি কথা এখানে তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতাদের শাস্তি হচ্ছে না বলেই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের গোয়েন্দারা দক্ষ, দুর্ধর্ষ জঙ্গীদের ধরে ফেলেন, ফেসবুকে কেউ যদি কেনো আপত্তিকর মন্তব্য করেন, তাকে ত্বরিত গতিতে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসেন। তাহলে এক্ষেত্রে (প্রশ্ন ফাঁসের ক্ষেত্রে) কেন হচ্ছে না? আসলে এখন দুর্নীতি সমাজের সর্বত্র প্রবেশ করেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস তার থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমি মনে করি না এটা কোন অসম্ভব (ফাঁস রোধ) কাজ’। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এই মন্তব্যকে অস্বীকার করার কোন উপায় আছে বলে মনে হয় না।

একটু সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে, বর্তমান সময়ের ”টক অব দ্যা কান্ট্রি” হচ্ছে ‘এস.এস.সি” পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। ইন্টারনেট বন্ধ বা শ্লথগতি, পরীক্ষার কেন্দ্রের ২০০ গজের মধ্যে স্মার্ট ফোন বহন নিষিদ্ধ, ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা, ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করা ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণের পরও প্রশ্ন ফাঁস হয়েই যাচ্ছে। মূলত এসব ব্যবস্থা ফাঁসকৃত প্রশ্নের সংবাদের প্রচার কমাতে পারে মাত্র, ফাঁস প্রতিরোধ বা বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ নয়। আমাদের সময়ে বা কয়েকবছর আগেও পরীক্ষার আগের রাতে পরীক্ষার্থীরা দ্রুত ঘুমাতে যেতো পরের দিন ভাল ভাবে পরীক্ষা দেয়ার জন্য। আর এখন পরীক্ষার্থীরা রাত জাগছে (কোন কোন অভিভাবকসহ) ফেসবুক বা ওয়াটসআপ হতে ফাঁসকৃত প্রশ্ন বা প্রশ্নোত্তর সংগ্রহ করার জন্য।

প্রশ্ন ফাঁসকারিদের ‘চ্যালেঞ্জ’ বা ‘ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁসের’ এই চিত্র দেখে পুরো দেশবাসী হতবাক। গুটি কয়েক প্রশ্ন ফাঁসকারি দুষ্কৃতকারীদের কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষাবোর্ড, প্রশাসন, আইন শৃংখলা বাহিনী সম্পূর্ণ অসহায়। এদের অসহায়ত্ব আমাদেরকে হতাশ করেছে, আমরাও বাকরুৃদ্ধ হয়ে পড়েছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রশ্ন ফাঁস প্রতিরোধ করা সত্যিই কি অসম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে একটু পরে আসছি। প্রথমে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করছি।

২০১৪ সনে দক্ষিণ কোরিয়াতে একটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে প্রশ্নের ক্রমিক নং ভুল হওয়াতে এর দায় মাথায় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। কয়েক মাস আগে জাপানে একটি বুলেট ট্রেন এক মিনিট আগে প্লাটফর্ম ছেড়ে গিয়েছিল বলে সে দেশের রেলমন্ত্রী মাথানত করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। আমাদের দেশে কোন ভুলের জন্য কোন মন্ত্রীর বা দায়িত্বশীল ব্যক্তির পদত্যাগের নজির খুব একটা নেই। বরং খুনের মামলার আসামির আত্মীয় হলেও মন্ত্রী সভা হতে পদত্যাগ না করার নজির আমরা দেখেছি। আবার ব্যাংক ধ্বংস করার পরও অনেকের গায়ে আচড়ও লাগে না, তাঁরা সংসদে স্পীকারের প্রোটেকশন চায়। এসব কথা বলা বাহুল্য। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড.আতিউর রহমান সামান্য ব্যতিক্রম ছিল। এই ব্যতিক্রমের কারণ অবশ্য জানা যায়নি। আজকের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাবলী আমাদেরকে এসব কথা মনে করিয়ে দেয়। আজ যদি শিক্ষামন্ত্রী বা দায়িত্বশীল কেউ প্রশ্ন ফাঁস রোধে ব্যর্থতার কারণে পদত্যাগ করতেন তাহলে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতো। এই প্রত্যাশা অবশ্য আমাদের দেশের সংস্কৃতির সাথে বেমানান।

যাক সে কথা। বরং শুরুতে যে প্রশ্ন করেছিলাম (প্রশ্ন রোধ করা কি অসম্ভব?) সেটার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। ছোট্ট উত্তর হলো, ‘প্রশ্ন ফাঁস প্রতিরোধ করা অবশ্যই সম্ভব’। অবশ্য যদি সদিচ্ছা থাকে এবং কার্যকর উদোগ নেয়া হয়। পূর্বেই বলা হয়েছে, যে সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সেগুলো ‘ফাঁস প্রতিরোধ’ মূলক নয়। শুধুমাত্র ‘প্রচার প্রতিরোধমূলক’। এই ব্যবস্থায় কেয়ামতের আগে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে না। কারণ প্রশ্ন ফাঁসের সাথে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা–কর্মচারী যারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও ছাপানোর সাথে সংশ্লিষ্ট, তাঁদের কেউ না কেউ জড়িত,-যা সহজে বুঝা যায়। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাঁদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, বড় অংকের লেনদেনের মাধ্যমে প্রশ্ন প্রণয়ন ও মুদ্রণের সময়েই প্রশ্ন বেচাকেনা হয়। কিন্তু তখন তা গোপন রাখা হয়। যাতে বিষয়টি জানাজানি না হয়। সর্বশেষ পরীক্ষার আগের দিন নগদ ইনকামের জন্য দ্বিতীয় বারের মত প্রশ্ন বিক্রি শুরু হয়। সুতরাং সর্ষে ভূত রেখে যতই তর্জন–গর্জন করা হোক না কেন প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব হবে না।

আমাদের সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের যে সূচনা হয়েছে, সেটার একটি উদাহরণ এই প্রশ্ন ফাঁস (যা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্যেও উঠে এসেছে)। এই নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য আদর্শহীন রাজনীতিও কিন্তু কম দায়ী নয়। স্বাধীনতা পূর্বকালের রাজনীতির লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন। আর স্বাধীনতাত্তোর রাজনীতির লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ‘ ক্ষমতা ও টাকা’। এখন সবারই লক্ষ্য শর্টকাট পথে টাকা রোজগার করা। চাকরি, ব্যবসা, রাজনীতি–সবখানেই এই লক্ষ্য অর্জনের পেছনে সবাই ছুটছে। নীতি–নৈতিকতা, জ্ঞানার্জন, সামাজিক দায়বদ্ধতা, দায়িত্ববোধ, দেশ প্রেম–এসব সুবচন আজ নির্বাসনে চলে গেছে। এসবের স্থান দখল করেছে, দুর্নীতি, অনৈতিকতা, দাম্ভিকতা, চোখ রাঙানো, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি বিষয়। মূলতঃ প্রশ্ন ফাঁসও এই অনৈতিকতার জয়। একজন অভিভাবক যখন মোবাইল খুলে তাঁর সন্তানকে ফাঁসকৃত প্রশ্ন খুঁজে দেয়, সে জাতির ভবিষ্যত যে অন্ধকার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যে শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ–৫ পাবে, সে যে সারা জীবন চুরি–চামারি করে কেটে কাটাবে–তা তো নতুন করে বলতে হয় না। তাছাড়া সে ডাক্তার হয়ে যে মানুষ মারবে না, তার কি গ্যারান্টি আছে! অবশ্য শিক্ষার্থী–অভিভাবকদের চেয়ে প্রশ্ন ফাঁসকারিদের দোষ যে ১০০ গুণ বেশী তা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সেই মূল দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রশ্ন ফাঁস রোধে ব্যর্থ হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক কোচিং সেন্টার বন্ধ করা ও এম.সি.কিউ প্রশ্ন তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরপরও যে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে, সে নিশ্চয়তাও পাওয়া যাবে না। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে শ্রেণী শিক্ষাতে অনেক গলদ থাকায় (এক শ্রেণীতে ১০০ জন শিক্ষার্থীও আছে) কোচিং সেন্টার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই কোচিং সেন্টারের শিক্ষা শিক্ষার্থীকে অনেক সমৃদ্ধ করে, যা অস্বীকার করার উপায় নাই। তাই কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দিলে শিক্ষার মান আরও দুর্বল হবে। এদিকে এমসিকিউ প্রশ্ন তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তও অযৌক্তিক। কারণ ১৯৯২ সন হতে এই পদ্ধতি চলে আসছে। এই পদ্ধতি বাদ দেয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট কিছুটা হলেও খারাপ হবে। কারণ ০৩ ঘণ্টায় ১০টি সৃজনশীল (অতিরিক্ত ০৩টি সহ) লেখা শিক্ষার্থীদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে না। এমসিকিউ বাদ দেয়ার সময় এসব বিষয় অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। প্রশ্ন ফাঁস রোধের ব্যর্থতা যেন শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে গিয়ে না পড়ে।

বলছিলাম প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা অবশ্যই সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাবোর্ড সমূহের আন্তরিকতা। প্রশ্ন প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়াটিও যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে কোন ধাপ হতে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, তা চিহ্নিত করা যাবে। যে ধাপে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে সে ধাপের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। সেখানে মোবাইল ফোনের ব্যবহার ১০০% বন্ধ করতে হবে। যাঁরা প্রশ্নপত্র প্রনয়ন ও ছাপানোর সাথে যুক্ত তাঁরা যতক্ষণ এই দায়িত্ব পালন করবেন, ততক্ষন তাঁরা মোবাইল ফোনের সংস্পর্শে থাকবেন না। তাহলে ফাঁসের সম্ভাবনাও থাকবে না। যদি মনে করা হয় যে, তবুও প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা সম্ভব হবে না, তাহলে পুরো দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া যায়। সেনাবাহিনী অদ্যাবধি দুর্নীতিমুক্ত থেকে অনেক কাজ করেছে। জাতীয় পরিচয় পত্র প্রনয়নে তাঁরা ১০০ ভাগ সফল হয়েছে। সুতরাং আশা করা যায়, সেনাবাহিনী এই কাজটাও সফল ভাবে করতে পারবে। বলতে গেলে বর্তমান এস.এস.সি পরীক্ষার সবগুলো প্রশ্নই ফাঁস হয়েছে। তাই সব পরীক্ষা বাতিল করে, নতুন করে পরীক্ষা নেয়া প্রয়োজন বলেও অনেকে মনে করেন। আর যদি নতুন করে পরীক্ষা নেয়া না হয়, তাহলে পূর্বের ন্যায় সরকারি ও স্বনামধন্য কলেজ সমূহে পুনরায় ”ভর্তি পরীক্ষা” চালু করা উচিত। অন্যথায় ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখে জিপিএ–৫ পেয়ে অনেক অযোগ্য ছাত্র–ছাত্রী ভাল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে।

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যে কোন মূল্যে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতেই হবে। অন্যথায় শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।

লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত