ড. মইনুল ইসলাম, ১০ মার্চ, এবিনিউজ : চলমান অর্থবছরে যে অস্বাভাবিক গতিতে আমদানির ঋণপত্র খোলার হিড়িক পড়েছে, তা দ্রুত কমিয়ে ফেলতে কঠোরভাবে লাগাম টেনে না ধরলে ২০১৭-১৮ অর্থবছর সমাপ্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের আমদানি বিল ৬০ বিলিয়ন ডলার মানে ৬ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আমদানি বিল ২৯ শতাংশ বেড়ে গেছে গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানি এবং চাল, জ্বালানি তেল, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধির কারণে এহেন দ্রুতগতিতে আমদানি বেড়ে চলেছে বলে বলা হচ্ছে। গত অর্থবছরে যেখানে পুরো বছরে ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়েছিল, সেখানে এ বছর ছয় মাসেই আমদানি হয়েছে ২৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য (এ সময় চাল ও গম আমদানি বেড়েছে ২১২ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৩৪.৫৮ শতাংশ)। এহেন আমদানির হিড়িক নিয়ে অর্থমন্ত্রী কিংবা বাণিজ্যমন্ত্রীর কোনো মাথাব্যথা আছে বলে লক্ষণ মিলছে না। অথচ এ বিপজ্জনক প্রবণতা আমাদের অর্থনীতির সাম্প্রতিককালের ‘ম্যাক্রোইকোনমিক ব্যালান্স’ বা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করার অশনিসংকেত ধারণ করছে। সেজন্যই এ ব্যাপারে আমাদের নীতিপ্রণেতাদের বিশেষত অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের নির্বিকার নীরবতায় আমি শংকিত। তথাকথিত ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে আমাদের নীতিনির্ধারকরা হয়তো এত বেশি মশগুল হয়ে রয়েছেন যে, অতিমাত্রিক আমদানি উদারীকরণের ফলে উদ্ভূত এহেন এলসি খোলার মাতামাতিকে তারা অর্থনীতির পালে জোরদার হাওয়া লাগার ফল বলে সিদ্ধান্ত টেনে তৃপ্তির নিঃশ্বাস টেনে নির্বিকার থাকাকেই সমীচীন মনে করছেন! তারা কেন বুঝতে চাইছেন না যে, আমদানি ঋণপত্র খোলার এ ক্রমবর্ধমান জোয়ার আসলে সত্যিকার আমদানি পণ্য ক্রমবর্ধমান পরিমাণে দেশে আসার নিশ্চয়তা দেবে না; বরং এর একটা বড় অংশ ‘ওভার ইনভয়েসিং’ পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারের মতলবেই ব্যবহূত হচ্ছে? এখন সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন যে, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সমস্যার সঙ্গে পুঁজি পাচার সমস্যার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। আবার এটাও জানা কথা যে, ‘ওভার ইনভয়েসিং অব ইমপোর্টস’ হলো পুঁজি পাচারের বহুল ব্যবহূত এবং সবচেয়ে পুরনো হাতিয়ার। এ ব্যাপক ওভার ইনভয়েসিংয়ের ফলেই ব্যাংকিং খাতে কয়েক বছর ধরে চলে আসা ‘উদ্বৃত্ত তারল্য সংকট’ গত এক বছরে ‘তারল্য ঘাটতি সংকটে’ রূপান্তর হয়ে গেছে। আমাদের দেশের রফতানিকারকরা সাম্প্রতিককালে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং অব এক্সপোর্টস’ (ইনভয়েসে রফতানি কম দেখানো) ও ‘রিটেনিং দি এক্সপোর্ট আর্নিংস অ্যাব্রোড’ (রফতানি আয় বিদেশ থেকে দেশে না আনা)- এ দুটো পদ্ধতিকেও পুঁজি পাচারের জন্য ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করা শুরু করেছেন। বিশেষত তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের বিরুদ্ধে ওয়াকিবহাল মহল এ দুটো পদ্ধতিতে পুঁজি পাচারের অভিযোগ জোরদার করে চলেছে। গার্মেন্ট রফতানিকারকরা রফতানি আয় দেশে নিয়ে এসে যথাযথভাবে ব্যাংকে জমা না দেয়ার লক্ষণ ফুটে উঠছে ক্রমবর্ধমান ‘ফরেন কারেন্সি পাইপলাইন’ সমস্যাটির গভীরে গেলে। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং যে অনেক বেশি জোরদার করা প্রয়োজন, তা সবাইকে বারবার মনে করিয়ে দেয়া সময়ের দাবি। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) এবারের পেমেন্ট জমা দেয়ার পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে নিঃসন্দেহে। উল্লিখিত বিষয়গুলো মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।
দেশের কিছু অর্থনীতিবিদ আমদানিপ্রবাহে জোয়ার দেখা গেলে সেটাকে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধির আগাম সিগনাল হিসেবে বিবেচনা করতেই পছন্দ করেন। কারণ প্রধানত যন্ত্রপাতি, প্লান্ট, যন্ত্রাংশ ও মধ্যবর্তী পণ্যের মতো মূলধনি পণ্যের কিংবা শিল্পের কাঁচামালের আমদানির এলসি খোলার হিড়িক পড়লে অদূরভবিষ্যতে তা শিল্প খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল হিসেবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে বলে একটা দৃঢ়মূল ধারণা রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে। এ ধারণাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে দুই দশক ধরে যেভাবে পুঁজি পাচারের প্রবণতা দিন দিন জোরদার হয়ে চলেছে, তাতে এ ধারণা পোষণ বিষয়টার অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে যে, মূলধনি পণ্যের আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং এখন বাংলাদেশে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) অত্যন্ত বিপজ্জনক তথ্য জানিয়েছে যে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার পুঁজি পাচার হয়েছে। পরবর্তী বছরগুলোর তথ্য এখনো জিএফআই প্রকাশ করেনি। আমার কাছে জিএফআইয়ের উল্লিখিত এ তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গত চার বছরে বাংলাদেশ থেকে বছরওয়ারি পুঁজি পাচারপ্রবাহ ১০-১১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গেছে। আরেকটি চাঞ্চল্যকর খবরে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এ খবরের পেছনে ভালো গবেষণা রয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে ৯-১০ বিলিয়ন ডলার করে প্রতি বছর যদি পাচার হয়, তাহলে এক দশকে পাচার করা অর্থের পরিমাণটা উল্লিখিত অংকে পৌঁছে যাবে বৈকি! প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসে থাকা হুন্ডি পদ্ধতি দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকে ক্রমে সহজ করে দিচ্ছে, এটাও ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। আর হুন্ডি পদ্ধতিতে পুঁজি পাচারের গতিসঞ্চারের সরাসরি আলামত মিলছে প্রবাসী আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্সপ্রবাহে গত তিন বছরের অবনমন কিংবা প্রায় স্থবিরতার চিত্রে। আরো একটা আলামত হলো, ডলারের বিনিময়হারের সাম্প্রতিক অবনমন থামানো যাচ্ছে না। বিশেষত কার্ব মার্কেটে ১ ডলারের দাম মাঝেমধ্যে ৮৫-৮৭ টাকায় উঠে যাচ্ছে। ২০১৮ সাল যেহেতু নির্বাচনের বছর, তাই আগামী মাসগুলোয়ও ক্ষমতাসীন দল ও জোটের মার্জিন আত্মসাত্কারী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ আমলা-প্রকৌশলী-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পুঁজি পাচারে আরো সক্রিয় হবে— এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্বের রেমিট্যান্সের গন্তব্য দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ষষ্ঠ; ভারত, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে এ ব্যাপারে (পাকিস্তানেরও প্রায় এক কোটি অভিবাসী বিদেশে থাকলেও আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে তাদের রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাংলাদেশের তুলনায় ক্ষুদ্রতর)। আমার গবেষণায় যে বিষয়টি রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে উঠে এসেছে তা হলো, বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ‘হুন্ডি’ পদ্ধতিতেই দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে চলেছেন। ফলে বিশ্বের দেশে দেশে যেখানেই বাংলাদেশী অভিবাসীদের ঘনত্ব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, সেখানেই হুন্ডি চক্রগুলোর হাতে অভিবাসীদের সঞ্চয়ের বিপুল একটা অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। অভিবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার এ অংশটা একটা ‘প্যারালাল বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে’ পণ্য হিসেবেও ক্রয়-বিক্রয় হয়ে চলেছে। প্রধানত মার্কিন ডলারেই এ বাজারে ক্রয়-বিক্রয় চলে বিধায় এটাকে ‘হুন্ডি ডলারের বাজার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। জোগান ও চাহিদার শক্তিশালী কাঠামো গড়ে ওঠায় ‘হুন্ডি ডলারের’ এ বাজার দেশে-বিদেশে ক্রমপ্রসারমাণ। বিশেষত গত তিন দশকে বাংলাদেশে বৈধ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের সমান্তরালে এ ‘কার্ব মার্কেট’ প্রসারিত হয়ে দেশের বড় নগরীর সীমা পেরিয়ে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আর তেমন রাখঢাকের প্রয়োজন পড়ছে না কার্ব মার্কেটে ডলার কেনাবেচায়, এমনকি ব্যাংকারদের মধ্যস্থতায় অতি সহজেই নগদ ডলারের ব্যবসা চলছে খোলামেলাভাবে। পত্রপত্রিকায় ডলারের যে দাম প্রকাশিত হয়, তার চেয়ে এক-দেড় টাকা বেশি দামে দেদার ডলার ক্রয় করা যায় কোনো ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু এ হুন্ডি ডলার বাজারের অপব্যবহার দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুঁজি পাচারকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে। গত অর্থবছরে ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠানো হয়েছে বলে সরকারিভাবে তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা হলেও হুন্ডি পদ্ধতিতে সারা বিশ্বের ডলার বাজারে বাংলাদেশী অভিবাসী ও অনিবাসী বাংলাদেশীরা কত পরিমাণ ডলার জোগান দিয়েছেন, তার কোনো প্রাক্কলিত তথ্য-উপাত্ত সরকারিভাবে কিংবা কোনো বিশ্বাসযোগ্য গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া খুবই দুরূহ, প্রায় অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হবে না। এ ব্যাপারে যে অংকগুলো মাঝে মধ্যে বিভিন্নজন উদ্ধৃত করে থাকেন, সেগুলোর পেছনে ভালো গবেষণার অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় ওগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বোধগম্য কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য বিষয়টার গতি-প্রকৃতির কারণে। তবে আমার গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হুন্ডি ডলার বাজারে পাচার হওয়া বাংলাদেশী অভিবাসীদের সঞ্চয়ের এ বিশাল প্রবাহটার প্রধান ফায়দাভোগীতে পরিণত হয়েছে চোরাচালানিরা এবং দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারী ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস মালিক-শিল্পপতি, দুর্নীতিবাজ আমলা ও পুঁজি-লুটেরা রাজনীতিবিদরা। যতই দেশপ্রেমের ধুয়া তোলা হোক না কেন, বাংলাদেশী অভিবাসীদের বৃহদাংশের হুন্ডি পদ্ধতি ব্যবহারকে সহজে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। কারণ হুন্ডি পদ্ধতির কতগুলো সুবিধা প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হওয়াই স্বাভাবিক। যেমন— ডলারে এক-দেড় টাকা বেশি বিনিময়হার পাওয়ার পাশাপাশি অতি দ্রুত রেমিট্যান্সের টাকা প্রাপকের কাছে গোপনীয়তার সঙ্গে পৌঁছে দেয়া হয়। পাঠানোর কোনো খরচও বহন করতে হয় না প্রেরককে। প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনরা জানতেও পারে না, কখন কত পরিমাণ টাকা রেমিট্যান্স পাওয়া গেছে। ফলে চোর-ডাকাত-প্রতারকরা টের পাওয়ার আগেই প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যরা টাকাটা ব্যাংকে জমা করে দিতে পারেন। এখন মোবাইল, টেলিফোনে টাকা পাঠানোর খবরটা প্রাপককে জানানো যায়, তেমন কোনো খরচ পড়ে না। আর যেহেতু বিশ্বস্ততাই এ ব্যবসার আসল চাবিকাঠি, তাই টাকা মেরে দেয়ার তেমন ঝুঁকি থাকে না। আমার গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেহেতু উল্লিখিত গোষ্ঠীগুলো হুন্ডির মাধ্যমে সংগৃহীত ডলারের চাহিদাকে চাঙ্গা করে রাখছে, তাই হুন্ডি ডলারের রমরমা ব্যবসা সহজে বন্ধ হবে না। অতএব, দেশে না আসা এহেন হুন্ডি ডলারই আমদানির ওভার ইনভয়েসিংয়ের পাশাপাশি দেশ থেকে পুঁজি পাচারের বড় সুযোগ সৃষ্টি করছে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
আমদানি ওভার ইনভয়েসিং দেশ থেকে ব্যাংক-পুঁজি পাচারের সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত হলেও পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যাংকঋণের একটা বিপুল অংশ যে হুন্ডি পদ্ধতিতে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। ব্যাংক ঋণখেলাপিদের ওপর ২০১০ সালে প্রকাশিত আমার ও মহিউদ্দিন সিদ্দিকীর গবেষণা গ্রন্থ A Profile of Bank Loan Default in the Private Sector in Bangladesh-এ উপস্থাপিত বাংলাদেশের ১২৫টি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত জরিপের সংগৃহীত তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, ওইসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকরা তাদের ব্যাংকঋণের একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। বিশেষত ওই বইয়ে প্রকাশিত ৩১ জন ‘স্টার ঋণখেলাপির’ কেস স্টাডিতে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে, তাদের বেশির ভাগই ১৯৭২-২০০৭ পর্যায়ে ব্যাংকঋণ বাগিয়েছেন তাদের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কানেকশন কিংবা দুর্নীতির বখরা ভাগাভাগির ‘সিস্টেমের’ ফায়দাভোগী হয়ে। এ প্রবণতা গত ১১ বছরে আরো মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন বাংলাদেশের ধনাঢ্য-উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পেশাজীবীদের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে গেছে যে, তাদের পরিবার-পরিজন-সন্তানদের জন্য বাংলাদেশ আর বাসযোগ্য জায়গা বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয় এবং তাদের যথাসম্ভব শিগগির বিদেশে পাড়ি জমাতেই হবে। বলা বাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তাদের বিবেচনায় স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য। কিন্তু ওই দেশে অভিবাসী হওয়া তো খুবই দুরূহ। তাই কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ইতালি এবং সম্ভব হলে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে পাড়ি জমানোর প্রাণপণ প্রয়াস এখনকার সচ্ছল পরিবারগুলোর অহর্নিশ সাধনায় পরিণত হয়েছে। এটাই এখনকার বাংলাদেশী উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের জীবনে প্রধান মিশনে রূপান্তর হয়েছে বলা চলে। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমার কাছে বিষয়টার আপত্তিজনক দিক হলো, দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বৃহদাংশই ব্যাংকঋণ পাচারকেই তাদের এ মিশনের মূল ‘মেকানিজম’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। ফলে দেশের মহামূল্যবান বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বঞ্চিত হয়ে চলেছে। বাংলাদেশী ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সমাজের বেশ কয়েকজন দিকপাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন দেশ থেকে পুঁজি পাচারের মাধ্যমে (তাদের নাম আমার গবেষণায় উঠে এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের পুঁজি পাচারের হদিস পাচ্ছে না কেন?)।
ওভার ইনভয়েসিং সম্পর্কে সরকার যদি তথ্য সংগ্রহে আগ্রহী হয়, তাহলে গত কয়েক বছরের আমদানির রেকর্ড মোতাবেক আমদানিকৃত ক্যাপিটাল মেশিনারি দেশে সত্যি সত্যি এসেছে কিনা, তার খবর মাঠপর্যায় থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা মোটেই কঠিন কাজ নয়। কাজটি দুর্নীতি দমন কমিশনের অগ্রাধিকারসহকারে করা উচিত। কাস্টমস ইন্টেলিজেন্সকেও এ তথ্য পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়া যায়। যেসব মূলধনি যন্ত্রপাতির জন্য ঋণপত্র খোলা হচ্ছে, সেগুলোর সঠিক আন্তর্জাতিক দাম যাচাই করাও বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের যুগে একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারি কর্তৃপক্ষ ও দুদকের অজানা নয় যে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমসের সঙ্গে বখরা ভাগাভাগির চুক্তি ছাড়া ওভার ইনভয়েসিং অব ইমপোর্টস সম্ভব নয়। অতএব, সমস্যাটার কার্যকর মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন দুদকের সক্রিয়তা ও সততা। দুদকের প্রতি সেজন্য আমাদের আকুল আবেদন, আর বিলম্ব না করে পুঁজি পাচার প্রতিরোধে এগিয়ে যান। পুঁজি পাচারকারীরা জাতির শত্রু। তাদের দমন করতেই হবে। (বণিক বার্তা)
লেখক : ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়