বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্র জীবনের ধ্রুবতারা

কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্র জীবনের ধ্রুবতারা

বিশ্বজিৎ সিংহ, ০২ মার্চ, এবিনিউজ : রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানের বাণী ও সুরে মর্ত্যলোকের সীমা ছাড়িয়ে রয়েছে এক অসীমের আকুতি। গানের মধ্য দিয়ে প্রেমকে তিনি জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে অমৃত লোকে প্রসারিত করেছেন। প্রেমের অফুরান সত্তার ও ঐশ্বর্যে রবীন্দ্রগানের ও কবিতার যে অতুলনীয় সমৃদ্ধি তার উৎসে রয়েছেন এক অনন্য সাধারণ নারী তিনি রবীন্দ্রনাথেরই নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী।

কাদম্বরী দেবীর অকাল মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানকে করেছে কালজয়ী–মৃত্যুঞ্জয়ী। ব্যক্তি হৃদয়ের মধ্য দিয়ে এই প্রেম সারা বিশ্ব প্রকৃতিতে ব্যাপ্ত হয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথের গানে প্রেম ও প্রকৃতি অবিচ্ছেদ্য। এই প্রেম প্রতিনিয়ত প্রকৃতি থেকে ব্যক্তি–হৃদয়ে এবং ব্যক্তি হৃদয় থেকে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের এক অসাধারণ সংগীত সুধায় ভরিয়ে তোলে।

প্রত্যেক মহা কবির, মহৎ স্রষ্টার জীবনে একজন প্রেরণাদাত্রী থাকেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে কাদম্বরীর আবির্ভাব ঘটেছিল যখন তাঁর বয়স সাত। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন, তিনি তাঁর সেই শিশু বয়সটা কাটিয়েছিলেন-‘ভৃত্যরাজকতন্ত্রে।’ এই ধরনের শিশুরা যে গভীর স্নেহ পায়, বিশেষভাবে নারীদের কাছ থেকে, কবি তা পান নি। তিনি তাঁর মায়ের চতুর্দশ সন্তান। তাঁকে বড়ো করে তোলার ভার–পড়েছিল বাড়ির চাকর–বাকরদের ওপর। তাঁর মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। ‘ভৃত্য রাজকতন্ত্র’ থেকে তাঁর মুক্তি ঘটেছিল এক বেদনা ও বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। জীবন স্মৃতিতে কবি লিখেছেন, ‘মার যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অল্প। অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবন সংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম, তখন সেই কথাটির অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরে বারান্দায় তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপর শয়ান। কিন্তু মৃত্যুর যেই রূপ দেখিলাম তা সুখমুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না।’

কবি বলেছেন যে, মৃত্যু তাঁকে মৃত্যুর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, পরম বিচ্ছেদের বেদনায় দীর্ণ করেছিলণ্ড তা হল তাঁর নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীর অকাল প্রয়াণ। এই মৃত্যুর সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,

‘আমার ২৪ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে

পরিচয় হয়েছিল, তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা

তাঁহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদ–শোকের সঙ্গেই

মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছিল।’

কাদম্বরী দেবী কেবল যে রবীন্দ্রনাথেরই অনুপ্রেরণা দাত্রী ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন সেই সময়ের বাঙালি নারী জীবনের, সেই অন্ধকার কালের আলোকযাত্রী এক অসাধারণ নারী, যাঁর জীবনের তীব্র আলোকচ্ছটা বাঙালি রমণী জীবনের অন্ধকার দূর করতে সাহায্য করেছিল।

ঠাকুর পরিবারের প্রায় সবাই ছিলেন সাহিত্য রসিক, সাহিত্য স্রষ্টা, কবি, দার্শনিক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও প্রাচ্য সঙ্গীতের মিলনে এক নতুন সঙ্গীত ধারা সৃষ্টিতে নেমেছিলেনণ্ড কাদম্বরী ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর এই প্রচেষ্টার সঙ্গী। জ্যোতিদাদা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–

‘জ্যোতিদাদা এসেছিলেন নির্জলা নতুন মন নিয়ে।

বার বছরের এই ছোট ভাইটিকে জ্যোতিদাদা

তাঁর সংগীতচর্চার সঙ্গী করে নিয়েছিলেন।

পিয়ানোর উপর হাত চালিয়ে নতুন নতুন

ভঙ্গীতে সুর তৈরি করে দিতেন, আমাকে রাখতেন

পাশে। আমি ধরতুম চড়া সুরের গান।…

সূর্য ডোবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত

আমার গান।’

এই কথা স্মরণ করেই কি কবি উত্তর জীবনে লিখেছিলেন,

‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান

তার বদলে আমি চাই নি কোন দান।’

কবি আরো লিখেছেন,

‘গঙ্গার ধারে প্রথম যে বাসা আমার মনে

পড়েণ্ড ছোটোযে দোতলা বাড়ী। নতুন বর্ষা

নেমেছে। মেঘের ছায়া ভেসে চলেছে স্রোতের উপর ঢেউ খেলিয়ে, মেঘের ছায়া কালো হয়ে ঘনিয়ে রয়েছে ও পারের বনের মাথায়। বিদ্যাপতির পদটি জেগে উঠল আমার মনেণ্ড ‘এ ভরা ভাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর।’ নিজের সুর দিয়ে ঢালাই করে রাগিনীর ছাপ মেরে তাকে ধরে নিলুম,… বৌ ঠাকুরানী ফিরে এলেন। গান শুনালাম তাকে, চুপ করে শুনলেন, গঙ্গার–ধারে সেই সুর দিয়ে মিনে করে এই বাদল দিন আজও রয়ে গেছে আমার বর্ষা গানের সিন্দুকটাতে।’

কবির শৈশব এবং কৈশোর কেটেছিল নারী স্নেহ বঞ্চিত। তাই জীবনটা ছিল অত্যন্ত এক ঘেঁয়ে যে সময়ে এলেন নতূন বউঠান ঠাকুর পরিবারে। কবি এই ঘটনা উল্লেখ করেছেন প্রাণের আবেগ মিশিয়ে, দিনগুলো এমনি চলে যায় একটানা। … এমন সময় একদিন বাজলো সানাই বারোয়ী সুরে। বাড়িতে এলো নতুন বউ, কচি শ্যামলা হাতে সরু সরু সোনার চুড়ি। পলক ফেলতেই ফাঁক হয়ে গেল বেড়া, দেখা দিল চেনাশোনার বাহির সীমানা থেকে মায়াবী দেশের নতুন মানুষ।

শ্যামা কবিতায় এই নতুন বউঠানের কথাই কবি উল্লেখ করেছেন এভাবে,

“উজ্জ্বল শ্যামলবর্ণ, গলায় গলার হারখানি

চেয়েছি অবাক মানি

তার পানে।

বড়োবড়ো কাজল নয়নে

অসংকোচে ছিল চেয়ে

নব কৈশোরের মেয়ে,

ছিল তারি কাছাকাছি বয়স আমার।

স্পষ্ট মনে পড়ে ছবি।

ডেকেছে সে মোরে মাঝে মাঝে

বিধির খেয়াল যেথা নানাবিধ সাজে

রচে মরীচিকালোক নাগালের পারে

বালকের স্বপ্নের কিনারে।”

‘নতুন বৌ ঠাকুরাণীর জায়গা হলো বাড়ির ছাদের লাগোয়া ঘরে। পুতুলের বিয়েতে ভোজের পাত পরত সেখানে।

বৌ ঠাকুরান আমাকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। স্কুল থেকে ফিরে এলেই তৈরি থাকতো তাঁর আপন হাতের প্রসাদ। এভাবেই কবির কৈশোরকে নানা ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দিয়েছিলেন বালিকা বধূ, নতুন বউঠান। ছাদটাকে একেবারে বাগান বানিয়ে তুলেছিলেন। চাঁদনী রাতে ছাদের ওপর মারিসারি গাছের ছায়া যেন স্বপ্নের কল্পনা। ছাদের ওপর কবি ঘুরে বেড়াতেন স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে। মনে ও কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ত গান। কবি তাঁর নবীন কৈশোরে নতুন বউ ঠাকরুণের প্রেরণায় কেবল যে গানের চর্চা করতেন তা নয়। কবিতা লেখাও শুরু করেছিলেন। তার মধ্যে কোনো রূপের সৃষ্টি নেই কেবল গতির চাঞ্চল্য আছে। সাহিত্যে বউঠাকুরাণীর প্রবল অনুরাগ ছিল। তাঁর সাহিত্য চর্চায় আমি অংশী ছিলাম।

কবির জীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন,

‘কাদম্বরী দেবীর নারী হৃদয় ত্রিবেণীসংগম ছিল।

কবি বিহারী লালকে শ্রদ্ধা, স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রকে

প্রীতি ও দেবর রবীন্দ্রনাথকে স্নেহ দ্বারা তিনি

আপনার করে রেখেছিলেন। এই নারীর স্নেহ

প্রশাসন রবীন্দ্রনাথের যৌবনকে সুন্দরের পথে চালিত করেছিল।’

সঙ্গীত চর্চা, সাহিত্য চর্চা, জীবন ধারণ ও জীবনের বহু ছোটো বড়ো খুঁটিনাটি ঘটনার মধ্য দিয়ে কবির জীবন–যৌবনে যিনি অন্য অর্থ এনে দিয়েছিলেন, গভীর স্নিগ্ধতা ও সুষমায় ভরে দিয়েছিলেন, সেই অনন্য সাধারণ নারীর প্রতি কবির যে প্রেম মূর্ত হয়েছিল, তা মর্ত্যের সীমাকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এই অসামান্য রমণীর স্নেহে অভিষিক্ত হয়ে কবি ২১ বছর বয়সে তাঁর সাহিত্য সাধনায় যে পূর্ণতা পেয়েছিলেন তার কোনো তুলনা নেই। তা ছিল প্রকৃত অর্থে নির্ঝরের উচ্ছ্বাস। কবি লিখেছেন অসংখ্য গান, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। এর প্রায় প্রত্যেকটি তিনি উৎসর্গ করেছেন তাঁকে যিনি তাঁর আমৃত্যু কাব্য প্রেরণা দিয়ে ছিলেন। ছবি ও গানের উৎসর্গে কবি লিখেছেন, গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসর কার বসন্তের মালা গাঁথিলাম। যাঁহার নয়ন কিরণে প্রতিদিন প্রভাতে এই ফুলগুলো একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত, তাঁহারই চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম। এই উৎসর্গ কবির অন্তরের অপরিসীম প্রেম–ভালোবাসাও শ্রদ্ধা। মিলে মিশে যেন একটি পুষ্পার্ঘ্যে রূপ নিয়েছে।

কবির অন্তরে চিরকালের জন্যে অধিষ্ঠিত এই নারী যিনি তাঁর হৃদয়কে চিরকালের জন্যে ছুঁয়ে দিয়েছিলেন ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল কী এক গভীর অভিমানে অসামান্য গুণী প্রিয়তম স্বামী, জীবনাতীত স্নেহের দেবর কবি রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য আত্মীয়দের ছেড়ে নিজের জীবনকে হনন করে পরপারে চলে গেলেন। এই মৃত্যু কবি আমৃত্যু ভোলেন নি। এই মৃত্যু–উত্তর কবির জীবন–মৃত্যুর আলোকেই মর্ত্যের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁকে অমর্ত্যলোকের অভিসারী করেছে। তাঁর গানকে, তাঁর সৃষ্টিকে সীমার মধ্যে অসীমের পথে নিয়ে গেছে। ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।’ কবি যেন তারি সুর শুনতে পেয়েছেন। এই মৃত্যু, এই প্রেম যে কবির মনে অন্ত:সলিলের মতো প্রবাহিত হতো তা ফুটে ওঠেছে অনেক বছর পরে যখন তিনি এলাহাবাদে ভ্রাতুষ্পুত্রের বাসায় বউ ঠাকুরাণীর একটা বাঁধানো ছবি দেখেছিলেন।

‘এই ছবি কবিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল লিখতে,

তুমি কি কেবল ছবি, শুধু পটে লিখা?

ওই যে সুদূর নীহারিকা

করে আছে ভিড়

আকাশের নীড়

ওই যারা দিনরাত্রি

আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী

গ্রহ তারা রবি,

তুমি কি তাদের মতো সত্য নও?

হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি।

একদিন এই পথে চলেছিলে আমাদের পাশে।

বক্ষ তব দুলিত নিঃশ্বাসে

অঙ্গে অঙ্গে প্রাণতব

কতগানে কত নাচে

রচিয়াছে

আপনার ছন্দ নব নব

বিশ্বতালে রেখে তাল

যে যে আজ হল কত কাল।’

আজ আমাদের দেশ যখন নারী মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত, তখন কি আমাদের ওপর দায় বর্তায় না কবির অনুপ্রেরণার উৎস এই আলোকবর্তিকা নারীকে শ্রদ্ধা জানাতে।

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত