![প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির একটি বিকল্প প্রস্তাবনা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/02/exam_128224.jpg)
ড. নারায়ন বৈদ্য, ০২ মার্চ, এবিনিউজ : ১৯৭৪ সালে যখন উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে পড়াশুনা করছি তখন আমাদের সিলেবাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি পাঠ্য ছিল। লেখক উপন্যাসটি শুরু করেছিলেন এভাবেণ্ড ‘আমার এই ‘ভবঘুরে’ জীবনের অপরাহ্ন বেলায় ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে’ (যদি আমার ভুল না হয়)। প্রকৃতপক্ষে তিনি জীবনের মধ্যবয়সে সন্ন্যাস ধর্ম পালন করেছিলেন। এজন্যই হয়তো তিনি তার জীবনকে ‘ভবঘুরে’ বলেছিলেন। তিনি ১৯০৩ সালে ভাগ্যের সন্ধানে বার্মা (বর্তমানে মায়ানমার) যান এবং রেঙ্গুনে একাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে কেরানি পদে চাকরি করেন। ১৯১৬ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। তারপরে শুরু হয় তার ‘ভবঘুরে’ জীবন। এ ‘ভবঘুরে’ জীবনেই তার সাহিত্য সাধনা শুরু হয়। কিন্তু একজন চাকরিজীবী পরিণত বয়সে অবসরে গেলে তখনও তিনি নিষ্কর্মা হয়ে যান। বলা যায়, ঐ ব্যক্তির ‘ভবঘুরে’ জীবন শুরু হয়। তবে শরৎবাবুর ভবঘুরে জীবন আর অবসরে যাওয়া কর্মকর্তার ভবঘুরে জীবনের মধ্যে পার্থক্য আছে অনেক।
বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায় যারা নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে মতামত লিখেন তাদের অধিকাংশই অবসরে যাওয়া ব্যক্তি। তাঁরা তাদের কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করে সমসাময়িক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর উপর মতামত প্রদান করেন। বিভিন্ন সমস্যা কাটিয়ে উঠার সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে আলোচনা করেন। তাঁরা যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোন কাজের সাথে তেমন জড়িত নয় সেহেতু বলা যায় আমাদের মত অবসরে যাওয়া অধিকাংশ ব্যক্তি শরৎচন্দ্রের ভবঘুরে জীবনের মত সময় পার করে। কিন্তু এসব ব্যক্তির চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসে মহা মূল্যবান উপদেশ বা সমস্যার সমাধান। এ কথা জাতীয় জীবনে যেমন সত্য তেমনি ব্যক্তির জীবনেও সত্য। আজ আমাদের জাতীয় জীবনে দিবা রাত যে খবরটি সবার মুখে মুখে তা হল ‘প্রশ্ন ফাঁস’ এবং শিক্ষার মান। শিক্ষার মান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ মানসম্পন্ন শিক্ষা যদি আমাদের সন্তানদের দিতে না পারি তবে স্পষ্টতই পৃথিবীর অন্যান্য জাতি থেকে আমরা পিছিয়ে যাব। বিশ্ব প্রতিযোগিতার কাছে আমরা হেরে যাব। আর শিক্ষার মানকে নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রশ্ন ফাঁস। প্রশ্ন করে শিক্ষকেরা। সেই প্রশ্ন ছাপানো হয় বিজি প্রেসে। বিজি প্রেস থেকে প্রশাসনের সহায়তায় তালাবদ্ধ ও সীলগালা অবস্থায় কেন্দ্রভিত্তিক ট্রাংক প্রত্যেক উপজেলায় বা সদরে ট্রেজারিতে রক্ষিত থাকে। পরীক্ষার কয়েকদিন আগে প্রত্যেক কেন্দ্র সচিবকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয় প্রশ্নের পরিমাণ সঠিক আছে কিনা তা নির্দিষ্ট একটি তারিখে এসে ট্রেজারীতে পরীক্ষা করে দেখার জন্য। সদর ট্রেজারীতে তখন এডিসি (শিক্ষা) উপস্থিত থাকেন। আর উপজেলায় ইউ.এন.ও. এর একজন প্রতিনিধি ও উক্ত উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে কেন্দ্র সচিবের প্রতিনিধি (কমপক্ষে দুইজন শিক্ষক) উক্ত ট্রাংক খুলে ছাত্র সংখ্যা অনুসারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অতটি প্রশ্ন ও সব বিষয় এর প্রশ্ন আসছে কিনা তা মিলিয়ে দেখা হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রশ্নের প্যাকেট খোলা হয় না, বরং প্রত্যেক প্যাকেটের উপর একটি লেবেল থাকে। তাতে উক্ত প্যাকেটে কোন বিষয়ের প্রশ্ন আছে, কতটি প্রশ্ন আছে তা লিখা থাকে। কেন্দ্রের বিষয়ভিত্তিক ছাত্র সংখ্যার সাথে প্রশ্নসংখ্যা ও সব বিষয়ের প্রশ্ন থাকলে তবে সব ঠিক আছে বলে মনে করা হয়। তারপর রুটিন অনুসারে তারিখ ভিত্তিক প্রশ্ন প্যাকেটগুলোকে একাধিক বান্ডিল করে উক্ত ট্রাংকে রাখা হয়। ট্রাংকটি সকলের সামনে আবার তালাবদ্ধ করে গালা সীল করা হয়। পরীক্ষা কেন্দ্রের এ প্রক্রিয়াকে সটিং বলা হয়। সটিং এর প্রয়োজন হয় এ কারণে যে, কোন কেন্দ্রে বারটি বিষয়ের পরীক্ষা হলে উক্ত বারটি বিষয়ের প্রশ্ন আসছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হয়। তাছাড়া কোন বিষয়ে যদি ১০০ জন ছাত্র থাকে আর উক্ত বিষয়ের প্রশ্ন যদি ৫০টি আসে তবে পরীক্ষার দিন কেন্দ্র সচিবকে মহাবিপদে পড়তে হয়। এ কারণে প্রশ্নপত্র সটিং এর প্রয়োজন রয়েছে। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এ প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে না। কারণ সটিং করার সময় প্যাকেট খোলা হয় না। তবে প্রশ্ন ফাঁস হয় কিভাবে?
প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে ছাপানো এবং সদরে বা উপজেলায় আসা পর্যন্ত যদি বিজ্ঞজনের কথা অনুসারে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না বলে ধরে নেয়া হয় তবে নির্বিঘ্নে বলা যায়, অবশিষ্ট প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। অবশিষ্ট প্রক্রিয়াটি হল, যে দিন যে বিষয়ের পরীক্ষা সেদিন কেন্দ্র সচিবের দুইজন বা তিনজন প্রতিনিধি গাড়ি নিয়ে উপজেলায় বা সদরের ট্রেজারীতে যায়। সদরে হলে সেখানে এডিসি (শিক্ষা) উপস্থিত থাকে আর উপজেলায় হলে ইউ.এন.ও. এর প্রতিনিধি ও শিক্ষা অফিসারের উপস্থিতিতে রুটিন দেখে শুধুমাত্র ঐদিনের প্রশ্ন নিয়ে এসে কেন্দ্র সচিবের কক্ষে রাখা হয়। পরীক্ষা শুরুর আধ ঘন্টা আগে পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা কেন্দ্র সচিবের কক্ষে উপস্থিত থাকে। প্রশ্নপত্র প্যাকেটের উপর দুইজন শিক্ষকের স্বাক্ষর নিতে হয় যেখানে বলা হয় প্যাকেটটি অক্ষত ছিল এবং পরীক্ষার আধ ঘন্টা আগে খোলা হয়েছে। তখন কক্ষভিত্তিক ছাত্র সংখ্যা অনুসারে প্রশ্নপত্র এক একটি খামে ঢোকানো হয়, পরীক্ষা আরম্ভের পাঁচ মিনিট পূর্বে কক্ষভিত্তিক খামগুলো প্রত্যেক কক্ষে পৌঁছে দেয়া হয়। যত সন্দেহের মূল এখানে। বিজ্ঞজনের সন্দেহ এ সময়ে কোন অসাধু শিক্ষক মোবাইলে ছবি তোলে তা একনিমিষেই সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়।
তা হলে এটা বন্ধ হবে কিভাবে? কেউ কেউ প্রস্তাব রেখেছেন কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বড় অসুবিধা হল নেট প্রাপ্তি ও বিদ্যুৎ সার্বক্ষণিক থাকার অনিশ্চয়তা। কোন কোন কেন্দ্রে নেট সংযোগ প্রাপ্তিতে অসুবিধা হয়। আবার অধিকাংশ গ্রামের কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে সকাল ১০টায় পরীক্ষা আরম্ভ করা যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তা ছাড়া অসাধু শিক্ষকেরা তখনও বহাল তবিয়তে থাকবে। তারা একই পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার সম্ভাবনা থেকে যাবে।
প্রিয় পাঠক, এ ব্যাপারে আমার একটি প্রস্তাব আছে। প্রত্যেক ছাত্রের জন্য প্রতি বিষয়ের একটি করে প্যাকেট থাকবে যেখানে প্যাকেটের মধ্যে থাকবে একটি উত্তরপত্র ও একটি প্রশ্ন। ছাত্ররা পরীক্ষা কক্ষে ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে উক্ত প্যাকেট খুলবে এবং উত্তরপত্রে লিখতে আরম্ভ করবে। পরীক্ষা শেষে আবার উক্ত প্যাকেটে ঢুকিয়ে উত্তরপত্রটি পর্যবেক্ষকের নিকট জমা দেবে। এতে পরীক্ষা শুরুর এক মিনিট পূর্বেও কোন শিক্ষক প্রশ্ন দেখার সুযোগ থাকবে না। ইহাই একমাত্র সমাধান বলে আমার মনে হয়। এতে শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও উত্থাপন হবে না। শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে কোন প্রশ্ন হবে না। কিন্তু যারা ফাঁসকৃত প্রশ্নে পরীক্ষা দিল তাদের কি হবে? যে ছাত্র পেয়েছে সে নির্বিঘ্নে পূর্ণ নম্বর পেয়ে গেল, আর যে ছাত্র পায়নি সে প্রতি পত্রে দুই বা তিন নম্বর কম পেল। ছাত্ররা যদি ১২টি বিষয়ে পরীক্ষা দেয় তবে প্রশ্ন প্রাপ্ত ছাত্রটি অধিক নম্বর পাবে ১২*২=২৪ (কমপক্ষে)। ফলে নম্বরের ভিত্তিতে ভাল ভাল কলেজগুলোতে ভর্তি করালে তবে প্রশ্ন প্রাপ্ত ছেলেটিই এসব কলেজে ভর্তি হবে। যে ছাত্রটি শহরের ভাল স্কুলে পড়াশুনা করল সে সৎভাবে পরীক্ষা দেবার কারণে ভাল কলেজে ভর্তি হতে পারল না। এমন কি শহরের কোন বেসরকারি কলেজেও ভর্তির সুযোগ পাবে কিনা সন্দেহ। কারণ ২৪ নম্বরের পার্থক্য একটি বিশাল পার্থক্য। এ কারণে কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে এর নম্বর বাদ দিয়ে সৃজনশীল নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি করানো যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। যেহেতু বলা হচ্ছে যে, শুধুমাত্র এর প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।
(সংগৃহীত)