![আনুগত্য ছিন্ন’র অভিপ্রায়](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/04/sirajul-islam-ch_128497.jpg)
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ০৪ মার্চ, এবিনিউজ : প্রভুর ইচ্ছা নানাভাবে কাজ করেণ্ডকখনো সরাসরি, অনেক সময়ে গোপনে। আধিপত্যের একটা সংস্কৃতিই গড়ে ওঠে। প্রভুভক্তদের পক্ষে তো অবশ্যই, এমন কি যারা বিদ্রোহ করে তাদের অনেকের পক্ষেও বৃত্তটা ভেঙে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না, যদি না খুব বড় কিছু ঘটে, কিংবা ঘটানো সম্ভব হয়। আর পরিবর্তনের পরেও প্রায়ই টের পাওয়া যায় যে, প্রভু বদল হয়েছে বটে, প্রভুত্বের বদল হয়নি। গোলামীরই হোক, হোক আনুগত্যের, কিংবা মেনে–নেওয়ার, আধিপত্যের চিত্রটাকে আশাব্যঞ্জক বলা সহজ নয়। তবু সমষ্টিগতভাবে মানুষ কখনোই পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে না, বদলাতে চায়, আশা রাখে, এবং বদলাতে যে পারে না এমনও নয়।
কিন্তু প্রভুটা কে? প্রভু কোনো ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান নয়, প্রভু হচ্ছে একটি ব্যবস্থা, যেটা সুবিস্তৃত ও সুগভীর, এবং একই সঙ্গে স্থানীয় ও বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্ত। ব্যবস্থাটার নাম পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ যেমন একটি অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থা তেমনি আবার একটি আদর্শও বৈকি। এ অর্থনৈতিক ও আদর্শিক আয়োজন দাসত্বের সৃষ্টি করে; কেবল দরিদ্রদের জন্য নয়, তাদের জন্যও যারা ধনী। ধনী–দরিদ্র সবাই বন্দি হয়ে থাকে মুনাফার লোভ ও ভোগবাদী লালসার এবং আত্মকেন্দ্রিকতার ও বিচ্ছিন্নতার হাতে।
পুঁজিবাদ স্বভাবতই সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। সাম্রাজ্যবাদ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা যা পুঁজিবাদকে একাধারে রক্ষা ও সুবিস্তৃত করে। বিশ্ব এখন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অধীন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, এবং এখন সেখানে পুঁজিবাদের মারাত্মক দৌরাত্ম্য চলছে। গণচীনও রওনা দিয়েছে বাজারদাসত্বের অভিমুখে।
এ যে বিশ্বব্যবস্থা এর আসল নিয়ন্ত্রক বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এর অধীনে এমনকি বড় রাষ্ট্রও যে স্বাধীন নয়, এবং আমাদের মতো দুর্বল রাষ্ট্রের পক্ষে যে স্বাধীন অবস্থান নেওয়া একেবারেই অসম্ভব, এ সত্য উপলব্ধি না–করবার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশে রাষ্ট্রের শাসক যারা তারা দলাদলি, কলহ, সংঘর্ষ সবই করছে, কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধ এক ব্যাপারে, সেটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারিতে। ওই কাজে তারা মোটেই বিমুখ নয়, যদিও নিজেদের স্বার্থগত বিভেদের কারণে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বটে। তাদের ক্ষমতায় থাকা না–থাকার ব্যাপারের অনেকটাই নির্ভর করে সাম্রাজ্যবাদের তুষ্টিসাধনের ওপর। ওদিকে আদর্শগতভাবে এ শাসকদের সবাই পুঁজিবাদী। মুনাফালোভিতা ও ভোগবাদিতা তাদের জন্য চালিকা শক্তি।
প্রভুত্বের অধীনস্ততা আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে যেমন তৎপর তেমনি প্রভাবশালী আমাদের মনোজগতেও। এমনকি যাঁরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী তাঁরাও দুর্বল হয়ে পড়েন; স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতার মোহ তো রয়েছেই, বিভ্রান্ত হন বিকৃত তথ্য ও তত্ত্বের পীড়নে এবং নিজেদের সামন্তবাদী পিছুটানে। কঠিন হয়ে পড়ে শিরদাঁড়া শক্ত রাখা এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানো। মুক্তির সংগ্রাম চলে, কিন্তু মুক্তি আসে না; রাষ্ট্র বদলায়, কিন্তু সমাজ বদলায় না।
রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে সাম্রাজ্যবাদের কার্যকর তৎপরতার কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করা হলে প্রয়াত এডওয়ার্ড সাঈদ যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় অত্যন্ত দৃঢ় ছিলেন, এবং প্রভুত্বকে মানেননি, যে–কারণে তাঁর বক্তব্য, কাজের পরিধি ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। গ্রামসি যাঁদেরকে বিপ্লবী মনে করতেন সাঈদ ছিলেন তেমন ধরনেরই একজন বুদ্ধিজীবী; কিন্তু তাঁর নিজের অবস্থানের ওপরও যে সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব পড়েনি এমনটা বলা যাবে না, যে–প্রভাবটা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এ জন্য যে, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোসের কোনো চিন্তা তাঁর ভেতর থাকবার কথা নয়।
ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রবণতার বিবেচনার কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিম্নবর্গে’র বলে পরিচিত ইতিহাসচর্চার ধারাটি। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা বিশাল ভারতবর্ষকে কৃত্রিমভাবে এক করতে চেয়েছিল, শাসন–শোষণ, প্রশাসন, যোগাযোগ, ব্যবসা–বাণিজ্য এবং অনুগত শ্রেণি তৈরি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে ভারতবর্ষীয়দেরকেও ওই ঐক্য মেনে নিতে হয়েছে, কেননা ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তৃত ছিল সারা ভারতবর্ষ জুড়েই। দখলদারদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ভারতবর্ষীয়দের জন্য প্রয়োজন ছিল জাতীয়তাবাদের; কিন্তু ওই জাতীয়তাবাদই আবার বিপদ ডেকে আনলো তাদের জন্য। জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান ধর্ম নয়, ভাষা। ভারতবর্ষ ছিল নানা ভাষার দেশ, ব্রিটিশ শাসকেরা ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই চাপিয়ে–দেওয়াটা ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনার ওপর নিপীড়ন, অপরপক্ষে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না কোনো একটি ভাষার সাহায্যে ভারতবর্ষের সকল মানুষকে এক করা। তাছাড়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অগ্রসর অংশ যেহেতু ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাই তাঁরা নিজেদের ধর্মের সাহায্যে ভারতবর্ষকে এক করবার আপাত সহজ ও কার্যকর পথ ধরেই এগুলেন। ফলটা দাঁড়ালো বিপজ্জনক, সাম্প্রদায়িকতা সুযোগ পেল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিভাজন সৃষ্টির, ঐক্যের জায়গায় দেখা দিল দাঙ্গা–হাঙ্গামা, যার পরিণামে অনিবার্য হয়ে পড়লো ভারত–বিভাগ।
১৯৪৭–এ উদ্ভব ঘটেছিল দু’টি রাষ্ট্রের, ভারত ও পাকিস্তানের; ১৯৭১–এ জন্ম আরেকটি নতুন রাষ্ট্রের, বাংলাদেশের। এ তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনজন রাষ্ট্রনায়ক খুব বড় ভূমিকা পালন করেন; এঁরা হলেন গান্ধী, জিন্নাহ ও শেখ মুজিব। এঁদের পটভূমি, অবস্থান ও সময়ের ভেতর পার্থক্য ছিল, কিন্তু তিনজনের ভেতর ঐক্য ছিল এক জায়গায়ণ্ডএঁরা সবাই পুঁজিবাদে আস্থাবান ছিলেন। তাঁদের ওই আস্থা রাষ্ট্র তিনটির চরিত্রের ভেতরও প্রতিফলিত হয়েছে বৈকি।
সাম্রাজ্যবাদ–বিরোধিতার ক্ষেত্রে অনড় দু’জন ব্যক্তিত্ব, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও লীলা নাগের কথা স্মরণ করা যায়। এ দু’জনের কেউই কিন্তু পুঁজিবাদী ছিলেন না, তাঁদের পক্ষপাত ছিল সমাজতন্ত্রের দিকে। কিন্তু পুরোপুরি সমাজতন্ত্রী হওয়া তাঁদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। দুর্লঙ্ঘ্য একটি পরিখা ছিল সামনে দাঁড়িয়ে, যেটি শ্রেণি ও সংস্কৃতির।
রাষ্ট্রের উত্থান ঘটেছে, পতনও ঘটেছে; মুক্তির জন্য মানুষ সংগ্রাম করেছে, কিন্তু মুক্তি আসেনি, উল্টো বরঞ্চ বিড়ম্বনা জুটেছে বহুমানুষের ভাগ্যে। মুক্তি কেন এলো না? না–আসার প্রধান কারণ সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধিতাকে ধারাবাহিক ও ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কাজটি করবার কথা ছিল বামপন্থিদেরই। তাঁরা যে চেষ্টা করেননি তা নয়। কিন্তু সফলতা আসেনি। ব্যর্থতার একটি কারণ হলো এ যে, নিজের পায়ে এবং মেরুদন্ড শক্ত করে তাঁরা দাঁড়াতে পারেননি, অন্য কারণ তাঁদের পক্ষে সাধারণ মানুষের কাছে সে–ভাবে যাওয়া সম্ভব হয়নি যে–ভাবে জাতীয়তাবাদীরা গেছেন।
মূল প্রশ্নটি কিন্তু প্রভু নয়, প্রভুর প্রতি আনুগত্যও নয়, সেটি হলো আনুগত্য ছিন্ন করবার চেষ্টা। আধিপত্যবাদী ও কর্তৃত্বকামী প্রভুর নানা ইচ্ছা ওই চেষ্টাকে জরুরি করে তুলেছে। কেননা এর সাথে আমাদের সমষ্টিগত ভবিষ্যৎ অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত বটে।
লেখক : শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(সংগৃহীত)