বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

বিভাগোত্তর বাংলা কবিতায় আধুনিকতার রূপকার

বিভাগোত্তর বাংলা কবিতায় আধুনিকতার রূপকার

শিবলু শফি, ১৬ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : পূর্ব প্রকাশিতের পর

আবার ১৯৭১ পরবর্তী ৭০রের দশকও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাসের প্রথম দশক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ববহ । নব্য ভুমিষ্ঠ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রার সাক্ষ্য হিসেবে এই সময়ে বা দশকে রচিত কাব্যকার ও তাঁদের রচিত কবিতা সাহিত্যাবলী, জন্ম পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রার ইতিহাসের সাথে অভিনব সব দিক্‌দর্শনে ওতপ্রোত ভূমিকা রাখে । এ চরম যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তাক্ত আত্ম–বলিদান ও লক্ষ লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানির বিভীষিকাময় গনগনে দগদগে ক্ষত আর সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত এ রাষ্ট্রের কাব্য ও সাহিত্যে কবি,শিল্পী ও সাহিত্যিকদের অসম্ভব ও অপ্রতিরোধ্য অনুপ্রেরণায় ঘুরে দাঁড়ানোর কাব্যিক অনুশীলন এই দশকে আরো নতুন মাত্রা যোগ করে। এই দশকে অন্যতম কবিরা হলেন “রফিক আজাদ-“অসম্ভবের পায়ে” (১৯৭৩), “সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজ”-(১৯৭৪); হুমায়ন আজাদ– “অলৌকিক ইস্টিমার”-(১৯৭২); দাউদ হায়দার– “জন্মই আমার আজন্ম পাপ”-(১৯৭৩); নির্মলেন্দু গুণ– “প্রেমাংশুর রক্ত চাই”-(১৯৭০), “না প্রেমিক না বিপ্লবী”– (১৯৭২), “অমীমাংসিত রমণী”-(১৯৭৩); মোহাম্মদ রফিক-“বৈশাখী পূর্ণিমা”-(১৯৭০); হুমায়ুন কবির– “কুসুমিত ইস্পাত”-(১৯৭২); ফরহাদ মাজহার ু“খোকন ও তার প্রতিপুরুষ”-(১৯৭২) ইত্যাদি মোটামুটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ধরে নেয়া যায় । তবে স্বাধীনতার পরবর্তী ৭০’রের দশকের শুরুর দিকে জসীম উদ্দীন থেকে একটু ভিন্ন পথ ধরে পূর্ববঙ্গের গ্রাম বাংলার বাঙালি ও মুসলমান মধ্যবিত্তের নিবিড় জীবনাচর্যা ও যাত্রাকে ঘিরে কবি আল মাহমুদ ভিন্ন প্রসাদ ও ধারার ব্যতিক্রমি কিছু কাব্যিক সুর আনয়নের প্রচেষ্টা চালান; আঞ্চলিক শব্দের নানামুখী ব্যবহার ও নিরীক্ষায় সেই সুর অভিনবত্ব অর্জন করে ১৯৭৩ “সোনালী কাবিন” নামক কাব্যগ্রন্থে। তবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে “সোনালী কাবিন” কাব্যকলার পরবর্তীতে দেখা যায় তিনি ঐ ৪৭’এর গোলাম মোস্তফা কিংবা ফররুখ আহমেদের পাক–কেন্দ্রিক ইসলাম জাতীয়তা ও ধর্মীয় ভাবাবেগের মিশেলে অনেকটা ছদ্মবেশি ও জটিল আরেকটি ধারা বাংলাদেশের কাব্য–জগতে পরিপুষ্টায়নে সচেষ্ট হয়ে উঠেন। প্রকারান্তরে সেটাও ফররুখ আহমেদ’দের সেই ধর্মীয় ভাবাবেগাপন্ন কাব্য–চর্চার আরেকটু ভিন্ন আদলের জটিল ও ছদ্মবেশি আধুনিক সংস্করণেরই অন্যতম উত্তরসূরী হলেন কবি আল মাহমুদ । স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য চর্চার আধুনিক প্ল্যাটফর্মে এসেও তিনি কবিতা ও সাহিত্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় ভাবাবেগ’কে পুঁজি করার পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধী পক্ষের মদদপুষ্ট ও ছদ্মবেশি জাল– রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীকে তথাকথিত নব্য গণতান্ত্রিক আলখাল্লায় পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জনে সচেষ্ট হন ।

’৬০ ও ’৭০ উভয় দশকের যে সকল কবিদের প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতি ও

ইতিহাসের প্যারালাল উপাত্ত হিসেবে তুলে আনা হয়েছে ; তা অবশ্য এখানে কারো কারো ক্ষেত্রে প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে একেবারে উঁচু দরের কাব্যশিল্প বা মাইলফলক না হলেও পরবর্তী বেশ কিছু দশক জুড়ে এসকল কবিরাই বলতে গেলে প্রায় বর্তমানকাল পর্যন্ত কবিতা ও সাহিত্যের নানান শাখায় ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি দোর্দণ্ড প্রতাপে আমাদের বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে নিন্দিত কিংবা নন্দিতভাবে প্রতিষ্ঠিত ও অনুসরণীয় বাতিঘর ও একইসাথে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের কাব্য ও সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের প্রথম প্রজন্ম। আর শামসুর রাহমান বাংলাদেশের আধুনিক কাব্য সাহিত্য চর্চায় এই প্রথম প্রজন্মের সবচেয়ে জোরালো প্রতিনিধিত্বমূলক এক ক্ষণজন্মা কবি। এই ক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমান’কে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনার অন্যতম কারণ হচ্ছে– বাংলাদেশ স্বাধীনের পূর্বের বা মুক্তিযুদ্ধের পটভূমী সৃষ্টির প্রাক ৬০’–এর দশকে তিনি যেমন নাগরিক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের বহুরৈখিক আলোকে তাঁর কবিতার চেতনা,মনন ও অস্তিত্বে ওতপ্রোতভাবে দেশকে ধারণ করেছিলেন তেমনি দেশ স্বাধীনের পরবর্তী ৭০’ দশকসহ অন্য দশকগুলোতেও পুরো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শৈশব–কৈশোর বা যৌবন কালের পথ চলার ইতি ও নেতি সার্বিক ভাইব্রেশন’টিকে তিনি অত্যন্ত প্রখর ও স্বকীয়ভাবে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

যাহোক ১৯৬৮ সালে “নিরালোক দিব্যরথ” ৬৯’–রের গণ অভ্যুত্থান প্রেক্ষাপটের ঠিক আগের বছরে প্রকাশিত একটি কাব্যগ্রন্থ । এরপর ১৯৭০– এ “নিজ বাসভূমে”, ১৯৭২–এ “বন্দী শিবির থেকে”, ১৯৭৩–এ “দুঃসময়ে মুখোমুখি”, ১৯৭৪–এ “ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা” ইত্যাদি কাব্য গ্রন্থগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে; শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে পুরো পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর নেমে আসা ভয়াল বাস্তবতার মনশ্চিত্র কিভাবে এঁকে গেছেন তার কবিতায় । একইসাথে তার কবিতায় বুনে গেছেন উপনিবেশ উত্তর বাংলাদেশের আগামীর সুবর্ণকল্প । ’৭১–রের ঢাকা নগরী সম্পর্কে কবি নিজে তার “বন্দী শিবির থেকে” কাব্যের পূর্বলেখাতে উল্লেখ করেছিলেন“তখন ঢাকা এক কনসেট্রেশন ক্যাম্প । সুদীর্ঘ ন’মাস আমরা যে পরিবেশে বাস করেছি তাকে কাফকার জগৎ বললে কিছুই বলা হয় না । উৎপীড়ন, হত্যা এবং সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে রচনা করেছিলো এক ভয়ংকর তমসাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় পটভূমি, আমরা তৃষিত হয়ে পড়েছিলাম একঝলক আলোর জন্যে । নীরন্ধ্র শ্বাসরোধকারী সেলের ভেতর বন্দী যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে এক ফোঁটা আলোর জন্যে, ঠিক তেমনি আমরা প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় করতাম। “ ৭১’–রের এপ্রিলেই রচিত হয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার সেই কিংবদন্তীতুল্য কবিতাদ্বয়– “স্বাধীনতা তুমি”, ও “তোমার জন্যে হে স্বাধীনতা” । এদিক থেকে বলতে গেলে শামসুর রাহমানের কবিতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের পৌনঃপুনিক সম্পর্ক নির্মিত হয়ে গিয়েছিল । এ সময়ের কাব্য ও কবিতাগুলো যেমন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী এক নান্দনিক কীর্তি/কৃর্তি, তেমনি মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে বিনির্মাণের এক সোনালী গাথা ।

এছাড়া শামসুর রাহমানের কবিতার স্বতন্ত্র কলা–প্রকৌশল, চিত্রকল্পের শাণিত ব্যঞ্জনা, ভাব ও ভাষার নৈসর্গীক বিপন্নতার সাথে সমকালের ৩ পরিভাষাকে রূপান্তর ও বুনে দেওয়ার এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা, সহজাতভাবেই বাংলার সর্ব শ্রেণির পাঠকের মননে আর চেতনায় তিনি প্রধান কবির আসনটি পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন ।

এর দ্বিতীয় অর্থাৎ বাংলাদেশ পর্বে এসে শামসুর রাহমানের কবিতায় দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে আরেক বিপন্ন ও জটিলতর আস্তিত্বিক বাস্তবতা এবং সংগ্রাম । ঊপনিবেশ উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পরও বাঙালির জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবার পূর্বেই ৭৫’–এ জাতির জনকের সপরিবার হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চার নেতা হত্যা, সামরিক স্বৈরাচারের প্রবলোত্থান, বিকৃত গণতন্ত্র, চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ মৌলবাদের উত্থানসহ স্বাধীনতার শত্রুদের ক্ষমতার রাজনীতিতে বিভীষিকাময় পদার্পণ, সদ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভবিষ্যতকে আরো অন্ধকারে ছুড়ে দেওয়া হলো । সত্যিকার অর্থে ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বৈরি রাজনৈতিক বাস্তবতা ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক বাস্তবতার চেয়ে আরো বেশি ছদ্মবেশি ও জটিল হয়ে উঠলো। আর কবি শামসুর রাহমানই সম্ভবত এই নব্য ও কূট ক্রীড়ানক উপনিবেশোত্তর বাস্তবতার শিকার সকল শ্রেণির দ্রোহ, দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ, ধিক্কার ও ঘৃণাকে তার কবিতা থেকে কবিতা পরম্পরায় তথ্যচিত্রের মতো ধারণপূর্বক গণমানস’কে উজ্জীবিত করে তোলে। এক্ষেত্রে শুরুর দিককার অন্তর্ব্যক্তিক চেতনা এ কবির কবিতা ও কাব্য পরিক্রমা ধীরে ধীরে এক সমষ্টিগত মানস–চেতনার রুদ্র তরঙ্গে উদ্বেলিত হয়েছে, শামসুর রাহমানের কবিতা মৌলবাদ ও স্বৈরাচার বিরোধী গণ মানসের হাত ধরে মিছিল, মিটিং– এ গণ আন্দোলনের মানস–মশাল হয়ে রাজপথে নেমে আসে । পরবর্তী’তে ’৯০–এর স্বৈরাচার বিরোধী গণ আন্দোলনেও শামসুর রাহমানের কবিতা আরো শাণিত ভূমিকা পালনে সমর্থ হয় । এই নব্য উপনিবেশোত্তর বাস্তবতার মুখোমুখি সাংঘর্ষিক চাতালে কবির কাব্য জৌলুষ এক সামষ্টিক সাম্যবৃত্তির সত্যকল্প হয়ে এগিয়েছে । তার কবিতায় একাধারে ক্রান্তিকালিক আবহ যেমন: নৈরাজ্য, নাস্তিকতা, বিচ্ছিন্নতা ও ঘোর দ্বান্দ্বিক তমসাচ্ছন্নতাসহ সংবেদনশীল রোমান্টিক সৌন্দর্য যেমনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছিল তেমনি প্রেরণাসংকুল আগামীর স্বপ্নকল্পও ; আবার নব্য এ উপনিবেশোত্তর ঘোর বৃত্তায়িত ও বিপন্নতা বিরোধী কাব্য চেতনার স্ফূরণসহ তার কবিতায় আধুনিক বাঙালি সত্তার রূপান্তর তরঙ্গ সদা জাগরুক ।

বাংলা কবিতা চর্চায় যে প্রথাগত অর্গল ছিল শামসুর রাহমান তার প্রায় সব স্তরেই এক অদ্ভুত সৌন্দর্যশাসিত কাব্য–কাহন পৌনঃপুনিকতায় উন্মোচন করে দেন । অক্ষর বৃত্তের নিত্যনতুন মহিমায় তার বক্তব্যধর্মী কবিতার শব্দ, ভাষা ও ভাবের স্বকীয় সমীকরণ বাংলা কবিতার প্রথাগত আকার ভেঙে এক বৈচিত্র্যময় ও বহুমাত্রিক শরীর নির্মাণ করেছেন । বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় “একজন অতিপ্রজ কবি ‘– শামসুর রাহমান তার কাব্যলোক জুড়ে সমকালের ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতা, দুঃখ– হতাশা, নৈরাজ্য, নাস্তিকতা, সংস্কার, যৌনতা মত্ত নগরের জটিল মনস্তত্ত্ব ও রূপান্তরণকে আধুনিকতার সাথে এমনভাবে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন; যা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যেমনি নতুন তেমনি সংবেদনশীল সৌন্দর্য ও শিল্প প্রেরণাকল্পের বাতিঘর । এছাড়া উপমা, চিত্রকল্পের নান্দনিক ও সৃজনশীল প্রণোদনায় বাঙালির মুসলমানদের প্রথাগত কবিতা চর্চার দৌরাত্ম্যকে পিছু হটিয়ে নব রুচির বৈচিত্র্যময় কাব্যচর্চার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেন । বিশেষ করে বাংলা কবিতার এই আধুনিকতর মানস গঠন তৈরি হয়ে যাবার পর আর পেছনে ফিরে তাকাবার কোনো উপায় নেই । বলা যায় তিনি একই সাথে নিত্য নতুন কবিভাষা নির্মাণের পাশাপাশি পাঠকের সমকালীন রুচিকেও তৈরির মধ্য দিয়ে শান দিয়েছেন । তাঁর কবিতা একাধারে মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধকে শাণিত আর আধুনিক মানব মনস্তত্ত্বের যাবতীয় অনুভূতিকে নতুন কাব্য–বাঙ্‌ময়তায় মনন সংবেদনকে সদা জাগ্রত রাখার অকৃত্রিম তৎপরতায় মুখর; যদিও তা চরম বিচ্ছিন্ন নিঃঙ্গতার খরতাপে জ্বলছে । এছাড়াও শামসুর রাহমানের প্রথম দিককার কাব্যগ্রন্থগুলো যদিও পূর্ববঙ্গ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একেবারে গোড়া থেকে ওতপ্রোতভাবে বেড়ে উঠার মৌল–মন্ত্র হয়ে উঠেছে তথাপি সেইসব কাব্য ও কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের কাব্য সাহিত্যের বিচিত্র অন্তর্বৈভব প্রভাব বিস্তার করেছে ।

লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবি সম্পর্কে একটি মন্তব্যে লিখেছেন “ সারা জীবনেও আমি শামসুর রাহমানকে তার যুক্তিবাদী আদর্শ, ধর্মের উর্ধ্বে উঠে সমস্ত মানুষের সমান অধিকার ও বাংলা ভাষার মর্যাদার রক্ষার সামান্য বিচ্যুতির বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াবার অন্যথা দেখিনি ।“ রাষ্ট্র, রাজনীতি, সংগ্রাম, রক্তপাত,যুদ্ধের ভেতরও মানুষের চেতন প্রবৃত্তির মানবিক উত্থানই মুখ্য । মানবিক সম্পর্কগুলোর নিবিড় পরিচর্যাসহ সমকালীন অনুষঙ্গ, অনুভব,মনন, সংবেদনের বৈচিত্র্যময় সখ্যতায় তার কবিতার গভীর মনশ্চায়ন ও মানসপটে বিণির্মাণে করে চলেন । এভাবে ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব, দ্বন্দ্ব, বিচ্ছিন্নতা ও অভিঘাতি অন্তঃমনীষাকে জাতীয় বা রাষ্ট্রের মানস প্রতিচ্ছবিতে রূপান্তরের সরল পরিভাষা অর্জন করে । বাংলা কবিতার এই নতুনতর মানচিত্রের কাব্যভাষা বাঙালির ইতিহাস ও নাগরিক ঐতিহ্যের সমান্তরাল স্মারক হয়ে উঠে । স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বৈরতন্ত্র, ধর্মান্ধ মৌলবাদী বর্বরতা, নিপীড়ন ও দুঃশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও সার্বভৌমের মনুষ্যত্ব খোয়ানোর তীব্র অন্তর্জ্বালা ও গণবিক্ষোভকে পুঁজি করে শামসুর রাহমানের কবিতা দুর্লভ তেজোদীপ্ত বিভায় সর্বদা চাঙ্গা করে রাখে । এভাবে সমকালের সুতীক্ষ্ন রশ্মির নাটকীয় ব্যঞ্জনায় কবি বাংলা কবিতার খ্যাতিকে আরো অবিস্মরণীয় স্তরে পৌঁছে দেন ।

’৫০–এর দশকের শেষ দিক থেকে শামসুর রাহমানের কাব্য সুষমার বিস্তৃতি ঘটলেও আমৃত্যু তিনি কবিতা রচনা করে গেছেন । প্রায় অর্ধ শতক সময় ধরে আধুনিক বাংলা কবিতার অঙ্গন জুড়ে এ কবির নিরঙ্কুশ পদচারণায় মুখর ছিল । কবিতা ও কাব্য রচনার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের পর এমন সুবিদিত, সুবিস্তৃত ও ঐশ্বর্যশালী কবি আর নেই বললেই চলে। প্রায় পঁয়ষট্টির মতো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল তার । তবে অর্ধ শতাব্দী জুড়ে কবিতা লেখার কালকে দুটি ভাগে বিবেচনায় আনলে তার কবিতার মৌলিক রূপান্তর ও বিবর্তনের ধারাবহ খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রথমত (৪৭–৭১) দেশ বিভাগ পরবর্তী উপনিবেশ বাস্তবতায় বিভাজিত বাঙালির আত্মপরিচয় ও জাতিগত প্রতিষ্ঠার প্রথম চব্বিশ বছর এবং দ্বিতীয়ত (১৯৭১–২০০৬) স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ–সামাজিক চালচিত্র। এই বিশাল ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত কাব্যযাত্রার দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে দুই ভিন্ন প্রেক্ষাপটের চালচিত্র নিয়ে শামসুর রাহমানের কবিতা ও কবিসত্তা বাংলা কবিতার আধুনিকোত্তর বলয়ে নাগরিক ঐতিহ্য ও গৌরবের যেমন ধারক তেমনি সমকাল সম্পূরক মনো–সংবেদ কল্পের ধ্রুব ও ধাবমান স্মারক।

একটু পেছনে ফিরে এসে বলতে চাই, শামসুর রাহমানের ১৯৬০ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যের প্রথম– “রূপালী স্নান” কবিতাটি নানা কারণে আধুনিক বাংলা কবিতার অঙ্গনকে নতুন এক স্তরে উন্নীত করে। এটি আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার আগেই এটি তিরিশের মুখপত্র বুদ্ধদেব বসুর “কবিতা” পত্রিকায় হুবুহু ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়। সেই থেকে উভয় বাংলার কবিতার অঙ্গনে এই কালজয়ী কবিতা বিনির্মাতার উত্থান । বিষণ্নতা ও বিচ্ছিন্নতায় বিধ্বস্ত পরিব্রাজক কবি নাগরিক সময়ের বাস্তুতেই যেন এক তুচ্ছ উদ্বাস্তু প্রতিনিধি; বহির্জীবন ক্ষুদ্ধ এই কবিতা গাঁথায় –এক ধরনের আত্ম–থিসিস ও এন্টি–থিসিসের দ্বৈত সমীক্ষণে, মানবিক চেতনা ও বোধনের বিষণ্ন ছোবলে এক অপার্থিব রোমান্টিকতার জাগরণ ঘটায়। যা সমকালেরই অন্তর্মহল থেকে বিচ্যুত জীবনের সিনথেসিস’ বা সংশ্লেষণে মৃত্যুত্তোর জীবনে প্রবেশ করার সুতীব্র কল্প প্রবণতা নিয়ে “রূপালী স্নান” কবিতার পাললিক অন্তর্যাত্রা শুরু।

“শুধু দু’টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোঁজ “— ‘রূপালী স্নান’

হাজার বছরের ঐতিহ্য তথা মাছে ভাতে বাঙালিকে; কী এক ট্র্যাজিক ভোজের পদ্যে আমন্ত্রণ জানালেন ! কবির মনো বিশ্ব বস্তু ও বাস্তবতায় ঘেরা চৌহদ্দীতে এই ‘শুকনো রুটির’ ইঙ্গিত প্রথাগত বাংলা কবিতা চর্চার ধারাকে আমূল পাল্টে দেয়ারই ইঙ্গিত যেন। সুতীব্র মৃত্যুভারাতুর প্রকোষ্ট থেকে বিপন্নতা নিমগ্নী ভাষায় বলে উঠেন,

“সত্তাসূর্যে জেসাসের মা মেখে নিয়ে শুধু গড়ি উজ্জ্বল কথার মিছিল “

এভাবে ‘চোখের অতল হ্রদের আভায় ধূপছায়া মেখে’ কবি বোদলেয়ারীয় নরক’কেই যেন কাছে টানেন ৃ “হয়তো কখনো আমার ঠাণ্ডা মৃতদেহ ফের খুঁজে পাবে কেউ

শহরের কোনো নর্দমাতেই; – সেখানে নোংরা পিছল জলের

অগুণিত ঢেউ

খাবো কিছুকাল যদিও আমার দরজার কোণে অনেক বেনামি

প্রেত ঠোঁট চাটে সন্ধ্যায়, তবুও শান্ত রূপালি স্বর্গ– শিশিরে স্নান করি আমি।“

‘রূপালী স্নান’

এই পরাবাস্তব স্নান, মৃত্যুত্তর আগুন্তক এক নাগরিক জীবন বাস্তবতারই চলমান প্রতিধ্বনি নাকি বিচ্ছিন্ন ও আত্ম পরিচয়হীনতার বিপন্ন বৃত্তে নিমগ্ন জীবন উজ্জয়নী পাদ প্রদীপের সুবর্ণরেখা। যতো যাই হউক মৃত্যু বিভালোকিত এই ‘রূপালী স্নান’ কবিতাটি সমকালীন বাংলা কবিতার বিনির্মিয়মান আধুনিকোত্তর বলয়কে এক মহত্তর রূপালী স্নানে শুদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে । (সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত