আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ২০ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবং বিএনপির রাজনীতির মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। এটা অনেক সময় অনেকের নজরে পড়ে না। এই পার্থক্যটা হলো, আওয়ামী লীগের জন্ম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ দেশের এস্টাবলিশমেন্টের পূর্ণ সমর্থন দীর্ঘকাল পায়নি। ক্ষমতায় থাকার জন্য, ক্ষমতায় আসার জন্য মূলত তাকে জনসমর্থন ও জনগণের আন্দোলনের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির জন্ম একজন সামরিক শাসকের ইচ্ছায় ক্যান্টনমেন্টে। জন্ম থেকেই দীর্ঘকাল দলটি সামরিক ও অসামরিক এস্টাবলিশমেন্ট, এমনকি শহুরে এলিট ক্লাসেরও সমর্থন ভোগ করেছে। জনসমর্থনের ভিত্তি শিথিল হওয়ায় বিএনপিকে ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় থাকার জন্য অনেক বিদেশি শক্তির সমর্থনের ওপরও নির্ভর করতে হয়েছে।
এ জন্যই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রধান ভিত্তি জনসমর্থন। অন্যদিকে বিএনপির রাজনীতির মূল নির্ভরতা দেশের এস্টাবলিশমেন্ট (এই অবস্থার এখন কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে), এলিট ক্লাস বা শহুরে সুধীসমাজ ও এক শ্রেণির বিদেশি রাষ্ট্রের সমর্থন। সম্প্রতি কারাগমনের আগে বেগম জিয়া তাঁর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় সদস্যদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা ভয় পাবেন না, আমাদের সঙ্গে প্রশাসন, সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে সবাই আছে।’ কথাটা বর্তমান পরিস্থিতিতে কতটা সঠিক, সে কথা আমি জানি না।
তবে কথাটা একসময় অনেকটাই সঠিক ছিল। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময়। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা ঠেকানো ও বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য দেশের সিভিল ও মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্টের একটা বড় অংশ, তথাকথিত সুধীসমাজ, তথাকথিত একটি নিরপেক্ষ মিডিয়া গ্রুপ এবং শক্তিশালী কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিকরা একাট্টা হয়ে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। তখন যে ভারত আওয়ামী লীগের এত বড় মিত্র, তার তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের কূটনৈতিক সমর্থনও ছিল বিএনপির দিকে।
২০০১ সালের নির্বাচনে দেশি-বিদেশি বড় কারসাজির মুখে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও প্রতিকারের জন্য কোনো বিদেশি শক্তির দ্বারস্থ হয়নি। প্রচণ্ড নিপীড়নের মুখে তাদের সাহায্য প্রার্থনা করেনি। জনগণের কাছে ফিরে গেছে। গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করেছে। কিন্তু বিএনপি ২০০৭ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে যোগ দেয়নি। নানা অছিলায় নির্বাচন বর্জন করেছে। তাদের ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিএনপি তাদের মিত্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেও আবেদন জানিয়েছে, এই নির্বাচন ও নতুন আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধতা না দেওয়ার জন্য। দেশেও আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি দ্বারা সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করেছে। তাদের দুটি চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
বিশ্ব পরিস্থিতি যে তত দিনে একেবারেই বদলে গেছে এই সত্যটা বিএনপি অনুধাবন করতে পারেনি। তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র পাকিস্তান তখন জঙ্গিদের ভয়াবহ উত্থান ও অভ্যন্তরীণ কলহে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশের দিকে বেশি নজর দেওয়ার সময় ও শক্তি নেই। সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে বড় শক্তি হিসেবে ইরানের অভ্যুদয়ে ভীত। বাংলাদেশের সমর্থনও তার দরকার। ফলে তাদের বিএনপিপ্রীতি কমছে। ভারতে মোদির দল ক্ষমতায় এলেও বিএনপির ভারতবিদ্বেষী রাজনীতি এবং বিজেপির সঙ্গে অতীতের বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও উন্নয়নের ওপর জোর দেয়। আর নতুন ভারতপ্রেমিক আমেরিকা তখন পাকিস্তানের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তারা ভারতের অসন্তুষ্টির ভয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে আর তেমন আগ্রহী নয়।
বিশ্ব পরিস্থিতির এই পরিবর্তনের জন্য ২০১৪ সালের নির্বাচনের সমালোচনা করলেও বিশ্বের ছোট-বড় কোনো দেশ এই নির্বাচনের ও হাসিনা সরকারের বৈধতা অস্বীকার করেনি। কিন্তু বিএনপি নেতাদের বোধোদয় দীর্ঘদিনেও হয়নি। দেশের জনগণের চেয়ে বিদেশি সমর্থনের ওপর তাদের এতটা ভরসা যে ভারতে বিজেপির মোদি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসতেই তারা আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ে। ভারতে নির্বাচনে বিজয় বিজেপির। কিন্তু বাংলাদেশে মিষ্টি বিতরণ করেছে বিএনপি। লন্ডনে বসে বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নরেন্দ্র মোদিকে কাকাবাবু সম্বোধন করে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য বার্তা পাঠিয়ে অভিনন্দন জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপির এই আনন্দ উৎসব হরিষে বিষাদে পরিণত হয়। মোদি সরকার বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের দিকে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
সম্প্রতি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে পাঁচ বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে দেখা গেল বিএনপির একই বিদেশনির্ভর রাজনীতি। এই মামলা চলার সময় তারা বেগম জিয়ার কারাদণ্ড হলে বিশাল গণ-আন্দোলন করার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু জনগণের কাছে যায়নি। তারা এই মামলা যে আওয়ামী লীগ সরকারের সাজানো মিথ্যা মামলা—এটা বিদেশি সরকারের কূটনীতিকদের ব্রিফিং দেওয়া এবং তাঁদের সঙ্গে দেনদরবারে অধিক সময় ব্যয় করেছে। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছেও বারবার ধরনা দিয়েছে। বিএনপি আশা করেছিল, বিদেশিদের চাপে খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যাবেন। বিদেশিদের কাছে এই মামলাকে তারা রাজনৈতিক মামলা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।
দেশের বেশির ভাগ মানুষ যেমন এই মামলাকে রাজনৈতিক মামলা বলে চালানোর প্রচারণাকে বিশ্বাস করেনি, তেমনি কোনো বিদেশি সরকারও করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাদের অনেকের মধ্যে দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত বেগম জিয়ার প্রতি সহানুভূতি ও এক ধরনের সমর্থন থাকতে পারে, কিন্তু এটাকে রাজনৈতিক মামলা বলে চালানোর প্রচারণার পক্ষে তারা সমর্থন দেয়নি। বরং যে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের দিকে বিএনপির নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি ছিল মনে হয়, তাদের প্রতিনিধিদলের নেতা জিন ল্যাম্বার্ট সম্প্রতি ঢাকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘পরিস্থিতি জটিল। তবে এটি আদালতের বিষয়। আমরা আদালতের মামলা ও রায় নিয়ে মন্তব্য করি না।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের আদালতের রায়কে অস্বীকৃতি ও অসম্মান জানাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও রাজি নয়।
ইউরোপিয়ান প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের উন্নয়নকে স্বাগত জানিয়ে দেশটির প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানালেও খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড সম্পর্কে কোনো মন্তব্য প্রকাশে রাজি হয়নি। তারা বলেছে, এতে দেশের রাজনীতি জটিল হয়েছে বটে, কিন্তু আগামী মাসগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কম সংঘাতপূর্ণ হবে বলে তারা আশা করে। এই আশা ব্যক্ত করে তারা বলেছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টিও বাংলাদেশকে জানিয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি।
এককথায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আশা করছে, বিএনপির হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও দেশটির রাজনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে না। বরং সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। ইইউ বিএনপিকে যে পরামর্শ দিয়েছে, তাও তাৎপর্যপূর্ণ। জিন ল্যাম্বার্ট বলেছেন, ‘দলের জন্য (বিএনপি) বর্তমান অবস্থা নিশ্চয়ই একটি চ্যালেঞ্জ। তবে আমি মনে করি, রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচনে মনোযোগী হওয়াই তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বিদ্যমান আইনেই সবার অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এর চেয়ে স্পষ্ট ভাষায় ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল আর কী বলতে পারে? বিএনপির প্রতি তাদের পরামর্শ, বিদ্যমান আইনেই অর্থাৎ বর্তমান ব্যবস্থায়ই তারা যেন নির্বাচনে যায়। তারা এও মনে করে, বাংলাদেশে সংঘাতপূর্ণ অবস্থা আগামী দিনে বাড়বে না। সংঘাতে না গিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণই ইপি প্রতিনিধিরা বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আমি যে একজন ক্ষুদ্র কলামিস্ট আমিও এর আগেই মত প্রকাশ করেছি, বেগম জিয়াকে কারামুক্ত করার জন্য বিএনপির উচিত উচ্চ আদালতে যাওয়া (যা তারা যাচ্ছে)। পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রচার অভিযানে নামা। বেগম জিয়া কারাগারে বসে অথবা উচ্চ আদালত কর্তৃক জামিনে মুক্ত হতে পারলে নির্বাচন অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতে পারবেন। নির্বাচনে জয়ী হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে এবং তাঁর নেতৃত্বও অটুট থাকবে।
খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনার জন্য তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন করাও একটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। খবরে পড়েছি, ইউরোপিয়ান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বিএনপির নেতারা তাঁদের দেনদরবার নিয়ে দেখা করতে গেলে ইপি প্রতিনিধিদল তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছে, একই দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিকে তাঁরা কী করে দলের অস্থায়ী চেয়ারপারসন হিসেবে মেনে নিলেন? তার কোনো সদুত্তর বিএনপি নেতারা দিতে পারেননি। কোনোভাবে মুখরক্ষা করেছেন।
তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতেই প্রশ্ন উঠেছে। তারা এই নেতৃত্বকে সহজে স্বীকৃতি দিতে চাইবে মনে হয় না। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর কার্যকলাপে সন্তুষ্ট নয়। সম্প্রতি তারেক রহমানের সহযোগী যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতারা লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে যে গুণ্ডামি করেছেন, তাতে ব্রিটিশ সরকার বিরক্ত এবং দল-মত-নির্বিশেষে সবাই তার নিন্দা করেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং সে জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলা হয়েছে, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হবে। শোনা যায়, এই ব্যাপারে তারেক রহমানকেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তদন্ত চলছে। এর মধ্যেই তারেক রহমানের দল প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই গুণ্ডামির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। এই ঘটনা বিএনপির নেতৃত্বে তারেক রহমানের অবস্থান আরো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দুর্নীতির সঙ্গে সন্ত্রাসও যে তাঁর রাজনৈতিক চরিত্র—এটা আরো ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি তাঁর নেতৃত্বের দায় বহন করবে কিভাবে?
সব দিক বিবেচনায় বর্তমান সময়টা সত্যই বিএনপির জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এ অবস্থায় কোনো হঠকারী নীতি না নিয়ে বিএনপির উচিত হবে ইপি প্রতিনিধিদলের পরামর্শ শোনা এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়া। এখন প্রশ্ন, তারা সেই সুপরামর্শ শুনবে কি? (কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত)
লন্ডন, সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮