
বিপুল বড়ুয়া, ১০ মার্চ, এবিনিউজ : সময়–যাপিত জীবন যেনো এক সমান্তরাল চলমানতা। সময় ফুরিয়ে যায়–জীবন এগিয়ে চলে অনন্তকালের নিঃসীম আহ্বানে। তাইতো জীবনের এগিয়ে চলার মুহূর্তে সময়ের নানা কথা কাহন; চিত্র–বিচিত্রতা, স্মৃতি–অনুষঙ্গ থমকে দেয় মানুষকে। ভাবিয়ে তোলে দীর্ঘশ্বাস–আর্তি অব্যক্ততার নানা প্রসঙ্গ পাঠ। সময় এভাবেই মানুষের জীবনে এক বড়ো নিয়ামক হয়ে দেখা দেয়। সময়ের অনুপুঙ্খ কাটাছেঁড়ায় মানুষ কখনো আনন্দ খোঁজে–কখনো বা বিষাদ আকঁড়ে ধরে তার চলমানতাকে–চলমান জীবনযাপনকে।
মহসীন কাজী সংবাদের এক নিবিষ্ট জন। সাংবাদিকতার সাথে–সংবাদের সুলুকসন্ধানের সাথে তাঁর দীর্ঘ সময়ের পথচলা। সংবাদের জগতে দীপ্ত পদচারণায় তিনি যেমন দেখেছেন সংবাদের কুশীলবদের খুব কাছ থেকে–তেমনি সংবাদের পারিপার্শ্বিকতার নানা অনুষঙ্গ–তার বিষয় বৈচিত্র্যকেও অনুধাবন করেছেন সে এক পাকা জহুরীর মতো। তাই অতসব সময়কাল–পাত্র–বীক্ষণ নিয়ে চুলচেরা ভেবেছেন সাংবাদিক মহসীন কাজী। অতপর তার দীর্ঘ সময়ের লক্ষ্য–অনুধ্যানের বিষয়কে উপজীব্য করে এসেছেন–প্রকাশনার দিগপ্রান্তে। নিজের অবলোকন–অভিজ্ঞানকে মলাটবন্দি করেছেন–তাঁর প্রথম গ্রন্থ -‘সময়ের কাটাছেঁড়া’য়।
সাংবাদিকের ব্যস্তসমস্ত জীবনযাপনের পাশাপাশি মহসীন কাজী নানা দিকে–বলয় সৌকর্যে প্রকাশ করেছেন–তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার টুকরো–টুকরো কিছু কিছু স্মৃতি–পেশাগত কর্ম কাহিনি–সাংবাদিকের পোড় খাওয়া জীবনের বর্ণিল অথচ স্মরণীয় মুহূর্তের অনুপুঙ্খ কথামালা। আবার মহসীন কাজী কখনোবা খুব কাছ থেকে দেখা চলমান স্বজীবনের গভীর আত্মতৃপ্তির কিছু স্মৃতি–তার চারপাশের চেনা জানা ব্যক্তি–ব্যক্তিত্বের আকর্ষণীয় জীবনকথা–যাতে রয়েছে অনেক অজানা জীবন অধ্যায়ের ঝলমলে চকিত আলোচনা।
সাংবাদিক মহসীন কাজীর এবারের বইমেলায় প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ যথার্থ সাক্ষ্য দেয়–উল্লিখিত ছোট্ট পর্যালোচনার। ‘সময়ের কাটাছেঁড়া’য় রয়েছে–বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল আমাদের অহংকার, বঞ্চিত বীরের বিদায়, মুক্তিযুদ্ধে মির্জা পরিবার, টার্গেট অ্যাভলুজ, একটি চিঠির গল্প, যে নির্বাচনে ভোটার ছিল না, গুডস হিলে বিনিদ্র
রজনী, বাবা, মায়ের সাথে হজ, জ্ঞানের বাতিঘর, আলো আসার আগে, গৌরব আর উদ্বেগের চট্টগ্রাম কলেজ, পণ্যমূল্যে কারসাজি ও মজুদদারী, ভেজালের জাল, ১০ ট্রাক অস্ত্র, হুমকির মুখে সাগরের মাছ, প্রাথমিক শিক্ষা–কাছ থেকে দেখা তিন বছর, মালেক মামা, সিনেমা হলের সুদিন দুর্দিন ও সময়ের কাঁটাছেড়া শিরোনামে বিষয় বৈচিত্র্যধর্মী নিবন্ধ। লেখক মহসীন কাজী তার এ গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে সময়কালের বেশ কিছু উল্লেখ্য বিষয়– চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের দৃপ্ত ম্যুরাল স্থাপনের বিশদ বিবরণ। লেখক ছিলেন ম্যুরাল নির্মাণ কমিটির আহবায়ক। দেশজ গানের বিরলপ্রজ গায়ক মোহাম্মদ শাহ বাঙালির গৌরব–দুঃখ গাথার কথামালা, স্বাধীনতা যুদ্ধে ফটিকছড়ির নানুপুরের ঐতিহ্যবাহী মির্জা পরিবারের অবদানের যথার্থ বর্ণনা। বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা –আবু মুসা চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রিসের তেলবাহী জাহাজ অ্যাভলুজ মাইন দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার গৌরবগাথা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে আত্মাহূতি দেওয়া বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের গল্প, ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত সন্দ্বীপের সেই ভোটারবিহীন পৌর নির্বাচন কভার করার প্রত্যক্ষ বর্ণনা। সেই ভোটারবিহীন নির্বাচন ছিল দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এক নতুন ঘটনা। গুডস হিলে কুখ্যাত সাকা চৌধুরীর গ্রেপ্তারপূর্ব সময়ের কথা, দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের নানা বিষয় প্রসঙ্গ।
সাংবাদিক মহসীন কাজী ফিরে গেছেন সেই জীবনের প্রথম প্রহরে–বলেছেন বাবার গল্প–বাবার কাছাকাছি থেকে বড়ো হওয়ার সুখের কথা, মার সাথে হজ করার মতো সৌভাগ্যবান মহসীন কাজী লিখেছেন–সৌদি আরব–পবিত্র মক্কা–মদিনায় হজের সময়কালের অনুপুুঙ্খ কথামালা। আত্মজা দোয়ার পৃথিবীতে আসার সময়কালের নানা বিপত্তি–চিকিৎসা অঙ্গনের খেয়ালখুশির কড়চা তুলে ধরেছেন, চট্টগ্রাম কলেজের পূর্বাপর নানা প্রাসঙ্গিকতার অর্থবহ পরিবেশ–পরিস্থিতির সাম্প্রতিক বৃত্তান্ত উপস্থাপন করেছেন, মজুদদার–অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের ঘৃণ্য স্বরূপ উদঘাটন করেছেন, বলেছেন ভেজালের আবর্তে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণের কথা, আমাদের সাগরের মৎস্য সম্পদের বেহাত হয়ে যাওয়া নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা করেছেন, পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে থেকে প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল অবস্থা দেখে শংকিত হয়েছেন, সংবাদপত্রের পেছনের মানুষ মালেক মামার ব্যতিক্রমী জীবনের কথা তুলে ধরেছেন, বিস্তারিত আলোচনা করেছেন–আমাদের সিনেমা হলের সাম্প্রতিক হতশ্রী অবস্থা নিয়ে, সর্বশেষ লেখক তাঁর পেশাগত জীবনের পূর্বকথা–উত্তরণের নানা দিকপ্রান্ত–সফলতা অর্জন নিয়ে সোজাসাপ্টা কথা বলেছেন। শুধু পেশাগত জীবনকথা নয়–তার বাইরে পৃথিবীর দিকে সযত্ন দৃষ্টি দিয়েছেন লেখক–ভেবেছেন আর্থ–সামাজিক বিষয় আশয় নিয়ে–স্বকীয় চারপাশ ঘরগেরস্থি পরিমণ্ডল নিয়ে–মাথায় রেখেছেন নিজের দায়–দেনা নিয়ে–করেছেন সকৃতজ্ঞ স্বীকারোক্তি, যা একজন লেখককে অনেক বড়ো করে।
সাংবাদিক মহসীন কাজী–পেশাগত জীবনে একজন আদ্যোপান্ত সাংবাদিক। সাংবাদিকদের নানা সংগঠন, সংস্থার সাথে তাঁর রয়েছে গভীর মেলবন্ধন। পস্টাপস্টি কথা বলার মানুষ। তাই তিনি তার পেশাগত জীবনের পাশাপাশি তার চারপাশের চোখে পড়া নানা অসঙ্গত কিংবা কারো প্রতি অবজ্ঞা–অবহেলার চালচিত্রও তিনি কুশলতার সাথে তুলে ধরেছেন তার প্রথম গ্রন্থ ‘সময়ের কাটাছেঁড়া’য়। তাঁর অবলোকন–অনুধাবন প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর বর্ণনা–বিষয় বিস্তারে রাশ টেনে ধরে কথা বলে যাওয়া বা বক্তব্যকে প্রকাশে সতর্ক থাকার অহেতুক ভারী না করার বিষয়টি বেশ চোখে পড়ে। ছোট ছোট অবয়বের ভেতর তিনি নিজের ভাব–বক্তব্যকে বেশ সপ্রতিভ ভাবে প্রকাশ করে ‘সময়ের কাটাছেঁড়া’–পাঠকের কাছে বেশ উপভোগ্য করে তুলে ধরতে পেরেছেন। বলা যায় বেশ আকর্ষণীয় পাঠের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তার প্রথম গ্রন্থকে।
সাংবাদিক–কথা সাহিত্যিক জাহেদ মোতালেব-‘সময়ের কাটাছেঁড়া’র লেখা ও লেখক মহসীন কাজীকে নিয়ে চমৎকার চকিত আর চুম্বক কথা লিখেছেন। ভালো লেগেছে সাংবাদিক মহসীন কাজীর–আত্মকহন–সবিনয় কথা। এই গ্রন্থের চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন–শিল্পী আলোকময় তলাপাত্র। মুহাম্মদ নুরুল আবসারের আবির প্রকাশনের সৌকর্যময় প্রকাশনা– একশত আটাশ পৃষ্ঠার সাংবাদিক মহসীন কাজীর – অনবদ্য গ্রন্থ ‘সময়ের কাটাছেঁড়া’র মূল্য দুইশত পঞ্চাশ টাকা।(সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি