বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

চাপাতির নিচে বিপন্ন মানবতা

চাপাতির নিচে বিপন্ন মানবতা

কামরুল হাসান বাদল, ০৮ মার্চ, এবিনিউজ : ১। বরেণ্য লেখক শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশ্যে কোপানোর সংবাদে দেশের মানবতাবাদী মানুষদের মতো ব্যথিত হয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি কিন্তু আমি বিস্মিত বা অবাক হইনি। কারণ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে এদেশের বুকে যে গণহত্যা শুরু হয়েছিল এবং সে গণহত্যার সময়ে দেশের প্রগতিশীল বরেণ্য সন্তানদের হত্যার যে ষড়যন্ত্র ও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় তিনি অর্থাৎ ড. জাফর ইকবালও আক্রান্ত হবেন কিংবা তাঁকে হত্যা করা হতে পারে তা এক প্রকার যেন ধরেই নিয়েছিলাম। আমার এই ধরে নেওয়াটি যে অমূলক নয় তা এই ঘটনা কিংবা ড. হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায়, রাজিব, দীপন হত্যাকান্ডের দ্বারা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তানি জান্তা তাদের এদেশীয় পোষ্য দালাল জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ অধুনা ইসলামী ছাত্র শিবিরের সহায়তায় দেশের প্রগতিবাদী, চিন্তাশীল, আধুনিক মনস্ক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল জাতিকে মেধাশূন্য করতে, অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখতে। মৌলবাদী, ধর্মান্ধ উগ্রগোষ্ঠীর কাছে বিজ্ঞান, মুক্তবুদ্ধি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবতাবাদী চিন্তা অসহ্য, জোঁকের গায়ে লবণের মতো। তারা যুক্তি দিয়ে যখন দাঁড়াতে পারে না তখন তারা হত্যাকে বেছে নেয়। এটি সকল প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ, মৌলবাদী গোষ্ঠীর বেলায় প্রযোজ্য। এরা রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করতে যখন ব্যর্থ হয়, এরা যুক্তি দিয়ে যখন অন্যের যুক্তিকে খণ্ডন করতে পারে না, এরা যখন লেখার বদলে, আরেকটি যৌক্তিক লেখা নিয়ে দাঁড়াতে পারে না তখন তারা রাজনীতির বদলে, যুক্তির বদলে কলমের বদলে চাপাতি তুলে নেয়, মারাণাস্ত্র তুলে নেয়। এরাই গণতন্ত্রের স্থানে হত্যাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় । এরা গলা কেটে মানুষের কক্তরোধ করতে চায়। মানবতাবোধ এদের চরম শত্রু, মমত্ববোধ এদের চরম শত্রু। নিষ্ঠুরতা নির্মমতাই এদের পথ, ধ্বংসই এদের লক্ষ্য, চরম ফ্যাসিবাদই এদের আদর্শ।

অতএব তাদের আদালতে ড. জাফর ইকবালের বহু দোষ। কারণ তিনি মানবতাবাদী, সত্যভাষী, বিজ্ঞানমনস্ক, অহিংস, প্রগতিশীল, জ্ঞানী এবং একাত্তরের বাংলাদেশের প্রতি সর্বতোভাবে অনুগত। তিনি জনপ্রিয়। তিনি তাঁর লেখায়, ভাবনায়, চিন্তা ও জীবনযাপনে সৎ, অকপট। তিনি উদ্দীপ্ত করেন লাখ লাখ কিশোর তরুণকে। তিনি আহবান করেন আলোর পথের, তিনি জাগিয়ে তোলেন দেশপ্রেম, তিনি শিক্ষা দেন অহিংসা, সততা ও প্রগতিশীলতার। তিনি এক অসাম্প্রদায়িক সমাজের স্বপ্ন দেখেন সন্তানতুল্য শিক্ষার্থী আর লাখ লাখ ভক্তদের সে স্বপ্ন দেখান। তিনি ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসার কথা বলেন। তিনি সকল অবিচার, অনাচার আর অন্যায্যের বিরুদ্ধে অকপটে এবং দুরন্ত সাহসে প্রতিবাদ করেন। ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, জঙ্গিগোষ্ঠী যেমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে সমাজ তারা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যে অন্ধকারের যুগ ফিরিয়ে আনতে চায় সে পথে বড় বাধা ড. জাফর ইকবাল এবং দেশের মুক্তমনা লেখকরা। ওই মুর্খরা, অর্বাচিনরা যুক্তি দিয়ে যখন তাদের প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে পারে না তখন তারা কতলের পথ বেছে নেয়। তার আগে তারা এই আলোকিত মানুষদের নাস্তিক হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ফতোয়া দেয় নাস্তিকদের হত্যা করলে জান্নাত তথা বেহেস্ত সুনিশ্চিত। এতে কিছু কিছু বদ্ধ উন্মাদ প্ররোচিত হয় আর ৭০টি হুর প্রাপ্তির আশায় প্রকৃত ভালো মানুষদের হত্যা করে।

২। গণজাগরণ মঞ্চ ছিল এ শতকের প্রথম অহিংস আন্দোলন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা তরুণ্যের সেই জাগরণকে তারা প্রথমেই আঘাত করেছে আন্দোলনকারীদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে। এরপর থেকে তারা লাগাতারভাবে দেশের বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী লেখক ও তাদের প্রকাশককে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে হত্যার উৎসবে মেতে ওঠে। একে একে তারা হত্যা করতে থাকে দেশব্যাপী মুক্তমনা লেখক, ধর্মীয় নেতা, পুরোহিত এবং সে সঙ্গে লালনভক্ত বাউলদের । যে সব মাজারে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের যাতায়াত আছে তেমন মাজারগুলোও তাদের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়। হোটেল আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটাতেও তারা কার্পণ্য করেনি।

৩। ড. জাফর ইকবাল শহীদ পরিবারের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নেতৃত্বে একদল রাজাকার তাঁর পুলিশ অফিসার পিতাকে হত্যা করে। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদের অনুজ ড. জাফর ছোটবেলা থেকে ছিলেন সহজ সরল ও কিছুটা বোকা ধরনের। শিশু বয়সে যে তিনি পড়ালেখাকে এক প্রকার ভয় পেতেন সেই তিনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বেল ল্যাবরেটরিতে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। মনে রাখা দরকার এমন চাকরি বাংলাদেশিদের জন্য সোনার হরিণের মতো।

বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ দেশের সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য গমন করেন যাঁদের অধিকাংশই আর দেশে ফিরে আসেন না। এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অনেক শিক্ষক–বৃত্তি নিয়ে বিদেশে গিয়ে ফিরে আসেন না। অনেক শিক্ষক লিয়নে গিয়ে বিদেশে অর্থ উপার্জন করেন কিন্তু নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কথা ভাবেন না। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন উত্তোলন করে বিদেশে মেধা খরচ করেন সে দেশের একজন হয়ে ড. জাফর ইকবাল শুধু দেশকে ভালোবেসে, দেশের সন্তানদের বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে তুলবেন বলে আমেরিকায় লোভনীয় চাকরি, আরাম–আয়েশ আর নিরাপদ জীবনকে দূরে ঠেলে দিয়ে সিলেটের মতো আধা শহর আধা গ্রামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিলেন। নিজেই শুধু নন, সঙ্গে তাঁর স্ত্রীকেও নিয়ে এলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার কিছুকাল পরে প্রীতিলতার নামে ছাত্রী নিবাসের নামকরণের দাবি করে তিনি প্রথমে রোষানলে পড়েন ছাত্র শিবিরসহ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির। তাই জাফর ইকবালের সমর্থনে হুমায়ুন আহমেদ সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় ফটকে অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন। সে কর্মসূচি ও ড. জাফর ইকবালের প্রস্তাবের সমর্থনে সারাদেশ থেকে অনেকেই তখন সে সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম থেকেও আমরা বেশ ক’জন গিয়েছিলাম।

৪। ড. জাফর ইকবাল রাজনীতি করা লোক নন। রাজনৈতিক বক্তব্য এড়িয়ে চলেন তিনি। শিক্ষা–শিক্ষার্থী আর মানবকল্যাণ ছাড়া অন্য বিষয়ে লেখেন না, বলেনও না। তাঁর প্রকাশের ভাষা কোমল, শোভন ও শালীন কিন্তু ভাবে, চেতনা ও আদর্শে ঋজু। তিনি ম্রিয়মান কিন্তু সাহসী। দলাদলিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত শিক্ষক সমাজ থেকেও তিনি ভদ্রজনোচিত দূরত্ব বজায় রেখেছেন ফলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাবও । তাঁর ব্যবহার এবং প্রকাশ সংযত, সংহত। আক্রান্ত হওয়ার পরও তিনিই বলতে পারেন আমি ওকেঃ

তোমরা উত্তেজিত হয়ো না। একজন মহৎ প্রাণ ব্যক্তিই শুধু এভাবে উচ্চারণ করতে পারেন। তিনি তখন আক্রান্ত। ব্যথায় কাতর। পরিণতি অনিশ্চিত এবং সময় তাঁর অনুকূলে এবং তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল। সে সময়ও তিনি মনে কোনো ক্ষোভ না রেখে, কোনো প্রতিহিংসা না রেখে বলতে পারেন, ‘তোমরা উত্তেজিত হয়ো না’। অথচ এই লোকটিকে নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র কত নগ্ন কুৎসিত আর কদর্য মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছে। তাঁকে বারবার সিলেট ছাড়ার হুমকি দিয়েছে। তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছে।

৫। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবো বিশ্বে এ ধরনের মহৎ লোকদেরই হত্যা করা হয়েছে। যাঁরা অকাতরে মুক্তির কথা বলেছেন, মানুষের কল্যাণের কথা বলেছেন তাঁদেরই বারবার হত্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। রাজনীতিবিদ থেকে বুদ্ধিজীবী পৃথিবীর নানা দেশে বারবারই খুনিদের, প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে খুন হয়েছেন। কিন্তু ঘাতক হায়েনারা প্রতিবারই বোঝে না, মানুষকে হত্যা করা যায়, তাঁর আদর্শকে নয়। বিশ্বকে জ্ঞান–বিজ্ঞানে আজ এত অগ্রসর যারা করেছেন তাঁদের কমবেশি সবাই তাঁর সময়ে তাঁর সমাজে মুর্খ–ভণ্ড ও কূপমণ্ডুকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, নিরুৎসাহিত হয়েছেন। মুক্তবুদ্ধির মানুষ সব দেশে সবকালে কমবেশি আক্রান্ত হয়েছেন। জ্ঞানের কথা বলে সক্রেটিস, বিজ্ঞানের কথা বলে গ্যালিলিও প্রাণ দিয়েছেন, মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। জোয়ান অফ আর্ককে পুড়িয়ে মারা হয়েছে ধর্মের দোহাই দিয়ে।

আমি উল্লেখ করেছিলাম সবসময় আক্রান্ত হয়েছে মানবতাবাদী লেখক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদরা। প্রতিক্রিয়াশীল মূর্খ, কূপমণ্ডুক, ভণ্ডরা কখনো আক্রমণের শিকার হয়নি। তেমন গোষ্ঠীর কাউকে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়নি। ত্রিশবার চেষ্টা করেও হিটলারকে হত্যা করা যায়নি। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মহাত্মা গান্ধী, আব্রাহাম লিঙ্কন, মার্টিন লুথার কিং, জন এফ কেনেডিদের মতো বরেণ্য রাজনৈতিক নেতা, যাঁরা মানুষকে ভালোবেসেছিলেন তাদের কত সহজে আর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ দেশে আজ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে অন্তত ২০ বার চেষ্টা করা হয়েছে। যার মধ্যে ২১ আগস্টের ঘটনা সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়া বা ওই ঘরানার রাজনীতিকদের মধ্যে কাউকে প্রতিপক্ষের হিংসার রাজনীতির কারণে হত্যা হতে হয়নি। আক্রমণের শিকার হতে হয়নি। তাই বলে আমি খালেদা জিয়া বা তার মতাদর্শের কারো ওপর আক্রমণ প্রত্যাশা করছি না। আমি সে ধরনের অপরাজনীতিকে, হত্যাতন্ত্রকে কখনো সমর্থন করিনি, করতে পারি না।

৬। এই রাষ্ট্রের সূচনাটি হয়েছিল ভালো। ত্রিশ লাখ প্রাণ আর চার লাখের মতো নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া রাষ্ট্রটিকে মানবিক, উদার ও সত্যিকারের জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংবিধানের মূলস্তম্ভ হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করেছিলেন নতুন রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাকে হত্যা করে দেশকে সে লক্ষ্যের অভিযাত্রা থেকে বিরত করা হয়েছে। দেশকে আবার পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের আড়ালে মূলত ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ খুলে দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৪৬ বছরের মধ্যে মোট ২৮ বছর সেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে, সংবিধানকে কলঙ্কিত করে রাষ্ট্র ও সমাজে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর শক্তি বৃদ্ধি করেছিল। ফলে একাত্তরের চেতনা থেকে, অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে রাষ্ট্র ও সমাজ আজ বহুদূর সরে এসেছে। বরং আজ পরাজিত সেই সাম্প্রদায়িক শক্তিই সমাজের বড় নিয়ামক হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীদের অর্থসাহায্যে দেশে অনাধুনিক ধর্মশিক্ষার প্রসার বেড়েছে। সমাজের সর্বক্ষেত্রে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম ত্রুটি ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় তার লাখ লাখ শিক্ষার্থী বেড়ে উঠেছে এক ধরনের অসুস্থ মানসিকতায়। এর সাথে সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতি, তালেবান আইএসের মতো চরম উগ্রবাদী দলের প্রকাশ ঘটেছে, তাদের ভ্রান্ত মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের অনেকে চরম জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গেছে।

এরফলে যে রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বে দেশে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলো, যারা স্বাধীনতার পর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করেছিল তারাও বর্তমানে সে সাম্প্রদায়িক শক্তিতে তোয়াজ করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। হেফাজতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখছে, তাদের কথামতো আমাদের পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রমেও পরিবর্তন হচ্ছে। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাতে নিহত দেশের মুক্তবুদ্ধির লেখকদের হত্যার বিচারের পক্ষে দৃঢ় ভূমিকা নিতে ভয় পাচ্ছে।

৭। মার্চ মাস বাঙালির স্বাধীনতার মাস। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরব ও অহংকারের মাস। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই বাঙালি অর্জন করেছিল তার প্রথম স্বাধীন ভূখণ্ড। বাঙালির অবিসাংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নির্দেশে বাঙালি সেদিন রচিত করেছিল এক স্বর্ণালী অধ্যায়ের। সূচনা করেছিল মুক্তির পথের এক দীর্ঘ সংগ্রামের। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি বটে। কিন্তু তার সে কাঙিক্ষত মুক্তি সে তো আসেনি। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে মুক্তির কথাই বারবার উচ্চারণ করেছিলেন। স্বাধীনতার জন্য আমাদের যে যুদ্ধ তার নামও মুক্তিযুদ্ধ। সে যুদ্ধ যারা করেছেন তাদের বলা হয় মুক্তিযোদ্ধা। যে কারণে আমরা বলে থাকি মুক্তিযুদ্ধ অবিনশ্বর ও অবিনাশী। মানুষের প্রকৃত মুক্তি না হলে স্বাধীনতার কোনো অর্থ থাকবে না। ফলে বঙ্গবন্ধুর সে মুক্তির অর্থ ও তাৎপর্য খুবই গভীর এবং ব্যাপক।

সে মুক্তি হলোণ্ডদারিদ্র্য থেকে, শোষণ–বঞ্চনা থেকে, অশিক্ষা–কুসংস্কার–কূপমণ্ডুকতা থেকে। সে মুক্তি হলো, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ থেকে। সে মুক্তি হলো, সকল নিষ্ঠুরতা–নির্মমতা–অমানবিকতা থেকে, সে মুক্তি হলো অন্ধকার থেকে। ড. জাফর ইকবাল এবং তাঁর মতো যারা প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী তাঁরা সেই মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজকে বঙ্গবন্ধুর উল্লেখিত মুক্তি দিতে চাইছেন। কাজেই এঁদের পাশে থাকা, এঁদের সুরক্ষা দেওয়া এবং এঁদের কাজ করতে দেওয়ার পুরো দায়টা আওয়ামী লীগের পক্ষান্তরে বর্তমান সরকারের। মনে রাখতে হবে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সমর্থনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেনি। দেশ স্বাধীন হয়নি। বরং এই শক্তিই চরম বিরোধিতা করেছিল আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির।

যাঁরা বাংলাদেশকে চায়, যাঁরা প্রকৃত স্বাধীনতাকে চায়, যাঁরা ‘বাংলার মানুষের মুক্তি’ চায় তারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকেই বাস্তবায়ন করতে চায়। তাদের দূরে রেখে, গুরুত্বহীন করে জাতির জনকের কাঙিক্ষত মুক্তি কখনো আসবে না।

ঘাতকদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার যদি না হয় বারবার যদি মুক্তবুদ্ধির মানুষদেরই দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় তাহলে সমাজে দানবদেরই সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যারা পোস্টার ছেপে, সড়ক অঙ্কন করে প্রকাশ্যে ড. জাফর ইকবালকে হুমকি দিয়েছে তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে ভয়হীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আখেরে মিত্র হয়ে পাশে থাকবেন ড. জাফর ইকবালের মতো উদার মানুষগুলোই। দানব বা ঘাতকরা নয়। চাপাতির নিচে যে আজ মানবতা বিপন্ন হচ্ছে তা রোধ করতে না পারলে রাষ্ট্রও ব্যর্থতার পথে যাবে।

[email protected]

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত