বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

স্বাধীনতার মাস ও মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমদের আহত অভিমান

স্বাধীনতার মাস ও মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমদের আহত অভিমান

আ ক ম রইসুল হক বাহার, ০৬ মার্চ, এবিনিউজ : বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৭ বছর পূর্ণ হলো এ বছর। আর তিন বছর পর আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়নত্মী উদযাপন করবো। বেশ কিছুদিন আগে থেকে এ উদযাপন আয়োজনের তোড়জোড় চলছে। এর সঙ্গে জোর প্রচারণা পাচ্ছে আমাদের বিগত দিনের অর্জনগুলো। অবশ্য প্রচারের ডামাডোলের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে আমদের অসফলতা ও ব্যর্থতার দীর্ঘ তালিকাও। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য, আকাঙক্ষা ও স্বপ্ন কী ছিল সে বিষয়ে বড় কোন পর্যালোচনা ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে হয় বলে তেমন চোখে পড়ে না। তারা কেবলই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাসত্মবায়নের বায়বীয় সাফল্যের ঢালাও কৃতিত্ব দাবি করে যাচ্ছে।

স্বাধীনতার এ মাসে আমাদের ৭১ এর বীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা এখনও জীবিত আছেন তাদের দু’একজনের বর্তমান অবস্থার খোঁজ খবর নিলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাসত্মবায়নের

ক্ষেত্রে অগ্রগতির বাসত্মব চিত্রটি অনুধাবন করা সহজ হবে। বর্তমান মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের নতুন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর অঙ্গীকার ছিল এক বছরের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে তাদের সকলকে স্থায়ী সনদপত্র প্রদান করা হবে। সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। কিন্তু তালিকা চূড়ানত্মকরণের কাজটি যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেছে। স্থায়ী সনদ তো ‘দিল্লী হদূজ নুরসত্ম’।এ সরকারের আগের মেয়াদের মন্ত্রীর আমলে– তারও আগে এরশাদ–খালেদার শাসনামলে– ভুয়া সনদ দিয়ে অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানো এবং মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের কে দেওয়া স্বীকৃতি সনদে ব্যবহৃত সোনায় খাদ মেশানোর কেলেংকারিতে লজ্জায় দেশের মাথা হেঁট হয়ে যাবার কথা এখানে না হয় না–ই উল্লেখ করলাম।

কিন্তু একটা কথার জবাব তো আমাদের অবশ্যই পেতে হবে। আজ যে তালিকা যাচাই–বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার ভুয়াদের বাদ দেয়ার কার্যক্রম চলছে তার আগে ভুয়ারা কিভাবে তালিকাভুক্ত হলো তা কি অনুসন্ধান করা হয়েছে? আমরাতো জানি যে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে করা একটি সরকারি কাজ। কোন ব্যক্তি চাইলেই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে নিজে নিজে তালিকাভুক্ত হতে পারে না। যে সরকারি লোকজন অসাধু ও অনৈতিক পন্থায় ভুয়াদের এই তালিকা তৈরির সাথে যুক্ত ছিল তাদের চিহ্নিত করে শাসিত্মর ব্যবস্থা করাই তো প্রথম কাজ। সে কাজটি কি করা হয়েছে? নাকি যাচাই–বাছাই এর নামে আরো অনেক ভুয়াদের নতুন করে দলীয় বিবেচনায় তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্যই এই উদ্যোগ। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই বিড়ম্বনাপূর্ণ, অসম্মানজনক ও অবমাননাকর এ কাজ আর কতদিন চালানো হবে? প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তো এখন বিলীয়মান প্রজন্ম। নতুন ও ভুয়াদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর জন্য বার বার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পাল্টানো এবং বয়সসীমা কমানোর মত হাস্যকর কাজটি করা হচ্ছে জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়কে কলঙ্কিত করার জন্যে।

এত আয়োজন, এত ঘটা। কিন্তু তারপরও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তালিকার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সব সরকারি প্রামাণ্য দলিলপত্র থাকা সত্ত্বেও এবং বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি করে তালিকায় নাম লেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে মাথা কুটে মরেছেন এবং অবশেষে ‘একবুক জ্বালা নিয়ে’ ধরাধাম ছেড়ে গেছেন তার সামান্য বিবরণ এখানে তুলে ধরতে চাই।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদন্ডি ইউনিয়নের ডেঙ্গাপাড়া গ্রামের আলী আহমদ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে তিনি সিঙ্গাপুরে পাকিসত্মান হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন। সে সময় ৩৯ বছর বয়সী দূতাবাসের সাংকেতিক ভাষা সহকারী আলী আহমদ ৭১এর নভেম্বরের ৮ তারিখ রাতে দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং স্ত্রী ও দুই শিশু সনত্মানকে সাথে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিল্লী চলে যান। যাবার আগে জনাব আহমদ সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে তার পক্ষ ত্যাগের বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। একই বিষয়ে চিঠি আকারে তিনি পাকিসত্মানের সামরিক জানত্মা প্রধান ইয়াহিয়া খান. সিঙ্গাপুরে পাকিসত্মানি দূতাবাসের প্রধান এম. আর ইসলাম এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছেও পাঠান। এই চিঠিতে তিনি ইয়াহিয়াকে পূর্ববাংলার গণহত্যার জন্যে অভিযুক্ত করেন এবং চীনের প্রধানমন্ত্রীকে পাকিসত্মানের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের আবেদন জানান। দূতাবাস প্রধানের কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি এই গণহত্যার প্রতিবাদে তার পদত্যাগের কথাও উল্লেখ করেন। সিঙ্গাপুর থেকে দিল্লী পৌঁছে তিনি বিবিসিকে একটি সাক্ষাতকার দেন,যা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। বিশেষতঃ সে সময় পাকিসত্মানি দখলদারের দ্বারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জনগণের জন্যে দেশের পরিস্থিতি জানার অন্যতম সূত্র ছিল ভয়েস অব আমেরিকা ও আকাশবাণীর পাশাপাশি এই বৃটিশ বেতার সম্প্রচার মাধ্যম। বিবিসিতে আলী আহমদের সাক্ষাতকারটি মুক্তিকামী আপামর বাঙালিকে দারুণভাবে আলোড়িত ও উদ্বুদ্ধ করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার জনাব আলী আহমদকে কলকাতায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে কূটনৈতিক দায়িত্ব প্রদান করে। একজন বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে তিনি মুজিবনগর সরকারের যুদ্ধকালীন পররাষ্ট্র নীতি প্রচার ও বাসত্মবায়নে অত্যনত্ম গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা রাখেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে কলকাতার বাংলাদেশ মিশন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের ভয়াল কালো রাতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর সমগ্র জাতির জীবনে নেমে আসে এক ঘোর অমানিশা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য থেকে দেশের গতিমুখ পরিবর্তন করে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিসত্মানি ভাবধারা– যা ’৭১ এ পরাজিত হয়েছিল পুনরুজ্জীবনের কাজ। ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সাম্যভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থেকে সরে গিয়ে বাংলাদেশকে ধর্মাশ্রয়ী পশ্চাদমুখী পাকিসত্মানের ক্ষুদ্র সংস্করণ বানানোর আয়োজন শুরু করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী গোষ্ঠী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ষড়যন্ত্রমূলক ও রহস্যজনক ভূমিকা পালনকারী খুনী মোসত্মাক–জিয়ার রাজনৈতিক–সামরিক নেতৃত্ব ছিল এ চক্রানেত্মর পুরো ভাগে। তাদের সাথে হাত মেলায় প্রশাসন ও সমাজের নানা সত্মরে লুকিয়ে থাকা পরাজিত পাকিসত্মানপন্থী চক্র। তাদেরই যোগসাজশে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের ওপর নেমে আসে নানাভাবে প্রশাসনিক হয়রানি ও নির্যাতন। এর শিকার হন মুক্তিযোদ্ধা কূটনৈতিক আলী আহমদও। পাকিসত্মানপন্থীদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মারক, সাক্ষ্য, বীরত্ব ও গৌরবের ঘটনাবলী মুছে ফেলা এবং দেশবাসীকে বাঙালির সুদীর্ঘকালের মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যাদর্শ ভুলিয়ে দেয়া।

পরাধীনতার গ্লানি মোচনের জন্য লড়াই করেছিলেন অকুতোভয় বাঙালি কূটনৈতিক আলী আহমদ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তাকে পোহাতে হয় নানা গঞ্জনা। ’৭৫ এর পর পদে পদে তিনি হেনসত্মা ও অপদসেত্মর শিকার হন। আর এসবের চরম পরাকাষ্ঠা দেখায় রাষ্ট্র তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বেলায় কুণ্ঠিত হয়ে। এসব গ্লানি আর আহত অভিমান নিয়ে তিনি চাকরি জীবন পূর্ণ না করে ১৯৮৬ সালে স্বেচ্ছাবসরে যান এবং অপরিণত বয়সে ১৯৯৮ সালে তার অকালে প্রয়াণ হয়। সিঙ্গাপুরের সংবাদপত্রে আলী আহমেদের পক্ষ ত্যাগের সংবাদ প্রকাশ, ইয়াহিয়া, চৌএনলাই এবং পাকিসত্মানি দূতাবাস প্রধানকে লেখা তার প্রতিবাদী চিঠি এবং বাংলাদেশের হয়ে কাজ করা কী একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্যে যথেষ্ট ছিল না? সেসব দলিল না হয় আমাদের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই–বাছাইকারীদের নির্ধারিত মানদন্ডের মধ্যে পড়ে না। ১৯৮২ সালে ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ৩য় খণ্ডের ৮৮১ পৃষ্ঠায় আলী আহমেদের পাকিসত্মানি পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণার যে বিবরণী অনত্মর্ভুক্ত আছে তাও প্রামাণ্য নয় কি তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের জন্যে?

মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমদের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী শাহদাৎ নাহার এবং পরিবারের অন্য সদস্যগণ প্রশাসন ও মিডিয়ার দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিচ্ছেন তার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার জন্যে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো সুযোগ–সুবিধা কিংবা বা পোষ্যের চাকরি তারা চান না। কেবলই স্বীকৃতি চান। রাষ্ট্র কি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে এটুকু দিতেও কার্পণ্য করবে?

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত