মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২
logo

মাতৃভাষা আমাদের অস্তিত্বের ভাষা

মাতৃভাষা আমাদের অস্তিত্বের ভাষা

কাঞ্চনা চক্রবর্ত্তী, ২১ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির কাছে শুধু দুটি শব্দ নয়। এ আমাদের অহংকারের প্রতিচ্ছবি। মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কের মতই মাতৃভাষার সাথে প্রত্যেকের এক অকৃত্রিম সম্পর্ক রয়েছে। মাতৃভাষা বিধাতা প্রদত্ত মানুষের জন্মগত অধিকার।মানুষের স্বপ্ন, আশা ভরসা, অনুভূতি, ভালবাসা ও সুখ –দুঃখ সবই প্রকাশিত হয় তাঁর মাতৃভাষার মাধ্যমে। বাংলা ভাষা ”মা’ ডাকের সাথে সাথে হৃদয়ের গভীর থেকে এক অভাবনীয় প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয় গোটা দেহের কোষে কোষে।

বাংলাদেশ ও সমগ্র বাঙালী জাতির ইতিহাসে একুশ এক অমর গাঁথা। একুশের হাত ধরেই বাঙালি জাতি পেয়েছে স্বাধীনতার চেতনা। খুঁজে পেয়েছে নিজস্ব মানচিত্র। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের মাতৃভাষার সাথে সাথে বীর বাঙালি ও আমাদের স্বদেশের চেতনাবোধের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সকল প্রান্তে।

ইতিহাসের জটিল আবর্তে মাতৃভাষার স্বীকৃতি ও আত্ম প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে মূল্যবান।কিন্তু মাতৃভাষা যদি শুধুমাত্র মুখের ভাষাই থেকে যায়, সমৃদ্ধ সাহিত্যে রূপান্তরিত না হয়, তাহলে তা আমাদের বৃহত্তর জীবনের চাহিদা মিটাতে ব্যর্থ হবে।

আজ বাঙালীর ভাষা, সভ্যতা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি ইত্যাদি হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আর একবার ভাবিত করে তুলছে।একুশ আজ পোশাকে, ব্যানারে ও সভা সমিতিতে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।বৎসরের একটি বিশেষ দিনে একুশের মৌসুমে বাংলা বাংলা বলে আমাদের লোক দেখানো আর্তি জাতীয় জীবনে ভাবালুতা, কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ বেঈমানীর পর্যায়ে পড়ে।বাংলার প্রশ্ন আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।একুশের চেতনা ও পরিব্যাপ্তিকে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, বরং এর মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটাতে হবে। কথায় কথায় বিদেশী শব্দের অনাবশ্যক ব্যবহার আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলে এমন প্রয়াসকে নিয়ে ভাবতে হবে। এছাড়া বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বাংলা বানানের ব্যাপারে উদাসীনতার অরাজকতা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।এর জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাই দায়ী। হ্র– স্ব –ঈকার ও দীর্ঘ– ঈকার এর ব্যাপারে উদাসীনতাসহ অনেক সাধারণ বানানই যেন লেখার ইচ্ছার কাছে বলিদান হয়ে গেছে। কেননা, ভুল বানানে এখন আর কিছু যায় আসে না। তাহলে ভাষার সঠিক রূপটি হারিয়ে গিয়ে এর মর্যাদা কতখানি কলুষিত হচ্ছে তা এবার ভাবতে হবে। বাংলা ব্যাকরণের সঠিক নিয়ম কানুন কঠোরভাবে যেন মানা হয়। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সৃজনশীল পদ্ধতির বেসামাল গতি বাংলা বানানের অপমৃত্যুর জন্য দায়ী। কেননা, শিশুরা আজ ভুল বানান নিয়ে চিন্তিত নয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আজ শুধুমাত্র নম্বর প্রার্থী ছাত্র ছাত্রী আছে। শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থী নেই। বাংলা ভাষার এমন করুণ দশা থেকে একমাত্র মুক্তি দিতে পারি আমরা নিজেরাই। এর সঠিক চর্চা ও লালনই মায়ের ভাষার মর্যাদাকে আবার ফিরিয়ে দিতে পারি। বাংলা একাডেমী এ ব্যাপারে যথাযথভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

মহান একুশ আমাদেরকে জাতীয় পর্যায়ে ঐক্য ও সম্প্রীতির সেতু বন্ধনে একত্রিত করতে পেরেছে। জাতির উপর যত বড় আঘাতই আসুক না কেন, জাতি আত্মকলহ ও সংঘাতে নিমজ্জিত থাকুক না কেন একুশের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাতে সবাইকে শহীদ মিনার এক করতে পারে।এভাবে একুশ গড়েছে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন। কিন্তু শুধুমাত্র একসাথে দলবেঁধে শহীদ মিনারে গেলেই সম্প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধন দৃঢ় হয় না। আমাদের দেশের এমপিও ভুক্ত মাদ্রাসাতে কোন শহীদ মিনার নেই। তাই দোশর যেসকল প্রতিষ্ঠান এখনও এমন রয়েছে তাদের কর্তৃপক্ষকে শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে আইন করে এ ব্যাপারে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও উচ শিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষা বা উচ্চ আদালতে কোথাও রাষ্ট্রভাষা বাংলার কোন সম্মানজনক স্থান নেই। সচিবালয়সহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচতর শিক্ষার সকল ক্ষেত্রে মাতৃভাষা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। আবার, নতুন উপদ্রব ইংলিশ ভার্সন যা আমাদের বাংলা ভাষাকে পিছিয়ে দিচ্ছে। মাতৃভাষা শুধুমাত্র আমাদের মুখের ভাষা নয়। অস্তিত্বের ভাষা। আজ মাতৃভাষাকে মূল্যায়ন না করাতে জাতীয় পর্যায়ে আমরা শিকড়বিহীন বৃক্ষের মত হয়ে পড়ছি।

দেশ ও জাতি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা নিয়ে অহংকার করে। কিন্তু নিজ দেশেই ভাষা চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য কোন রাষ্ট্রীয় নীতি মালা নেই। ভাষা রক্ষায় চেষ্টারত গবেষকদের নেই কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ভাষা নিয়ে কাজ করার কোন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দীপনা কিংবা প্রণোদনা নেই। সরকারী অফিস আদালত, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বাংলা হরফে ইংরেজী অথবা ইংরেজী হরফে বাংলা লেখা। ক্রমাগত বাড়ছে এই প্রবণতা। অথচ একুশ এলেই শুরু হয় ভাষা প্রেম। পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি রয়েছে যারা ইংরেজী ভাষার প্রবল প্রতিপত্তিকে উপেক্ষা করে মাতৃভাষায় সকল রাষ্ট্রীয় ও দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করছে। আর আমরা হাঁটছি উল্টো পথে। বাংলা ভাষাকে আজ জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়েছে।

এমনকি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের এ সাধনার ও প্রাণের ভাষা আজ নিজভূমিতেই অবহেলিত। ঘরে ঘরে শিক্ষিত মা– বাবারা সন্তানদের ইংরেজীতে দক্ষতা বাড়াতে বাংলার পরিবর্তে অনবরত ইংরেজী বলে যাচ্ছে। তাই এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের গর্বের অর্জনটি ধীরে ধীরে প্রজন্মান্তরে হারাচ্ছে তাঁর মর্যাদা ও গুরুত্ব। তাই একুশের চেতনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করেনি।বরং উল্টোভাবে এক বিরূপ পরিবেশে সেসব চেতনা ক্রমশ পিছু হটেছে বিকাশ ঘটা তো দূরের কথা!বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আজ দেখা যায়, পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িক চেতনার আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটলেও বাস্তবে তার বিনাশ ঘটেনি। বরং এই বিষবৃক্ষ সমাজের অনেক ক্ষেত্রে ডাল পালা ছড়িয়ে আছে। তারুণ্য থেকে সকল বয়সে ”একুশ আমার গর্ব, একুশ আমার অহংকার’’ এটা কেবল বাহ্যিক প্রকাশ। চৈতন্যের গভীরে তার প্রভাব বিকশিত হয়ে ওঠেনি। তাই একাত্তরের অর্জন আজ ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবাঞ্চিত প্রকাশ। যা জাতির জন্য অশুভ।

একুশ থেকে আমরা পাই গণতন্ত্রের চেতনা,পাই সাম্যের চেতনা। একুশ আমাদের শিখিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে। একুশের চেতনা যেমন সমানাধিকারের চেতনা তেমনি একুশের চেতনা মানে অসাম্প্রদায়িকতা মহান চেতনা। স্বাধীনতার পরবর্তী একুশ বিভিন্ন সংকট উর্ত্তীণ হয়ে জাতিকে জাগ্রত করতে চেতনাদায়ী হিসেবে কাজ করেছে। একুশের বই মেলা সে ধরনের একটি উপলক্ষ। যা বাঙালি জাতিকে সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক আবহে উদ্বুদ্ধ করে। সব ধরনের কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও জাতিভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িক বিষ ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা। বীরদর্পে মাথা তুলে বলতে চাই। আমার ভাষা, আমার একুশ আমার অহংকার।একুশের চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে অনুপ্রেরণার অনির্বাণ শিখা হয়ে জ্বলুক। ”মনে প্রাণে হব আমরা বাঙালি,/ আমরা পর ধনে নই তো বাঙালি। দুঃখী মায়ের মুখের ভাষা,/ হোক জাতির আশা–ভরসা।’’

লেখক : প্রভাষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, নিজামপুর কলেজ, চট্টগ্রাম।

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত