বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার এগিয়ে যাওয়া

বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার এগিয়ে যাওয়া

এস. এম. ওমর ফারুক, ২২ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : পৃথিবী ও সভ্যতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, হাজার হাজার ভাষা ইতোমধ্যে বিলুপ্তের খাতায় নাম লিখিয়েছে। আবার স্কটল্যান্ডের অতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অখ্যাত ভাষা ইংরেজি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমানে আর্ন্তজাতিক ভাষার আসন দখল করেছে। অন্যদিকে, যে বাংলা ভাষা পৃথিবীর একক বৃহত্তম ভাষা হওয়ার কথা ছিল, সেই ভাষাকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা–তাদের মেধা দিয়ে, রক্ত দিয়ে, সংগ্রাম দিয়ে।

মহান একুশ এর চেতনাকে শানিত করে বাংলা ভাষাকে এবং বাংলাদেশের অগ্রগতিকে ষড়যন্ত্রের হাত হতে রক্ষায় নতুন প্রজন্মকে আঁকড়ে ধরতে হবে নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে। আজকের লেখায় আমরা বাংলা ভাষাকে ধ্বংসের অতীত প্রয়াসের কথা যেমন তুলে ধরতে চাই, তেমনি বর্তমানেও বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার যে বহুমাত্রিক প্রয়াস চলছে তা চিহ্নিত করতে চাই।

বৃটিশশাসিত ভারতবর্ষ ছিল বহু ভাষাভাষি মানুষের দেশ। কোন কোন গবেষকের দাবি অবিভক্ত ভারতে হাজার এরও বেশি ভাষার অস্তিত্ব ছিল, যার অনেকগুলো বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৪৭ খ্রি. এর ১৪ আগস্ট ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে অনেকগুলো অমীমাংসিত বিষয়কে সামনে রেখে। ঐ সব অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ভাষা। ভারতের রাষ্ট্র ভাষা কি হবে? পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা কি হবে?

অবিভক্ত ভারতে একক বৃহত্তম ভাষা ছিল বাংলা। বিভক্ত ভারতেও বাংলা ছিল বৃহত্তম ভাষা। সঙ্গত কারণেই সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত উভয় রাষ্ট্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়। শুধু দাবি নয়, যৌক্তিক এবং জোড়ালো দাবি। কিন্তু শুরু হল বাংলা ভাষার ভাগ্য বিপর্যয়ের ইতিহাস। এ ছিলো স্বাধীন ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার জওয়াহরলাল নেহেরু ভারতের রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্নে প্রথমে কংগ্রেস নেতৃত্বকে এবং পরে প্রভাবশালী বাঙালি বুদ্ধিজীবীদেরকে তাঁর অবস্থানের পক্ষে আনতে সক্ষম হন। বহু–ধর্ম–বর্ণ–ভাষা–গোত্রের দেশ ভারতের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয় অতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির ভাষা ‘হিন্দি’ এবং বৃটিশ উপনিবেশিকশক্তির ভাষা ইংরেজিকে, যুগপৎভাবে। অর্থাৎ ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হল হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা। এভাবে অবসান ঘটল পৃথিবীর একক বৃহত্তম ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা।

অতঃপর বাংলার দুর্ভাগ্যের দ্বিতীয় পর্বে পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উদ্যত হলেন বাংলা ভাষাকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে। মি. জিন্নাহ বাঙালির দাবী নিয়ে যুক্তিসঙ্গত আলোচনার তোয়াক্কা না করে, কোটার সিদ্ধান্তে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বসেন। এখানেও লক্ষ্যণীয় এবং মজার বিষয় হলো, সমগ্র পাকিস্তানের (পূর্ব ও পশ্চিম) মাত্র ০.৫৬ (শূন্য দশমিক ছাপান্ন) শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু এবং যাদের অধিকাংশই ভারতের এলাহাবাদ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এসে বসবাস শুরু করে।

আরো লক্ষ্যণীয় যে, মি. জিন্নাহ নিজেও ভালোভাবে উর্দু বলতে পারতেন না, লিখতে বা পড়তে পারতেন না। মি. জিন্নাহর এই রহস্যময় সিদ্ধান্ত তাঁর তাঁবেদার নেতা–কর্মীরা মেনে নিলেও সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬% (ছাপান্ন) শতাংশ বাংলা ভাষাবাসী জনগণ, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী কেউ মেনে নিতে পারেনি। তারা মি. জিন্নাহ সামনেই ‘নো’ ‘নো’ বলে প্রতিবাদ করেন। কলম ধরেন, সভাসমাবেশ করেন।

১৯৪৯ খ্রি. মি. জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর অন্ধ অনুসারীরা উর্দুকে প্রতিষ্ঠার বহুরকম চেষ্টা চালিয়ে যান। তাদের সে চেষ্টা সফল হলে এতদিনে হয়ত বাংলা ভাষা পৃথিবীর হাজার হাজার বিলুপ্ত ভাষার তালিকায় স্থান করে নিত। কিন্তু আমাদের গর্বিত ও দৃঢ়চেতা পূর্বপুরুষেরা তাঁদের বহু কষ্ট, নির্যাতন এবং প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছেন। পাকিস্তানি স্বৈরাশাসকরা বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে।

১৯৫২ খ্রি. ২১ ফেব্রুয়ারির সে মহান আত্মত্যাগকে ধারণ করে বাংলা ভাষাভাসীরা শুধু তাদের ভাষা রক্ষা করেনি, অর্জন করে নিয়েছে তাদের নিজেদের জন্য স্বাধীন–সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। গর্বিত পূর্বপুরুষদের রক্তের ধারাবাহিকতায় আমাদের নতুন প্রজন্ম ১৯৯৯ খ্রি. জাতিসংঘ থেকে ‘২১ ফেব্রুয়ারিকে “আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে উদ্যাপনের স্থায়ী ব্যবস্থা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। আশা করা হচ্ছে সে ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা অচিরেই জাতিসংঘের অন্যতম অফিসিয়াল (দাপ্তরিক) ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে আত্মঘাতী তৎপরতা চলছে তার ব্যাপারে নতুন প্রজন্মকে সজাগ করতে সরকার, প্রশাসন, বুদ্ধিজীবী সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সংস্কৃতিকর্মী, সংবাদকর্মী ও সুশীলসমাজকে উদ্যোগী হতে হবে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পরিচালিত বর্তমান অপতৎপরতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোন কোন মহল ইংরেজি চর্চার নামে এক ধরনের ‘বাংলিশ’ চর্চা করে বাংলা ভাষাকে খাটো করার এবং বিকৃত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশে প্রচলিত কতিপয় এফ.এম রেডিও এবং কিছু টিভি উপস্থাপক এই বিকৃত চর্চাকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তৎপর রয়েছে।

বাংলা ভাষাকে বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় ‘আকাশ সংস্কৃতির’ সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এগুতে হবে। বিদেশী বিভিন্ন চ্যানেল চটকদার অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে অবাধে এদেশে প্রচারিত হচ্ছে এবং তরুণ–তরুণীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ফলে, এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি, ভাষাবৈকল্য ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কবলে পড়ছে।

এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক অনুষ্ঠানের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আগে যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক গান, লোকগীতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র–ছাত্রীদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হত। এখন কিন্তু একধরণের বিকৃত রুচির কবলে পড়ে শিক্ষার্থীরা দেশীয় সংস্কৃতির পরিবর্তে ভিন্ন ভাষার উগ্র গান–বাজনা বাজিয়ে পাশ্চাত্য ঢংয়ে নাচ করে সংস্কৃতিক কর্মসূচী পালন করছে। ফলে, ধ্বংসের কবলে পড়ছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি।

আসুন, একুশকে গতানুগতিকভাবে পালন না করে, আত্মমূল্যায়নের মাধ্যমে মাথা উঁচু করে বাংলা ভাষাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে পালন করি। পরিশেষে, ভাষার জন্য যাঁরা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁদের সকেেলর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেষ করছি।

লেখক: অধ্যাপক, গ্রন্থকার ও প্রাবন্ধিক।

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত