
ড.মইনুল ইসলামে, ২৪ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আলোড়ন সৃষ্টিকারী রায় ঘোষিত হয়েছে। সামরিক বাহিনী–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক মামলা দায়েরের প্রায় দশবছর পর সুদীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আদালতের এই রায় ঘোষিত হয়েছে। এই দশ বছরে তিনবার আদালতের বিচারক পরিবর্তন করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিচারককে বেগম জিয়ার অপছন্দের কারণে আপত্তি উত্থাপনের প্রক্রিয়া নিষ্পত্তির মাধ্যমে। বিএনপি’র বিশাল উকিল–ব্যারিস্টার বাহিনীর চাণক্য–বুদ্ধির প্রয়োগের ধারাবাহিকতায় ২২টি রিট মামলা করা হয়েছে এই মামলা খারিজ করার উদ্দেশ্যে, যেগুলোর প্রত্যেকটাই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ কর্তৃক বাতিল করার ফলেই নিম্নতর আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চালানোর পথের বাধাবিঘ্ন অপসারিত হয়েছে। আদালতের ২৩২ কর্মদিবসের চার্জগঠন ও শুনানী চালাতে প্রায় আটবছর লেগেছে ওসব উকিল–ব্যারিস্টারের কালক্ষেপণের নানা কৌশলের কারণে। এই ২৩২ দিনের মধ্যে নানা অজুহাত দেখিয়ে বেগম জিয়া মাত্র ৪০ দিন আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। আর, এই ৪০ দিনের মধ্যে প্রতিদিন তিনি আদালতে হাজির হতে নাকি গড়ে দেড়ঘন্টা বিলম্ব করেছেন, যা আদালতের বিচারককের প্রতি যে কোন আসামীর অদম্য অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। (এ–ব্যাপারে কয়েকবার আদালতকে বেগম জিয়া এবং তাঁর উকিলদের প্রতি সাবধানবাণীও উচ্চারণ করতে হয়েছে!)পত্র–পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাখবর থেকে আমরা প্রায়ই জেনেছি যে শুনানীর দিনগুলোতে বেগম জিয়ার উকিল–ব্যারিস্টাররা অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতে হৈ চৈ করেছেন, এমনকি বিচারকের সাথে অসদাচরণ করতেও পিছপাও হননি। অতএব, এই মামলাটি ‘আসামীপক্ষের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ’ প্রদর্শনের দিক্ থেকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসের অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত–সৃষ্টিকারী মামলা হিসেবে নজির হয়ে থাকবে। তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে ক্ষমতাসীন বেগম খালেদা জিয়া কর্তৃক এই অভূতপূর্ব ও ন্যক্কারজনক নজির স্থাপন কি ঠিক হয়েছে? এই প্রশ্নটি বিএনপি’র উকিল–ব্যারিস্টার মহোদয়দের কাছেও রাখলাম।
অবশ্য, বেগম জিয়ার পক্ষাবলম্বনকারী আইনজীবীদের এহেন গর্হিত আচরণ ও বৈরী পরিবেশ সৃষ্টির প্রধান কারণ দেশের সংঘাতমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। মামলাটি যেহেতু ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলা, তাই এই মামলা দায়েরের পেছনে দেশের তদানীন্তন সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বা কৌশল হয়তো মূল ভূমিকা পালন করেছে। (‘মাইনাস টু’ কৌশল গৃহীত হয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে চিরতরে বিদায় করার খায়েসে, যার নীল নকশা প্রণয়নে দেশের সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের উৎসাহী যোগসাজশকারী/অংশীদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন দেশের বেশ কয়েকজন নামী–দামী ব্যক্তিত্ব।) প্রকৃতপক্ষে এই ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার মূল টার্গেট নাকি ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐ প্রোগ্রাম গ্রহণকারী একজন প্রধান কুশীলব পরবর্তীতে পত্র–পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এই স্বীকারোক্তি প্রদান করেছিলেন। আসলে ২০০৭ সালের মে মাসে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করার পর নাকি বেগম জিয়াকেও গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল দেশ–বিদেশের বিভিন্ন মহলের সমালোচনাকে মোকাবিলা করার জন্যে, গ্রেফতারের ইস্যুটিকে একতরফা না করে ‘ব্যালেন্সড্’ করার জন্যে! গ্রেফতার করার পর দুজনকেই শেরে বাংলা নগরের সংসদ ভবনের পার্শ্ববর্তী দুটো বাংলোয় ‘সলিটারী কনফাইনমেন্টে’ আটকে রেখে বিচারের প্রহসন শুরু করা হয়েছিল। দুজনের বিরুদ্ধেই অনেকগুলো দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলা দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন, পর্দার আড়ালে যেগুলোর প্রকৃত উদ্গাতা ছিল ডিজিএফআই। ২০০৭ সালে মামলাগুলো দায়ের করার পর ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি মামলার দ্রুতবিচার প্রক্রিয়া চালানোর প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে প্রকৃত শাসন ক্ষমতা দখলকারী সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট। বোঝা যাচ্ছিল যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বেশ কয়েকটি মামলার বিচার প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়া হচ্ছিল।(বেগম জিয়ার মামলাগুলোর গতি অনেকখানি শ্লথ ছিল।) কয়েক মাসের মধ্যে শেরে বাংলা নগরে স্থাপিত ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের’ক্যামেরা–শুনানীও প্রায় শেষ করে আনা হয়েছিল। কিন্তু, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের স্টাইলে তখনকার সমর–প্রভুদের ‘কিংস্ পার্টি’ গঠন করার খায়েস পূরণ করার পদক্ষেপগুলো যখন জনগণের কাছে ধরা পড়ে গেলো তখন ২০০৭ সালের আগস্টের শেষদিকে এসে সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান গণপ্রতিরোধ ও গণবিদ্রোহ গড়ে উঠতে মোটেও বিলম্ব হয়নি। এর ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালে সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ পরিত্যাগ করে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কিত সমঝোতা আলোচনার ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা এবং বেগম জিয়াকে মুক্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু, দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলাগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আর প্রত্যাহার করা হয়নি।
অতএব, প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন যে এই দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর প্রকৃত সারবত্তা আছে কি নেই তা আমাদের মত সাধারণ জনগণের জানার ভাল সুযোগ নেই। কিন্তু, যেহেতু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করে গত ৯ বছর ধরে ক্ষমতাসীন রয়েছে তাই রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলে দুর্নীতি দমন কমিশন এই মামলাগুলোর ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা এবং স্বাধীনভাবে মামলা চালানোর ক্ষমতা ধারণ করে কিনা সে প্রশ্নটি জনমনে গেঁথে রয়েছে বলা চলে।বিশেষত, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সবগুলো মামলা গত নয় বছরে প্রত্যাহার করা হয়েছে, একটিও আদালতের চার্জগঠন পর্যায়ে যায়নি। অন্যদিকে, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি মামলাও প্রত্যাহার কিংবা বাতিল হয়নি। এগুলোর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় প্রদত্ত হলো, আরো কয়েকটি মামলার চার্জগঠন সম্পন্ন হয়ে শুনানী চলছে। মামলাগুলোর এহেন বিপরীতমুখী পথযাত্রার কারণেই দুর্নীতির মামলার রাজনীতিকরণের অভিযোগ উঠেছে। জিয়া অরফানেজ মামলায় বেগম জিয়ার পাঁচ বছরের জেল হওয়ায় তাঁকে নির্বাচনী রাজনীতি থেকে ‘ডিসকোয়ালিফাই’ করার উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীন জোট আদালতকে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠছে জোরেসোরে, যদিও ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয় যে আপিল আদালতের রায়েই বিষয়টার সুরাহা হবে—অন্য কোনভাবে নয়।
কিন্তু, ব্যাপারটার এভাবে সরলীকরণ ঠিক হবে না। কারণ, এই মামলাটি পরিচালনার বিরুদ্ধে ২২টি রিট মামলার প্রত্যেকটি উচ্চতর আদালতে খারিজ হওয়ার মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে মামলার ‘প্রাইমা ফেসি’ ভিত্তি খুবই শক্ত। পত্র–পত্রিকায় আদালতের রায়ের যে সংক্ষিপ্ত ভার্সান প্রকাশিত হয়েছে তাতেও বোঝা যাচ্ছে আসামীপক্ষ অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাৎ করেছে। মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, তারেক রহমান ২০০১–২০০৬ মেয়াদের বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের সময় যেরকম বেপরোয়াভাবে ‘হাওয়া ভবন’–কেন্দ্রিক প্যারালাল সরকার পরিচালনা করেছে, এবং তাঁর এহেন ‘যুবরাজসুলভ’ একচেটিয়া দাপটের ব্যাপারে বেগম জিয়ার যে কোন কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল না সেটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। ঐ ‘হাওয়া ভবনের’ তাণ্ডবের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আর্থিক দুর্নীতির সংশ্লেষের কথা মোটেও গোপন কোনবিষয় ছিল না। ক্ষমতা হারানোর পর পুত্রের ঐ কর্মকাণ্ডের দায়ভার তদানীন্তন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মায়ের ওপর একের পর এক আসতেই থাকবে, এতে অবাক হওয়ার কোন কারণ আছে কি? শুধু দুর্নীতির তাণ্ডব নয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ‘গ্রেনেড হত্যাযজ্ঞের’ ষড়যন্ত্রেও তারেক জিয়ার নির্দেশদাতার ভূমিকা পালনের অভিযোগ উঠেছে এতদ্সম্পর্কিত মামলায়। রাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ঐ মামলায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতৃত্বকে হত্যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্পর্কীয়বাদীপক্ষের কথিত ‘রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের’ এই গুরুতর অভিযোগ আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয় কিনা সেটাই জানার জন্যে এখন জাতি অপেক্ষা করছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় প্রাথমিকভাবে জেতার কারণে তাদেরকে অভিনন্দন। ২০০৭–২০০৮ সালের সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের সমর্থনপুষ্ট দুদক যে কী বিপুল শক্তিধর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল তা এত তাড়াতাড়ি জনগণ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। আবার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদের পর ২০০৯ সাল থেকে দুদক শুধু দুর্নীতির চুনোপুঁটি ধরছে, রাঘব বোয়াল ধরার সাহস দেখাতে পারছে না বলে অনেকেই অভিযোগ তুলে চলেছিলেন। দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি’র শীর্ষনেত্রী বেগম জিয়াকে জেলে ঢোকানোর মাধ্যমে তাদের এই বদনাম ঘোচানোর শুভযাত্রা শুরু হলো। কাগজে–কলমে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের সময়েও আসলেই ‘স্বাধীন’ কিনা সে এসিড টেস্টে অবতীর্ণ হওয়ার পালা শুরু হলো এবার। (দুদকের একজন ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান তাঁর নেতৃত্বাধীন দুদককে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্র’ করে ফেলার অভিযোগ তুলেছিলেন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে।) আমাদের একান্ত চাওয়া হলো শুধু বিরোধী দলের রাঘব বোয়াল নয়, এবার জেলের ভাত খাওয়াতে হবে ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়ালদেরকেও। তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করে আদালতের রায়ে তাদেরও শাস্তিবিধান নিশ্চিত করার মাধ্যমে শায়েস্তা করতে পারলে দুদকের প্রতি জনগণের হারানো আস্থাফেরানোর বাতাবরণ সৃষ্টি হতে দেরি হবে না। মনে রাখতে হবে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যাত্রাপথে এক নম্বর প্রতিবন্ধক রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি। একইসাথে, দেশের বিনিয়োগযোগ্য পুঁজিকে বিদেশে পাচারকারী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও সামরিক–বেসামরিক আমলারাই জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত হয়েছে। এখন আর বাংলাদেশ বিশ্বের দেশসমূহের খয়রাত–নির্ভর ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ নয়, স্ব–চালিত উন্নয়ন অর্জনের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে আমাদের দেশটি। আর, এই অগ্রযাত্রাকে নস্যাৎ করে দিতে চাচ্ছে উপরে উল্লিখিত জাতিদ্রোহিরা।
এদেরকে দমন করতে হলে জাতির প্রধান বর্শাফলকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই হবে দুদককে। ক্ষমতাসীন মহলকে ভয় করলে চলবে না, দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়াল সরকারি দল (বা জোটের) নাকি বিরোধী দলের(বা জোটের) ঐ বাছবিচার করা যাবে না। অতীতের দুর্নীতি দমন ব্যুরো এবং ২০০৪ সালে এর উত্তরাধিকারী হিসেবে জন্মগ্রহণকারী দুর্নীতি দমন কমিশন এখনো অকার্যকারিতা এবং পক্ষপাতিত্বের এই বদনাম (সঠিক কিংবা বেঠিক হোক্) কাটাতে পারেনি। ২০০৪–২০০৬ সালের দুদক দুটো বছর স্রেফ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল তদানীন্তন বিএনপি–জামায়াত সরকারের ইচ্ছানুসারে। ২০০৭–৮ সালের দুদক বাঘের মূর্তিতে দেশের তাবৎ দুর্নীতিবাজদেরকে একটা ‘প্রবল ঝাঁকি’ দিতে পেরেছিল, তা–ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে বসে শাসন ক্ষমতা প্রয়োগের প্রকৃত ক্ষমতাধর মহল সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের ইচ্ছানুসারেই। এখন যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়ে চলেছেন যে ‘দুর্নীতিবাজদেরকে আর একচুলও ছাড় দেয়া হবে না’ তখন দুদককে আবারো ব্যাঘ্রমূর্তি ধারণ করে তাদের পবিত্র মিশনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, যাতে এই নির্বাচনের বছরে জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে দুদকের কাজে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সকল সাহায্য–সহায়তার অভাব হবে না কিংবা নিদেনপক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে দুদকের কাজে কোনরকম হস্তক্ষেপ করা হবে না। (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকবার ঘোষণা দিয়েছেন তাঁকে কেনা যায় না। কিন্তু, যেহেতু তিনি সরকার–প্রধান তাই তাঁর আমলে যারা নানাভাবে দুর্নীতির মোচ্ছব চালাচ্ছে তাদেরকে শায়েস্তা করার প্রাথমিক দায়িত্ব তাঁর উপরেই বর্তায়। নয়তো তাঁকেও দুর্নীতির দায়ভার নিতে হবে।) দুদকের জন্যে এটাই আজকের চ্যালেঞ্জ। বেগম জিয়া দেশের বৃহত্তম বিরোধী দলের শীর্ষনেত্রী, অতএব তাঁর নেতৃত্বাধীন বিএনপি এবং ২০–দলীয় জোট জিয়া অরফানেজ মামলার রায়কে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন আখ্যায়িত করে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করে তুলবেই। ২০১৮ যেহেতু নির্বাচনের বছর তাই এই রাজনৈতিক উত্তাপকে সংঘাত ও সন্ত্রাসের পথেও নিয়ে যাওয়ার আশংকাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। জামায়াত–শিবির এবং তাদের গোপন জঙ্গি সংগঠনগুলো আগামী দিনগুলোতে ‘শত্রু–রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের মদদে বাংলাদেশকে আবারো জঙ্গি–সন্ত্রাসীদের লীলাভূমি বানানোর অপপ্রয়াস যে জোরদার করবে তা–ও মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। অতএব, ২০১৮ সালটি দেশের জন্যে প্রচন্ড রাজনৈতিক ঝড়–ঝাপটার বছর হবে ধরে নিয়েই জাতিকে এগোতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেভাবে গতিশীলতা অর্জন করে চলেছে সেটা পাকিস্তানের সমর–প্রভুরা নীরবে মেনে নেবে না, এটাকে নস্যাৎ করার জন্যে তারা আইএসআইকে লেলিয়ে দেবে—এটাই স্বাভাবিক! এতদ্সত্ত্বেও দেশের দুর্নীতি দমন অভিযানকে প্রকৃত বিচারে জোরদার করা গেলে তার রাজনৈতিক ফায়দা ২০১৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনাই পাবেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। একমাত্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা গেলেই এদেশের জনগণের মধ্যে গেড়ে বসে থাকা anti–incomebent sentiment সফলভাবে মোকাবেলা করা যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
লেখক : অর্থনীতিবিদ; ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
(সংগৃহীত)