![বাঙালির মার্চ-অগ্নিঝরা মার্চ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/01/kamrul-hasan_128160.jpg)
কামরুল হাসান বাদল, ০১ মার্চ, এবিনিউজ : শত শত বছরেও একটি জাতি গঠিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হাজার বছর। কয়েক হাজার বছর ধরে একটি অঞ্চলের জল মাটি আবহাওয়ায় ধীরে ধীরে একটি জাতির রূপ গঠিত হতে থাকে। বাঙালি জাতির তাই। তবে বাঙালি একটি শংকর জাতি। বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি বর্তমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের কোনো কিছুই স্থির নয়, তেমনি বাঙালি জাতির চলমান বিবর্তনও থেমে নেই। থাকবে না। এক হাজার বছর পূর্বে বাঙালি জাতির যে বৈশিষ্ট ছিল তার পরিবর্তন ঘটেছে। ভবিষ্যতেও বিবর্তনের ধারায় বাঙালির বর্তমান অনেক বৈশিষ্ট্য লোপ পাবে। নতুন অনেক কিছু যোগ হবে। তা তার ভাষায়, সংস্কৃতিতে জীবনযাপন, পোশাক পরিচ্ছদ ও খাদ্যাভ্যাসে।
তবে বাঙালির পরিবর্তনের কিছু ঘটনা তার দীর্ঘ ইতিহাসের অনেক গৌরবজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে কেবল গত শতকের শেষভাগে এসে। ১৯৭১ সাল বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম কাল সংগ্রাম ও সফলতার কাল অহংকার ও গৌরবের কাল। এ সময়েই বাঙালি অর্জন করে তার প্রথম স্বাধীন ভূখন্ড। একটি পতাকা আর একটি মানচিত্র। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাঙালি নিজেকে নিজে শাসন করার সুযোগ ও সৌভাগ্য অর্জন করে। গত শতকের ৫০, ৬০ ও ৭০ দশক ছিল বাঙালির কয়েক হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সোনালী কাল।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ মূলত ক্ষমতার পালা বদল করেছিল এ ভূখন্ডে। ফলে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন তখনও ছিল বড় দুর্জেয় একটি কাজ। কিন্তু ভাষা আন্দোলন এর সফলতা ও বিস্তার বাঙালি জাতীয়তাবাদের অংকুরোদগম করে এবং বাঙালি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করার উজ্জীবিত করার এবং সে লক্ষে একটি নির্দিষ্ট পথে চলবার নেতৃত্ব দেওয়ার নেতা ছিল না বাঙালির। টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া, একটি অতি সাধারণ বাঙালি পরিবারের সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান জন্মই নিয়েছিলেন যেন বাঙালির সে শূন্যতাকে পূরণ করতে। বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে। যে তরুণ ১৯৪৭ সালের আগে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছিলেন সে তরুণেরই স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হয়নি তথাকথিত স্বাধীন পাকিস্তানে। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল তেইশ বছরের ব্যবধানে সেই তরুণের নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হলো বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ, ভাষার নামে যে দেশের নাম।
১২৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান কার্যত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন ৬ দফা মেনে নেওয়া মানে বাংলার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা তথা আলাদা সত্ত্বাকে মেনে নেওয়া। মেনে না নিলে স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার ব্যবস্থা করা।
মার্চ, অগ্নিঝরা মার্চ হচ্ছে বাঙালির গৌরবের, আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের ও বিপ্লবের এক মহাকাল। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পাঁচ বছরের ব্যবধানে আরেকটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হতে যাচ্ছে, তা যেন ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। মানুষ প্রতিক্ষণে ক্ষণে স্বাধীনতার জন্য উম্মাতাল হয়ে উঠছে আর প্রত্যাশা আর স্বপ্নের নায়ক হয়ে বঙ্গবন্ধু একটি প্রহরকে ‘কাউন্টেবল’ করে তুলছেন।
এ অগ্নিঝরা মার্চের মধ্যে সে প্রদীপ্ত দিনগুলোর মধ্যে সে অসাধারণ সংগ্রামময় ক্ষণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম হয়ে আছে ৭ ই মার্চ যেদিন রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু জাতির সামনে ভাষণ দিলেন। পাঠকরা জানেন এ ভাষণকে সম্প্রতি জাতিসংঘের ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ঘোষণা করে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। মার্চের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ তখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি পূর্বেও বলেছি, মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে দেশের পরিস্থিতি। পাকিস্তানি শাসনের বেড়াজাল ভেঙে পড়ছে। আর জনতার মধ্যে থেকে তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান উঠে আসছেন এক দেবদূতের মতো। মানুষ বিশ্বাস করছে ওই মানুষটি, ওই দেবদূতটি তাদের মুক্তির বার্তা নিয়ে আসছে। তাদের মুক্তি ও স্বাধীনতা সমাসন্ন।
৭ মার্চ মধ্যাহ্নের কিছু পরে জনসমুদ্রের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে তর্জনি উত্তোলন করে মুক্তির দূত শোনালেন বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবিতা। কারণ ততদিনে
বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কবি বলে অভিষিক্ত হয়ে পড়েছেন। কবিতার মতো করে তিনি উচ্চারণ করলেন, “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।” দাঁড়িবিহীন তিনটি বাক্য। অথচ তার মধ্যেই তিনি বাঙালির সকল দাবির কথা, মনের কথা ২৩ বছর ধরে সংগ্রামের কথা আর হাজার বছরের বঞ্চনা ও বেদনার কথা কী অকপটে উচ্চারণ করে গেলেন। তারপর কবিতার মতো করে যেন আবৃত্তি করলেন, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর–নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ বাংলার মানুষ বক্তৃতা আগেও শুনেছে। অনেক নেতার অনলবর্ষী বক্তব্যও শুনেছে কিন্তু এমন কাব্যিক, দ্ব্যর্থহীন আর সত্য উচ্চারণ এমনভাবে বলতে কখনো শোনেনি।
তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট–কাচারি, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট জজকোর্ট, সেমি–গভর্নমেন্ট দফতরগুলো ওয়াপদা, কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয় তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল; প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ বিশ্বের ইতিহাসে রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এমন বক্তৃতা বিরল। একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে একজন রাজনৈতিক নেতা হয়েও রাষ্ট্রের সমস্ত কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। মূলত ৭ মার্চ থেকে এই বাংলা পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। যদিও তিনি সরকারের কেউ নন তখনও।
এক অলৌকিক ক্ষমতার জোয়ারে তিনি ভাসছেন। জনতাকে ভাসাচ্ছেন এবং অমোঘ ভবিষ্যতের দিক নিদের্শনা প্রদান করলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি।’ যেন তিনি জানতেন, তিনি থাকবেন না। এই না থাকাটা তিনি শুধু কারাগারকেই বোঝাননি। কারণ তখনতো তাঁর জানার কথা নয় যে, ২৬ তারিখ মধ্যরাতে তিনি গ্রেপ্তার হবেন। এই না থাকাটা তিনি অনেক গভীর অর্থবহভাবে বুঝিয়েছিলেন। কারণ বাঙালির অধিকার আদায়ে, স্বাধীনতা ও মুক্তির আদায়ে তিনি সর্বদা প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
তিনি বর্তমানকে ভালোমতে বুঝেছিলেন বলে ভবিষ্যতকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন। তাই উচ্চারণ করেছিল এই ধ্রব সত্যের সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।’ তাঁর এ কথাটি কী দারুণভাবে সত্য হয়ে উঠেছিল!
ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যা করে প্রায় চার লাখ নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করে, দেশের সম্পদ ধ্বংস করেও তারা বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়।
বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ভাষণ তিনি শেষ করলেন অবিস্মরণীয় কয়েকটি বাক্যেণ্ড‘তোমাদের যাই কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবণ্ড এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’
শেষ করলেন অবিনাশী এক কবিতা দিয়েণ্ড এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
কী অদ্ভুত বিচক্ষণতায় এই মহান নেতা উপলব্ধি করেছিলেন স্বাধীনতা আর মুক্তি এক নয়। তিনি যে মুক্তির কথাও উচ্চারণ করেছিলেন তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে শেষ করা যাবে না। কারণ স্বাধীনতা আমরা অর্জন করতে পারি, তা নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছিও। কিন্তু সে কাঙিক্ষত মুক্তি দারিদ্র্য থেকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে অজ্ঞানতা–কুসংস্কার থেকে, বৈষম্য থেকে, কূপমন্ডুকতা থেকে নিষ্ঠুরতা, কপটতা, ভন্ডামী থেকে তা এখনও সুদূর পরাহত।
একাত্তরের মার্চ যারা দেখেনি। অগ্নিঝরা মার্চকে যারা প্রত্যক্ষ করেনি তারা কখনো অনুধাবন করতে পারবে না কী অসাধারণ জাগরণে জেগেছিল জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল জাতি। সে জাগরণের ফলে সে ঐক্যের ফলে স্বাধীন হয়েছিল বাঙালির প্রথম রাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে শোষণহীন ও সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। যারা একাত্তরের মার্চ দেখেনি তারা অরেকটি মার্চ তৈরি করতে পারে যে মার্চ আমাদের মুক্তির পথ সুগম করবে যেমন, একাত্তরের মার্চ করেছিল স্বাধীনতাকে।
(সংগৃহীত)