![অনিন্দ্য চিত্রকল্পে একুশের কবিতা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/02/24/21-february_127354.jpg)
দিলীপ কুমার বড়ুয়া, ২৪ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : ভাষা সংগ্রামের গৌরবগাথা বাঙালির জীবন প্রবাহে এক নতুন প্রত্যয় ও প্রতীতী দান করেছে। কালপরিক্রমায় এর তাৎপর্যের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। বাঙালিরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাই বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির ইতিহাস কালজয়ী ইতিহাস । রক্ত নদী সাঁতরে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার ইতিহাস। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি অদম্য শক্তি আর অয়োময় প্রত্যয়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিল তারুণ্যময় ছাত্র যুবা। একুশের সিঁড়ি বেয়ে বাঙালি জাতির সূর্যসন্তানেরা প্রাণিত হয়েছে ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনায়। ভাষা আন্দোলনের বেগবান ধারায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছিল বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের নবজাগরণে। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাশাণিত শব্দস্রোতে সাহিত্যধারায় সূচিত হয়েছিল নবযুগের। বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে তথা কাব্যসাহিত্যে ভাষা আন্দোলন এর চেতনার প্রভাব এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। দেশের কবি–সাহিত্যিকরা সাহিত্যধারায় নব কল্লোলে সৃষ্টি করেছিল এক সাহিত্যময় নবযুগ।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও ক্ষোভের অনুভূতি নিয়ে চট্টগ্রামে বসে মাহবুব–উল আলম চৌধুরী লিখেছিলেন একুশের প্রথম কবিতা ‘ কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি ’। কবি মাহবুব–উল আলম চৌধুরী একুশের প্রথম কবিতা ’কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ তে বেদনাদীর্ণ বুকে ভাষা শহীদদের মর্মবিদারী চিত্র তুলে ধরে তাদের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে অনিঃশেষ প্রেরণায় প্রতিবাদের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। অনবদ্য কাব্যিক প্রতিবাদের বজ্রশাব্দিক দোত্যনা ছড়িয়েছিল তাঁর কবিতার প্রতিটা লাইনে– এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার নিচে/যেখানে আগুনের ফুলকীর মতো/এখানে–ওখানে জ্বলছে রক্তের আল্পনা, /সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।…যারা আমার অসংখ্য ভাই বোনকে হত্যা করেছে, /যারা আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায় অভ্যস্ত/মাতৃ সম্বোধনকে কেড়ে নিতে গিয়ে/আমার এইসব ভাই বোনদের হত্যা করেছে/আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি…। …যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে/ যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে/আমরা তাদের কাছে/ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ/আমরা এসেছি খুনী জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।
কবিতায় রমনার রৌদ্র ঝলসিত কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙের পাপড়ি আচ্ছাদিত রাজপথকে ভাষার দাবিতে ভাষা সংগ্রামীরা শোণিতে রাঙিয়েছিল । কবি তাঁদের আকস্মিক মৃত্যুতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ক্রোধের, ক্ষোভের, ঘৃণার, প্রতিশোধের বার্তা দিয়েছিলেন পাকিস্তানিদের। যারা বাঙালি ও বাংলা ভাষা, মায়ের ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে বাংলার তরুণ যুবাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে কবি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছেন। কবি তাঁর কাব্যিক ক্যানভাসে ভাষা শহীদদের প্রতিটি রক্তকণায় প্রতিবাদী ভাষার চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন । একুশের প্রোজ্জ্বল ভাবনায় আরো অনেক তরুণ তুর্কির মতো ভাষাশৈলীর অনন্য আবেগে ভাষাসৈনিক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ভাষা শহীদদের নিয়ে লিখেছেন তাঁর প্রথম ও বিখ্যাত কবিতা ’কোন এক মাকে’। আবেগের ফলগুধারায় তিনি একজন মায়ের ছেলের জন্য অপেক্ষার হৃদয়মথিত কথামালার চিত্রকল্প কবিতায় সাজিয়েছেন । যখন ”কুমড়ো ফুলে ফুলে/নুয়ে পড়েছে লতাটা,/সজনে ডাঁটায়/ভরে গেছে গাছটা; যখন ডালের বড়ি শুকিয়ে সন্তানের জন্যে অপেক্ষা করছেন মা; ছেলে তখন মাতৃভাষাকে রক্ষা করবার আন্দোলনে চিঠিতে লিখেছেন : ’মাগো, ওরা বলে,/সবার মুখের কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা, তাই কি হয়?/তাই তো আমার ফিরতে দেরি হচ্ছে।/তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে তবেই না বাড়ি ফিরবো।/লক্ষ্মী মা, রাগ ক’রো না,/মাত্রতো আর কটা দিন’।” কিন্তু ছেলে তার বাড়ি ফেরে না। ছেলের বদলে মায়ের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলের ছিন্ন–ভিন্ন লাশ! কবির ভাষায়– ঝাপসা চোখে মা তাকায়/উঠোনে উঠোনে/যেখানে খোকার শব/শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।
সবকিছু ছাপিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক,শীর্ষ কলাম লেখক ভাষাপ্রেমী আবদুল গাফফার চৌধুরীর আমার ভাইয়ের রক্তের রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি কবিতাটি। যা প্রথমে আবদুল লতিফ, পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরে গান হয়ে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই এ গানটির করুণ সুর আমাদের আন্দোলিত করে আবেগমিশ্রিত শাব্দিক ব্যঞ্জনায়। অবিকল্প আবাহনে বাঙালির অস্তিত্ব জুড়ে এ গান অনুরণিত হবে যুগ যুগান্তরে।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বরেণ্য সাহিত্যিক আলাউদ্দিন–আল–আজাদ আবেগের পঙক্তিমালায় সাজিয়েছেন তাঁর চেতনালালিত স্মৃতিস্তম্ভ কবিতাটি। ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক/একটি মিনার গড়েছি আমরা চার কোটি কারিগর/বেহালার সুরে রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়। পলাশের আর/রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়/দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন/যুগে যুগে সেই শহীদের নাম/এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিখায়, তোমাদের নামে তাই আমাদের/হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক শপথের ভাস্কর।
‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের অবিসংবাদিত সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান ‘অমর একুশে’ কবিতায় প্রকাশ করেছেন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারদের মর্মন্তুদ কাহিনী বিন্যাসে ভরা বিষণ্ন আবেগ। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর কবিতার প্রতিটা লাইনে অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন অদম্য প্রাণপ্রবাহে। মাতৃভাষার সম্মানের জন্যে যারা যুথবদ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞায়, প্রতিরোধে, প্রতিবাদে দাঁড়িয়েছিল, শত্রশুরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে শুদ্ধ চেতনার দেহগুলো । কিন্তু তাদের গৌরবদৃপ্ত উর্বর চেতনাকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর কবিতায় একুশের অভিজ্ঞতার পলিমাটিতে গড়া উর্বর চেতনাকে বিধৃত করেছেন উপলব্ধির মধ্য দিয়ে –একটি দিন আগেও বুঝতে পারি নি, /কি আশ্চর্য দীপ্তিতে তোমার কোটি সন্তানের প্রবাহে–প্রবাহে/সংক্রমিত হয়েছে -/একটি দিন আগেও তো বুঝতে পারি নি দেশ আমার।/শহীদের বাঙালির জীবনে সঞ্চারিত করেছে এক অদম্য শক্তি : /তাদের একজন আজ নেই; /না, তারা পঞ্চাশজন আজ নেই।/আর আমরা সেই অমর শহীদদের জন্যে,/তাঁদের প্রিয় মুখের ভাষা বাংলার জন্যে একচাপ পাথরের মতো/এক হয়ে গেছি/হিমালয়ের মতো অভেদ্য বিশাল হয়ে গেছি। একুশের শহীদের নাম প্রথম কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। যে কবিতায় সে নামগুলো উচ্চারিত বেদনার্ত হৃদয়ের আকুতি আর গৌরবের অহংকারে। সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার– কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম; /এই এক সারী নাম বর্শার তীক্ষ্ন ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে ।…যাদের হারালাম তারা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল/দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে,/কণা কণা করে প্রাণে দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়ে গেল /দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে/আবুল বরকত; সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার/কি আশ্চর্য, কি বিষণ্ন নাম! এক সার জ্বলন্ত নাম।
’একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনটিতে শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন,আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক ’একুশের কবিতা’ শিরোনামে কবিতা লিখেছিলেন। শামসুর রাহমান লিখেছিলেন – প্রমিথিউসের গানের মতো আমার গলার রৌদ্রোজ্জ্বল চিৎকার/কাঁপিয়ে দেবে এই পৃথিবীর আকাশ–বাতাস, /ফেটে চৌচির হয়ে যাবে মিশরীয় স্ফিংসের ’বিরতা /খসে যাবে তোমাদের রাত্রির দীপ্তিমান তারা, দিনের সূর্য। ’একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনটিতে ফজলে লোহানী মৃত্যুঞ্জয়ী লড়াকু ভাষা শহীদদের নিয়ে কবিতায় স্মৃতিকাতর মুহূর্তকে তুলে ধরেছেন– মৃত্য্যুক যারা ভয় করেনি, /মৃত্যু তাদের বরণ করেছে, /এ খবর গিয়ে গাঁয়ে পৌঁছেছে/সবার মুখেই বজ্রশপথ : /হাতুড়ি আমরা নামিয়ে নিলাম/কাস্তে–কোদাল থামিয়ে দিলাম/কাঁচা শহীদের স্মৃতির ভারে।
একুশের চেতনা দীপ্তি ছড়িয়েছিলো সুফিয়া কামালের কবিতায় অকৃপণ ভাষাপ্রেমের প্রাঞ্জল বাক্য বিন্যাসে। তিনি লিখেছিলেন – ’মৃত্যুতে করে না কেহ শোক,/মৃত্যুরে করে না ভয়, শঙ্কাহীন, কিসের আলোক/উদ্ভাসিত করে তোলে ক্লান্ত দেহ, মুখ, পদক্ষেপ/সংকল্পের দ্যুতি তরে দৃঢ়তার প্রচার প্রলেপ/করেছে ভাস্বর।/অমর একুশে/অজেয় হয়েছে বাংলা ভাষা রক্তে মিশে’ (একুশের কবিতা)। কবি দিলওয়ার একুশের চেতনাকে দ্রবীভূত করেছেন বাংলার মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে তাঁর ’দিলওয়ারের একুশের কবিতা’ সংকলনে এভাবে– নদী ও বৃষ্টির জলে যে দেশে শস্যেরা অফুরান : /দ্বৈমাত্রিক সেই দেশে সাহসী একুশে অনির্বাণ!
সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায় একুশের মহিমা কীর্তিত। সেদিন আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, /চেতনার পথে দ্বিধাহীন অভিযাত্রা/নানান মুখীন হাজার লোকের/একত্র অস্তিত্ব /একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশের চেতনাদীপ্ত অজস্র কবিতার মিছিলে সিকান্দার আবু জাফর ও তাঁর একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতায় স্মৃতিজাগানিয়া অনিন্দ্য চিত্রকল্পের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন শুদ্ধতম অনুভূতি প্রকাশে– আমার কালে/ইতিহাসের সর্বশেষ পথের বাঁকে/এসে দেখলাম : /অকস্মাৎ জমাট বেঁধে যাওয়া/পুঞ্জীভূত প্রতিবাদে তৈরি/আর একটি স্মৃতিস্তম্ভ।/চতুর্দিকে তার/জমাট রক্তের পুরু আচ্ছাদন।/পরিচয়হীন ফলকে লিপিবদ্ধ : /২১শে ফেব্রুয়ারি।
ভাষাসৈনিক এবং অন্যতম কলাম লেখক আহমদ রফিক একুশে চেতনার গভীরতম প্রদেশে স্বদেশের বহমান ইতিহাসে অন্বিষ্ট ছিলেন কবিতার ছন্দে– ’একুশে অলক্ত পথে বেসে যাক ক্লীবতায় ঢাকা/ নিস্তব্ধ করুণ বাংলা, নামুক আকাশ/যে আকাশ বিদ্যুতের লক্ষ্যভেদে আশ্চর্য নিপুণ,/আমার অন্বিষ্ট সেই ইতিহাস বহমান প্রদীপ্ত একুশ/যে তার স্মৃতির স্তম্ভে এঁকে গেছে দ্বিতীয় স্বদেশ’ (আমার অন্বিষ্ট সেই)।
মাতৃভাষার চেতনা, মাতৃভূমির অস্তিত্ব আর সামগ্রিকভাবে মানুষের সংগ্রাম বাঙালির সত্তায় মিশে আছে। বাংলার কবি শামসুর রাহমান পাকিস্তানি জান্তা ও তার দোসরদের আগ্রাসনে দুঃখিনী বর্ণমালার বিপন্নতায় ব্যথিত হয়ে কাব্যিক নান্দনিকতায় আমার দুঃখিনী বর্ণমালা কবিতার প্রতিটা ছত্রে দ্রোহে প্রকাশ করেছেন তাঁর অভিব্যক্তি – নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।/মমতা নামের পূত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সর্বদাই। … তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো, কী থাকে আমার? /উনিশ শো বায়ান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।/সে–ফুলের একটি পাপড়ি ছিন্ন হলে/আমার সত্তার দিকে/কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।/… … … /তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, /বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা। ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতায় একুশের চেতনাকে তিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে দৃপ্ত আবেগময়তায় উপক্ষাপিত করেছেন – আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে/কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো বা/একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয় – ফুল নয়, ওরা/শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদবুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।/একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ। ভাষা শহীদদের পুনরাগমনের দৃশ্যপট এঁকেছেন নিপুন শিল্পের কলা কুশলতায় – বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও/আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,/ বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।/সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা, / সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা, /সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।
মাতৃভাষার প্রতি নিঃশঙ্ক চিত্তে আধুনিক নাগরিক চেতনার কবি শহীদ কাদরী লিখেছেন ’যখনই চিৎকার করি/দেখি, আমারই কণ্ঠ থেকে/অনবরত/ঝরে পড়ছে অ, আ, ক, খ’ (একুশের স্বীকারোক্তি)। কবির এ যে ভাষার প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা তারই প্রতিফলন প্রতিটা বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার অতুল্য আলোকিত ইতিহাসের প্রতিটা অধ্যায়ে।
অনিবার্য প্রেরণা নিয়ে দাউদ হায়দার, হায়াৎ মামুদ, রফিক আজাদ, সিকদার আমিনুল হক, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসান, আসাদ চৌধুরী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, জুলফিকার মতিন, শিহাব সরকার, আবিদ আনোয়ার, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ কবির কবিতার ক্ষেত্র জুড়ে রয়েছে একুশের চেতনাপ্রসূত বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের কথা। নির্মলেন্দু গুণ দেখেছেন একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য। লিখেছেন ’আমার আঙুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে/জনতার হাতে হাতে।
শামসুর রাহমান যেখানে দেখেছেন প্রভাতফেরির অলৌকিক ভোর, সেখানে সমকালীন কবি মহাদেব সাহার তোমরা কি জানো কবিতার অভিব্যক্তি– আকাশে ভেসে থাকা শোকার্ত মেঘ, / মাটির জমিনে পড়ে থাকা থোকা থোকা শিশিরের বিন্দু/ আদতে এগুলো মেঘ কিংবা শিশির বিন্দু নয়। /এগুলো একুশের ভাষা শহীদের প্রিয়জনের তপ্ত অশ্রু।…… তোমরা কি জানো, /এ শহর কেনো হঠাৎ এমন/মৌন মিছিলে হয়ে ওঠে ভারী, অশ্রুসিক্ত? কবির চিত্রকল্পে ফুঠে ওঠা রঙিন আলপনাকে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে– একুশের রাজপথ জুড়ে এতো রঙিন আলপনা আঁকা/তোমরা কি জানো সে তো নয় কোন রঙ ও তুলির ব্যাঞ্জনা কিছু/এ আলপনা, পথের শিল্প শহীদের তাজা রক্তের রঙ মাখা!
ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতায় আহ্বান করেছেন নতুন প্রজন্মকে – হে নতুন প্রজন্ম!/ভুলে যেয়ো না সেইসব কিশোরের কথা/যারা একদিন কচি গলায়/বাংলাদেশের সব শহরের রাস্তায় রাস্তায়/অজস্র কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ ফুলের গন্ধে/ফুটিয়ে তুলেছিল আরেক রকম রক্ত–লাল–ফুল; /রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!
একুশের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত কবিতায় কবিদের অনুভূতির বর্ণনায় কখন ও ফুটে উঠেছে সন্তানহারা মায়ের নির্মম প্রতীক্ষা আবার কখন ও তীব্র ঘৃণার অক্ষর বাণে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। একুশের কবিতাগুলোর মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের মাঝে সঞ্চারিত হবে একুশের ইতিহাস, ভাষাপ্রেমের সংগ্রামী আখ্যান ।
একুশের হাত ধরে বাঙালি জাতির যে পথচলা শুরু হয়েছিল তা বাঙালির আবেগ–অনুভূতি, সংগ্রাম ও দেশীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে পূর্ণতা পাবে এবং বিশ্বজনীন স্বীকৃতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে একুশের স্ফূরিত চেতনা চির অক্ষয় হয়ে থাকবে।
বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির পর থেকে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণ দিবস উপলক্ষে আমাদের দেশে অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ উপন্যাস , ছোটগল্প , ছড়া এবং সংকলন প্রকাশিত হয়ে আসছে । ভাষা শহীদদের প্রতি অকৃত্রিম আবেগের প্রকাশ ঘটেছে মুদ্রিত কবিতায় । সাহিত্যের ভান্ডার প্রতি বছর সমৃদ্ধ হচ্ছে নবীন প্রবীণ কবি, সাহিত্যিকদের সৃজনশীল রচনায় । তারপর ও একুশের শহীদদের নিয়ে যত কবিতা লেখা হয়েছে তা এখনো কালোত্তীর্ণ হয়নি।
সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙে জেগে উঠার স্বপ্নের সাথে একুশের স্বপ্নের প্রসারিত চেতনাকে ধারণ করে বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ার প্রয়াসে নতুন প্রজন্মকে দায়িত্ব নিতে হবে। মায়ের ভাষার প্রতি বিরল সম্মানের এ দিনটিকে বিশ্ববাসীও স্বীকৃতি দিয়েছে। এ দিনটি তাই শুধু আমাদের বাঙালি জাতির নয়। সমগ্র বিশ্ববাসীর মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্মরণে , ভাবনায়, জাগরণে, চিন্তনে ও সৃজনে বহমান থাকবে অনাদিকাল এবং ভাষা শহীদরা পূজিত হবেন আন্তর্জাতিকভাবে একুশের ভাষা সংগ্রামের প্রসারিত চেতনায়।
লেখকঃ উপ–রেজিস্ট্রার, ইউএসটিসি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।
(সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি