![এখন মুক্তচিন্তার কথা বলে কী লাভ](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/05/moktomot_128601.jpg)
হাসান আজিজুল হক, ০৫ মার্চ, এবিনিউজ : দেশের বর্তমান নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে আমি কোনোভাবেই আশ্বস্ত হতে পারছি না। দেখা যাচ্ছে যে একটার পর একটা নৃশংস ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে যা মনে হচ্ছে, কেউ বাদ যাবে না। মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো এমন গুণী, জনপ্রিয় ও প্রতিভাবান মানুষ; তার ওপর শিক্ষাবিদ। এখন তাঁর মতো শিক্ষিত ও বড় মানুষ দেশে খুব বেশি নেই। অসাধারণ একজন মানুষ। তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষও বটে। একে তো তিনি লেখক, সারা দেশের ছেলেমেয়েদের খুবই আপন। আর অসম্ভব ভালো মানুষ। ভালো লেখক। তাঁর মতো মানুষের ওপরেও হামলা হতে পারে—এটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। তাহলে আমরা যাব কোথায়?
আমরা যে সব সময় মুক্তবুদ্ধির কথা, গণতন্ত্রের অধিকারের কথা বলি, এসব বলা যাবে না? এখন মনে হচ্ছে মুক্তচিন্তার কথা বলে লাভ কী? মানুষ কি নিরাপদে বাস করতে পারবে না? সবই তাহলে গোল্লায় যাবে? জাফর ইকবালকে হুমকি দিয়েছে অনেকবার। আমাকেও হুমকি দিয়েছে। আমি রাজধানী থেকে অনেক দূরে থাকি। জাফর ইকবালও দূরে থাকেন, সেই সিলেটে। কাজেই আমাদের বেদনাটা একটু বেশি। সিলেটে যে ছেলেটি কাণ্ডটি ঘটিয়েছে, তার বাড়িও সেই এলাকায়ই। এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল, সভার জায়গায় ছেলেটি জাফর ইকবালের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য, ঘটনাটি যখন ঘটল কেউ টেরই পেল না? কেউ জানতেই পারল না যে এলাকায় এমন একজন খুনি ছেলে ছিল! একেবারে র্যাডিকেলাইজড সোজা খুন করার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দেবে এবং পিছপা হবে না। আর আশপাশে পুলিশ ছিল বলে আমি পত্রিকায় দেখতেও পাচ্ছি। ঘটনাটি যখন ঘটেছে, পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। তারা মোবাইল টেপাটিপি করছে। তাহলে কী আর বলব? পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাও যদি এমন ঠুনকো হয়, তাহলে তো কিছু বলার থাকে না। এই তো পরিস্থিতি। এগুলোকে কী বলব। বলার কিছু নেই।
প্রথম কথা হচ্ছে, জঙ্গিবাদ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেক জঙ্গিকে ধরা হয়েছে, বিচার হয়েছে। ফাঁসিও হয়েছে। আমরা অনেকেই মোটামুটিভাবে মনে করছি যে এটা অনেকখানি কমে এসেছে। তাদের উৎপাটন করা গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এটা কিছুতেই বলা যাবে না যে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়েছে। এখন এই মুহূর্তে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই জঙ্গি আছে। আইএস আছে, জানা-অজানা অনেক নামে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু আমরা সুজলা সুফলা একটি বাংলাদেশ করতে চেয়েছি। সুন্দর একটি দেশ আমাদের। এই দেশে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতি হবে। প্রসার হবে। এই উন্নতি হবে, সেই উন্নতি হবে। কিন্তু সমাজটাই যদি এমন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, সেখানে কী বলার থাকে! তাহলে তো রাষ্ট্রটাই আলগা হয়ে যায়। কাজেই কিছু বলা মানে অরণ্যে রোদন আর কী। সেখানে জাফর ইকবালের মতো একজন মানবিক ও অসামান্য মানুষ এমন আক্রমণের শিকার হলেন, ভাবতেই পারা যায় না! এ ঘটনাটি আমার কাছে ব্যক্তিগত আঘাত পাওয়ার মতো মনে হয়েছে। গোটা বাংলাদেশের মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, তাঁর মতো মানুষ কমই পাওয়া যাবে। তাঁর শরীরে কতগুলো আঘাত লেগেছে, কী পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে, জানি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত আঘাত পেয়েছি। খুবই আহত বোধ করেছি। ঘটনাটি আমার কাছে মনে হয়েছে যে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের চোখ উঠিয়ে নিলে যেমন হয়, সে রকম আর কী। এই যে এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারল, এখন অনেক বড় বড় কথা বাতাসে ঘুরে বেড়াবে। তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না। সমাজ থেকে যদি গুণী মানুষরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যান, তাঁদের কথা ও চিন্তাকে ধ্বংস করা হয়, তাহলে সমাজটা ভেঙে পড়ে।
কিছু বিষয়কে সমানভাবে মেনে নিতে হয়। আবার কিছু বিষয়কে সমান করতে যাওয়া উচিতও নয়। বাংলাদেশে সবাই যদি বুদ্ধিজীবী হয়ে যায়, তাহলে আমাদের মতো লোকের বুদ্ধি নেবে কে?
পুরনো কথাটিই বলতে হয়, গণতন্ত্রের অবাধ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সংবিধানে যা কিছু বলা হয়েছে, সেসব বাস্তবায়ন করতে হবে। মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সব মানুষ সমান। আসলে কি সমান? অর্থনৈতিকভাবেও সমান নয়, চিত্তের দিক থেকেও নয়। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কোথায় ফাটল আছে, কোথায় ঘুণ ধরেছে সেসব খুঁজে দেখতে হবে। আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। আরো উন্নতি হবে। আগামী অমুক সালে দেশ এভাবে ওদিকে এগিয়ে যাবে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ একটি সুন্দর-সফল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পাবে। সবই ঠিক আছে। কিন্তু সমাজের ফাটলটা কোথায়, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। তা না করতে পারলে আমাদের এগোনোটা কাজে দেবে না। এসব নিয়ে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই।
এখন কোনো দেশই তো স্বাধীন নয়। সে বাংলাদেশ বলি, আর আমেরিকা। কারণ আমেরিকার মতো একটি দেশে স্কুলের ভেতরে গিয়েও হামলার ঘটনা ঘটেছে। স্কুলে ঢুকে গুলিবর্ষণ করে ছেলেদের মেরে ফেলা হয়েছে। একবার নয়, বারবার। জঙ্গির ছায়ার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠছে দেশ। পুরো পৃথিবীতে একটা অসুস্থ অরাজকতা চলছে। কাজেই কী বলার আছে? আমি মনে করি সময় এসেছে এসব বিষয়ে মাথাটা তোলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি খুবই শান্ত দেশ বলে পরিচিত। বাংলাদেশ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় মানুষের দেশ। এখন এই দেশটি যতখানি এগিয়েছে, ভবিষ্যতে যে আরো এগোবে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার বড় আক্ষেপ হয়, এখানেও জঙ্গি আছে। এসবের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে দেশ। কিন্তু এসব নিয়ে আর চুপ করে থাকার উপায় নেই।
পরিশেষে এটুকুই বলি, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এখন ঠিক কী অবস্থায় আছেন, জানি না। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি। আমি একান্তভাবে চাই, জাফর সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসুন। এখন এটুকুই চাওয়া। তাঁর দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসাটাকে একান্তভাবে কামনা করছি। (কালের কণ্ঠ)
লেখক : কথাশিল্পী, অধ্যাপক