মেহেরুন্নেছা মেরী, ২৫ ফেব্রুয়ারি, এবিনিউজ : জহির রায়হান বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত চলচ্ছিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, এবং গল্পকার। তিনি বাঙালির এক প্রবাদ পুরুষ । সংস্কৃতি ও রাজনীতি অঙ্গনের এই কৃতী পুরুষের মূল পরিচয় তিনি একজন সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার। রাজনৈতিক আদর্শে বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন বাঙালির এই বীর সন্তান। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক– সর্বোপরি একজন প্রতিবাদী মানুষ; যিনি ঐতিহ্যকে লালন করেছিলেন নিজের বিশ্বাসে বলীয়ান থেকে। বাংলার এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া দোসর বিহারীরা। তার অন্তর্ধানের দীর্ঘ আটাশ বছর পর্যন্ত তাকে অপহরণ করে গুম করে ফেলার খবর প্রচার করা হলেও পহেলা সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ দৈনিক ভোরের কাগজের এক রিপোর্টে বেরিয়ে আসে জহির রায়হান খুনের আসল রহস্য। এরই মধ্য দিয়ে পুরো জাতি জানতে পারে ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল জহির রায়হানকে। জহির রায়হানের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জহিরউল্লাহ। তাঁর ডাক নাম ছিল জাফর। ছোটবেলাতেই তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার ও বড় বোন নাফিসা কবির বাম ধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকেই জহির রায়হানের বামপন্থী চিন্তা–চেতনায় দীক্ষিত হন। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে তিনি ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। এ সময় ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয়। তিনি সচেতনভাবে যুক্ত হন ভাষা আন্দোলনের সাথে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলা বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যে ১০জনের দলটি প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেপ্তার হন, জহির রায়হান ছিলেন তাঁদের অন্যতম। নিপুণ দক্ষতার সাথে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্পে খুব অল্পসময়ে নিজেকে বিকশিত করেন জহির রায়হান। তাঁর নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামাণ্য চিত্রগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বমানবতার টনক নাড়িয়ে দেয়। জহির রায়হানের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো হলো– কখনো আসেনি (১৯৬১), সোনার কাজল (১৯৬২), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সংগ্রাম (১৯৬৪ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বপ্রথম রঙিন চলচ্চিত্র), বাহানা (১৯৬৫), বেহুলা (১৯৬৬), আনোয়ারা (১৯৬৬), দুই ভাই (১৯৬৮), জীবন থেকে নেয়া (১৯৬৯) ও ইংরেজি ভাষায় There Be Light । ১৯৫৫ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্র’ সূর্যগ্রহণ ও ১৯৬০ সালে প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে প্রকাশিত হয় । পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৫০ সালে ”যুগের আলো” পত্রিকা দিয়ে তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন ও পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। উল্লেখ্য, ১৯৫৬ সালে ’প্রবাহ’ পত্রিকায় জহির রায়হান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ’সঙ্গম’ নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তাঁর প্রথম সিনেমা স্কোপ চলচ্চিত্র ’বাহানা’ মুক্তি দেন। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে
জহির রায়হানের লেখা ”একুশে ফেব্রুয়ারী” ও ”আরেক ফালগুন” নামক উপন্যাস দুটি তাঁর অনবদ্য রচনা । এছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে– সূর্যগ্রহণ, শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আর কতদিন, কয়েকটি মৃত্যু, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা প্রভৃতি। পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৫০ সালে ”যুগের আলো” পত্রিকা দিয়ে তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন ও পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন । উল্লেখ্য, ১৯৫৬ সালে ’প্রবাহ’ পত্রিকায় জহির রায়হান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ’সঙ্গম’ নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তাঁর প্রথম সিনেমা স্কোপ চলচ্চিত্র ’বাহানা’ মুক্তি দেন। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে জহির রায়হানের লেখা ”একুশে ফেব্রুয়ারী” ও ”আরেক ফালগুন” নামক উপন্যাস দুটি তাঁর অনবদ্য রচনা। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে– সূর্যগ্রহণ, শেষ বিলেকের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আর কতদিন, কয়েকটি মৃত্যু, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা প্রভৃতি ।
জহির রায়হানের অন্যতম অসমাপ্ত একটি কাজের কথা আমরা ভুলতে বসেছি । সে কাজটি হচ্ছে
“একুশে ফেব্রুয়ারি”। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস। তবে আয়তনের স্বল্পতার কারণে এটিকে উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা বলা যেতে পারে। বড় গল্প বলাটা হবে অধিকতর শ্রেয়।তবে উপন্যাস, উপন্যাসিকা বা বড় গল্প যে নামেই এটিকে ডাকা হোক না কেন, একটা কথা মানতেই হবে যে জহির রায়হানের এই ’একুশে ফেব্রুয়ারি’ নিঃসন্দেহে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারির সেই রক্তঝরা দিনের ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা রচনা। এর আগে ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে তেমন কোন উপন্যাস আমার চোখে পড়েনি। নিঃসন্দেহে জহির রায়হানের এই উপন্যাসটি একটি সেরা উপন্যাস । শুধু সেরাই নয়, এ বিষয়ের একেবারে প্রথম দিককার রচনাও বটে।পরবর্তীকালে এবং সাম্প্রতিক ও বর্তমান সময়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর অনেক লেখা হচ্ছে। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, ছড়া ইত্যাদি। সেগুলোর অনেকগুলো আবার পরিধিতে বিশালাকার।বিপুল গবেষণালব্ধ তথ্যের সন্নিবেশন ঘটছে সেগুলোতে।একুশে ফেব্রুয়ারি ও তার আগে পরের ঘটনাপ্রবাহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা স্থান পাচ্ছে। কি‘ জহির রায়হানের ’একুশে ফেব্রুয়ারি’তে তার কিছুই নেই। নিজের টিপিক্যাল স্টাইলে রচিত একটি রচনা এটি, যেখানে খুব সাদামাটা ভাষায়, সহজ সরলভাবে শুধু কয়েকজন মানুষের কথা বলা হয়েছে। সেসব মানুষের সামগ্রিক চরিত্র নিয়েও অবশ্য বিন্দুমাত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেন নি লেখক। স্রেফ একুশে ফেব্রুয়ারির আগের প্রহর ও একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটায় কয়েকজন মানুষ ঐ বিশেষ দিনটি নিয়ে কি ভাবছিল, কি কি করছিল, দেশের ক্রান্তিকালে তাদের মনে কি ঝড় চলছিল, ব্যক্তি জীবন ও জাতীয় জীবনের দ্বন্দ্ব তাদের মনে কিরকম দোলাচলের সৃষ্টি করছিল তা কোন অলংকার ছাড়াই তুলে ধরেছেন এই খ্যাতিমান কলম সৈনিক । এই উপন্যাসের মানুষগুলোর, চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত জীবনকে,অনুভূতি গুলো একটু একটু করে ছুঁয়ে গেছেন তিনি। ঐ মানুষগুলোর ব্যক্তি সত্তার সাথে একুশে ফেব্রুয়ারির চলমান পরিস্থিতি ঠিক কিভাবে একই সাথে প্রবাহিত হচ্ছিল, আর কিভাবে তাদের জীবনের প্রেক্ষাপট ও সামগ্রিক জীবন এই দুই–ই এক মোহনায় এসে মিলল, কিভাবে নিজেদের অজান্তেই তারা এক অমোঘ লড়াইয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দিল – সেসব কথার সাবলীল ধারাবর্ণনা স্থান পেয়েছে এই রচনায়।“একুশের চেতনা” ও “বাংলাদেশের স্বাধীনতা ” শব্দ দুটির অর্থবোধক মানে আলাদা হলেও একটির সাথে আরেকটির সম্পর্ক গভীর ভাবে জড়িত । একটি ছাড়া অন্যটি আমরা ভাবতে পারি না, পারাও সম্ভব নয় । বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের ঊষালগ্নের পাক–ভারত উপমহাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার ঝড় উঠে তার প্রথম প্রতিফলন ফুটে ওঠে ৫২র ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে । আর বাঙালির সেই প্রথম স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পাথেয় হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ এই ছয়টি বছর ধরে পাকিস্তানের ইতিহাস হচ্ছে গুটিকয়েক ক্ষমতা লিঞ্ঝু, কায়েমি, সার্থবাদী, আমলা মুৎসুদ্দি, সামন্ত প্রভু, ধনপতি, মদ্যপ বদ্ধোম্মাদ রাজনৈতিক স্বার্থ শিকারির প্রসাদ ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের গুপ্ত পথ বেয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন জেনারেল আইয়ুব খান । বাঙালির আশা– আকাঙক্ষার বুকে পদাঘাত করে সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করলেন তিনি। বাঙালির বাক– স্বাধীনতা, ব্যক্তি– স্বাধীনতা, সভা–সমিতি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমস্ত হরণ করে নিয়ে বাংলার মানুষকে অবাধ শোষণের পথ উন্মুক্ত করলেন জেনারেল আইয়ুব খান ও তার সামরিক জান্তা ।
১৯৬২ সালে ঢাকার রাজপথে আবারো শহীদের রক্ত ঝরলো। রক্তের ধারা আবার প্রবাহিত হলো ঢাকার রাজপথে ১৯৬৪ সালে। কিন্ত এই দুর্বার আন্দোলনের পথ বয়ে এলো ১৯৬৯ সাল । বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা আর ১১ দফার দাবিতে বাংলার ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ ঐক্যবদ্ধ এক দুর্বার গণ–আন্দোলনের জন্ম দিলো। অসংখ্য শহীদের রক্তে রাঙা হলো পূর্ব বাংলার শহর–বন্দর–নগর । শহীদের অমরত্ব লাভ করলেন আসাদ, জোহা, জহুরুল হক সহ আরো অসংখ্য দেশপ্রেমিক । জহির রায়হান ও এ আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পরলেন। সেদিনে দুঃসহ রাতগুলো তিনি তুলে আনতে চাইলেন তার এই উপন্যাসে। একুশের চেতনাকে পুঁজি করে, কাব্য ধর্মী এক অসামান্য শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে শুরু ও শেষ হওয়া এই রচনা পাঠকের চোখের সামনে একুশে ফেব্রুয়ারির চিত্রকে অতি বাস্তবরূপে হাজির করেছিলো । জহির রায়হানের অন্যতম অসমাপ্ত একটি কাজ ইতিহাসের অতলে চাপা পড়ে গেলো। সে কাজটি হচ্ছে “একুশে ফেব্রুয়ারি”। একুশে ফেব্রুয়ারি মূলত চলচ্চিত্রের কনসেপ্ট হিসাবে উনি বানিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালেই তিনি এই কাজটি করতে চেয়েছিলেন। কিন্ত তৎকালীন সরকার থেকে অনুমোদন পান নি চলচ্চিত্রটি করার। তিনি ভেবেছিলেন এই কাজটি তিনি সুযোগ পেলেই করে ফেলবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনুমোদন আর পাওয়া যায় নি পাকিস্তান সরকার থেকে। জহির রায়হানকে হারানোর পর আমাদের আসলে কি বিশাল পরিমাণ ক্ষতি হয়ে গেছে তা আমরা এই একটি স্ক্রিপ্টের ঘটনা থেকেই বুঝতে পারি। এই স্ক্রিপ্টটি চলচ্চিত্রায়িত হতে না পারার ফলে আমরা চলচ্চিত্রের দিকে আমাদের বায়ান্নর ইতিহাসকে একদম বাদ দিয়ে দিয়েছি বললেই চলে। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে আমাদের অনেক চলচ্চিত্র হয়েছে কিন্তু বায়ান্ন নিয়ে আমাদের আর কোনো উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রই হয় নি। এটি আমাদের জন্য বিশাল একটি আফসোস। এই চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্টটি পরবর্তীতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবির (জহিরের চাচাতো ভাই) এর চাপাচাপিতে মাসিক “সমীপেষু” তে “একুশে ফেব্রুয়ারি”র স্ক্রিপ্টটি প্রকাশিত হয়। আমরা আজকে একুশে ফেব্রুয়ারির যে গল্প পাই সেটি আসলে চলচ্চিত্রের সেই স্ক্রিপ্টটিই।। এই স্ক্রিপ্টটি যদি চলচ্চিত্রে পরিণত হত নিঃসন্দেহে বলা যায় বায়ান্নর একটি দলিল হয়ে থাকতো এই একুশে ফেব্রুয়ারি । (সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি