![একুশে নিয়ে শ্রেণীগত স্ববিরোধিতা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/21/ahmed-rafiq_126906.jpg)
আহমদ রফিক, ২১ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই সাংস্কৃতিক অঙ্গন একুশে ও বাংলা ভাষা নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। গণমাধ্যম অর্থাৎ সংবাদপত্র মহল ও বেতার-টিভি তত্পর হয়ে ওঠে একুশের ইতি-নেতি নিয়ে, ভাষা ব্যবহারের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা নিয়ে। বিস্তর লেখালেখি চলে এসব বিষয়ে। কখনো উচ্চ আদালতের নির্দেশ জারি হয় নির্ভুল বানান ও শব্দ ব্যবহারের পক্ষে। রাস্তার ধারে যেমন-তেমন বানানে লেখা সাইনবোর্ডগুলোয় সংশোধনের তাগিদ আসে।
তার মানে আমরা প্রাত্যহিক জীবনে, সাংস্কৃতিক আচরণে মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা-অবহেলা করে চলেছি। অথচ এ মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য কত না লড়াই ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ এবং তার পরও একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন উপলক্ষে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে সেই ধারা শুরুতে মহা-আবেগে, পরে গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছে ‘মহান একুশে’ পালনের কেন্দ্রস্থল। একদিকে প্রতিদিনের আলোচনা সভা ও সংগীত পরিবেশন, অন্যদিকে বইমেলার সমারোহ।
বাকি ১১ মাসের কথা দূরে থাক, এই এক মাসে, কথিত ভাষার মাসে মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষা ব্যবহারের শুদ্ধতা নিয়ে আমরা কয়জন ভাবি, কয়টা সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন শুদ্ধতার দাবিতে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়? অথচ সারা বছর ধরে শুনতে পাই এফএম রেডিওতে ভাষা ব্যবহারে বীভৎসাচার। এসব মাধ্যমে বাক্যের উদ্ভট ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে চলছে। চলছে বাংলা-ইংরেজির মিশ্র দোআঁশলা ব্যবহার, যা অশুদ্ধ তো বটেই; রীতিমতো অরুচিকর।
টিভির টকশোগুলোয় মূলত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে অর্ধেক ইংরেজি, অর্ধেক বাংলায় যে উদ্ভট বক্তব্য উপস্থাপন করেন, তা অশালীন সংস্কৃতিরই প্রকাশ নয় শুধু, এটি হজম করা কঠিন। মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষার প্রতি বিন্দুমাত্র আনুগত্য ও মমত্ববোধ থাকলে এমনটি সম্ভব হতো না। কিন্তু বাস্তবে তা-ই ঘটছে। এমনটি তো হওয়ার কথা নয়। কথা ছিল না পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিবাদী পটভূমিতে। এখন মাতৃভাষা-মাতৃভূমি নিয়ে আবেগের জোয়ার বইছে সাহিত্যে ও সংস্কৃতিচর্চায় আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার টানে।
দুই
তবু অঘটন ঘটে চলছে। বাংলার ব্যবহারে এন্তার ভুলত্রুটি ও অশুদ্ধতাকে অঘটনই বলব। ব্যক্তির বক্তব্যে, বেতার-টিভির অনুষ্ঠানে, বিজ্ঞাপনে-সাইনবোর্ড থেকে অনুরূপ মাধ্যমে বাংলার ভুল ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ শব্দ ব্যবহার ও বাক্য গঠন— সবকিছু মিলে মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষার প্রতি আমাদের অমর্যাদার প্রকাশ আমাদের বাঙালি পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জাতীয়তাবোধ লজ্জায় মাথা হেট করতে বাধ্য হয়।
এদিক থেকে এফএম রেডিওর বিকৃত বাংলা ও ইংরেজি মিশ্রণ তরুণদের মধ্যে যে ভাষিক প্রভাব বিস্তার করছে তথাকথিত স্মার্টনেসের নামে, তা নান্দনিক অপরাধের শামিল এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুর্ভাগ্যজনক যে, এসব অপতত্পরতার ওপর সরকারের কোনো নজর নেই, নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা। অপরাধ, শাস্তি ইত্যাদি তো অনেক দূরের ঘটনা।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে একুশে চেতনা যথাযথ ঐতিহ্য হয়ে উঠতে পারেনি যেমন সাংস্কৃতিক মহলের বড়সড় অংশে, তেমনি শাসক শ্রেণীতে। তাই বাংলা ভাষার অনুশীলন, চর্চা ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট অবহেলা দৃশ্যমান। এবং তা একুশে চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এমনকি সংবিধানেরও পরিপন্থী। সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’
সে পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানমতে দেশের উচ্চশিক্ষা থেকে উচ্চ আদালত তথা সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কিন্তু ঔপনিবেশিক রাজভাষা-সংস্কৃতির টানে যেমন সংবিধান লঙ্ঘন, তেমনি মাতৃভাষা বাংলা মাধ্যমের ব্যবহারে অনীহা এবং বলা-কওয়া ও লেখায় ভুল-ভ্রান্তি একাধিক মাত্রায়। এই ‘গোড়ার গলদ’ দূর না হলে মাতৃভাষা নামেই অর্থাৎ কাগজপত্রে রাষ্ট্রভাষা হয়ে থাকবে, বাস্তবে তার দেখা মিলবে না। এবং তা জাতীয় ভাষা ও জীবিকার ভাষা হয়ে উঠবে না।
স্মরণযোগ্য যে একুশের প্রতিটি মিছিলে বরাবর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান ছিল— ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করো।’ কিন্তু সাংবিধানিক স্বীকৃতি সত্ত্বেও জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। বরং জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, বিশেষ করে শিক্ষার সর্বস্তরে ইংরেজি মাধ্যমের প্রবল একাধিপত্য। এটা আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর দান। যে শিক্ষিত শ্রেণী একসময়কার ঔপনিবেশিক রাজভাষার উত্তরসূরি, সেই ধারাবাহিকতা বহনকারী শ্রেণী।
ভাষিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হলো, প্রথমত. জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত. একই কারণে মাতৃভাষা-রাষ্ট্রভাষার শুদ্ধ আন্তরিক অনুশীলন ও চর্চা, যাতে ভাষার নানামাত্রিক নির্ভুল ব্যবহারে কোনো প্রকার বিচ্যুতি-বিকৃতি না ঘটে। এছাড়া আপত্তিকর আচরণ বাংলার সঙ্গে ইংরেজির যুক্তিহীন মিশ্রণ ঘটিয়ে ভাষিক পরিবেশকে দূষিত করা হচ্ছে। এসব ভাষিক অনাচার বন্ধ করা উচিত।
কিন্তু বাস্তব ঘটনা এসব উচিতের বিপরীত পথ ধরেই চলছে। চলছে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির হাত ধরে, ক্ষেত্রবিশেষে সাংবিধানিক নির্দেশ লঙ্ঘন করে। কেন এ বিপরীত যাত্রা? কীভাবে তা সম্ভব হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারক-বাহকদের পক্ষে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ অভিযোগ সর্বাংশে সত্য। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হলো, এ সম্পর্কে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই, সমালোচনা নেই, প্রতিবাদ আলোচনা তো অনেক দূরের কথা।
তিন
বিস্ময়কর মনে হলেও এসবের কারণ দুর্বোধ্য নয়। রাজনীতি-সমাজনীতির শ্রেণীস্বার্থের বিচারে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। পাকিস্তান আমলে যে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণীর নানা পেশাজীবী শাখা অবাঙালিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অনেক অনেক পিছিয়ে ছিল, পিছিয়ে ছিল সামরিক বাহিনীর উচ্চপদ অধিকারের ক্ষেত্রে, শিল্প-বাণিজ্য বৃহৎ ব্যবসার একাধিক ক্ষেত্রে, এমনকি উচ্চপদমান মর্যাদায়, স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণী এখন সেদিক থেকে রাজার রাজা। সব অলঙ্কারময় পদ ও অর্থকরী প্রতিষ্ঠান এখন তাদের দখলে।
এসব শ্রেণী-উপশ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থনৈতিকভাবে পরিপুষ্ট এবং রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতায় শক্তিমান এদের সামাজিক প্রতিনিধি রাজনৈতিক দল। এ দুইয়ের সহযোগিতা ও সমঝোতায় চলছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবন, যা বিত্তে-সম্পদে-বৈভবে সমৃদ্ধ। দেশের অর্থনৈতিক খাতের উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি এদেরই পক্ষে, এদেরকেই সমৃদ্ধতর করে তুলছে। এদের আর কিছু চাওয়ার নেই।
এক কথায় তাদের শ্রেণীস্বার্থ পুরোপুরি সিদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দানে ও আনুকূল্যে। স্বভাবতই প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে ভাষা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার যেসব হাতিয়ার নিয়ে লড়াই, সেসব হাতিয়ার এখন অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। যেগুলোকে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দেয়াই স্বাভাবিক। এগুলো ঘিরে জনবান্ধব অঙ্গীকার এখন অর্থহীন।
তাই একুশের চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে শ্রমনিষ্ঠ সমাজবদলের কর্মকাণ্ড সিদ্ধকাম শ্রেণীর জন্য পণ্ডশ্রম বলা চলে। তাই উল্লিখিত কোনো চেতনাই পূর্বোক্ত আত্মতৃপ্ত শ্রেণীর মননে দামামা বাজায় না। তাদের লড়াইয়ের জন্য উদ্দীপ্ত করে না। কারণ মূল প্রশ্নটা এখন এমন: কার সঙ্গে লড়াই, কীসের জন্য লড়াই! কোন বুদ্ধিমান নিজ শ্রেণীস্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে? না, নামে না।
তাই ঔপনিবেশিক ধারার একালের শিক্ষিত ও বিত্তবান শ্রেণী পূর্ব ধারার পথ ধরেই চলছে। এতেই তাদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে, সমৃদ্ধতর হচ্ছে। এ সত্যকে সামনে রেখে পথ চলছে বাংলাদেশের শ্রেণীশাসন, সেই সঙ্গে স্বার্থপর শ্রেণীর অবিশ্বাস্য রকম দুর্নীতিযুক্ত মুনাফাবাজি। এ অচলায়তন ভাঙা খুবই কঠিন। তাছাড়া এ কাজে এগিয়ে আসার মতো মননশীলতা ও ত্যাগী মানসিকতাও তৈরি হচ্ছে না। (বণিক বার্তা)
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি ও গবেষক