বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo
  • হোম
  • মুক্ত মতামত
  • সময় থাকতে লাফিয়ে বেড়ে চলা আমদানি প্রবাহের মাধ্যমে পুঁজি পাচারের লাগাম টেনে ধরুন

সময় থাকতে লাফিয়ে বেড়ে চলা আমদানি প্রবাহের মাধ্যমে পুঁজি পাচারের লাগাম টেনে ধরুন

সময় থাকতে লাফিয়ে বেড়ে চলা আমদানি প্রবাহের মাধ্যমে পুঁজি পাচারের লাগাম টেনে ধরুন

ড.মইনুল ইসলামের কলাম, ১১ মার্চ, এবিনিউজ : চলমান অর্থ–বছরে যে অস্বাভাবিক গতিতে আমদানির ঋণপত্র খোলার হিড়িক পড়েছে তা দ্রুত কমিয়ে ফেলার জন্যে কঠোরভাবে লাগাম টেনে না ধরলে ২০১৭–২০১৮ অর্থ–বছর সমাপ্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের আমদানি বিল ৬০ বিলিয়ন ডলার মানে ৬০০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। চলতি অর্থ–বছরের জুলাই–ডিসেম্বর সময়ে আমদানি বিল ২৯ শতাংশ বেড়ে গেছে গত অর্থ–বছরের ঐ ছয় মাসের তুলনায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সহ বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানি, চাল, জ্বালানী তেল, ক্যাপিটাল মেশিনারী এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধির কারণে এহেন পাগলা ঘোড়ার গতিতে আমদানি বেড়ে চলেছে বলে বলা হচ্ছে। গত অর্থ–বছরে যেখানে পুরো বছরে ৪৩.৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়েছিল, সেখানে এবছর ছয় মাসেই আমদানি হয়েছে ২৮.৪৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। (এসময় চাল ও গম আমদানি বেড়েছে ২১২ শতাংশ। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৩৪.৫৮ শতাংশ।) এহেন আমদানির হিড়িক নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী মহোদয় কিংবা বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয়ের কোন মাথাব্যথা আছে বলে লক্ষণ মিলছে না। অথচ, এই বিপজ্জনক প্রবণতা আমাদের অর্থনীতির সাম্প্রতিককালের ‘ম্যাক্রোইকনমিক ব্যালেন্স’ বা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে তছনছ করে দেয়ার অশনি সংকেত ধারণ করছে। সেজন্যেই এ–ব্যাপারে আমাদের নীতিপ্রণেতাদের বিশেষত অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের নির্বিকার নিরবতায় আমি শংকিত। তথাকথিত ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে আমাদের নীতি–নির্ধারকরা হয়তো এত বেশি মশগুল হয়ে রয়েছেন যে অতিমাত্রিক আমদানি উদারীকরণের ফলে উদ্ভূত এহেন এলসি খোলার মাতামাতিকে তাঁরা অর্থনীতির পালে জোরদার হাওয়া লাগার ফল বলে সিদ্ধান্ত টেনে তৃপ্তির নিঃশ্বাস টেনে নির্বিকার থাকাকেই সমীচীন মনে করছেন! তাঁরা কেন বুঝতে চাইছেন না যে আমদানি ্‌ঋণপত্র খোলার এই ক্রমবর্ধমান জোশ আসলে সত্যিকার আমদানী পণ্য ক্রমবর্ধমান পরিমাণে দেশে আসার নিশ্চয়তা দেবে না, বরং এর একটা বড় অংশ ‘ওভার ইনভয়েসিং’ পদ্ধতিতে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারের মতলবেই ব্যবহৃত হচ্ছে? এখন সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সমস্যার সাথে পুঁজি পাচার সমস্যার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। আবার, এটাও জানা কথা যে ‘ওভারইনভয়েসিং অব ইমপোর্টস’ হলো পুঁজি পাচারের সবচেয়ে বহুলব্যবহৃত এবং সবচেয়ে পুরানো হাতিয়ার। এই ব্যাপক ওভারইনভয়েসিং–এর ফলেই ব্যাংকিং খাতের গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা ‘উদ্বৃত্ত তারল্য সংকট’ গত এক বছরে ‘তারল্য ঘাটতি সংকটে’ রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আমাদের দেশের রপ্তানিকারকরা সাম্প্রতিককালে ‘আন্ডারইনভয়েসিং অব এক্সপোর্টস’ (ইনভয়েসে রপ্তানি কম দেখানো) এবং ‘রিটেনিং দি এক্সপোর্ট আরনিংস এব্রোড’ (রপ্তানি আয় বিদেশ থেকে দেশে না আনা)–এই দুটো পদ্ধতিকেও পুঁজি পাচারের জন্যে ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করা শুরু করেছেন। বিশেষত, তৈরী পোষাক রপ্তানিকারকদের বিরুদ্ধে ওয়াকিবহাল মহল এই দুটো পদ্ধতিতে পুঁজি পাচারের অভিযোগ জোরদার করে চলেছেন। গার্মেন্টস রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয় দেশে নিয়ে এসে যথাযথভাবে ব্যাংকে জমা না দেয়ার লক্ষণ ফুটে উঠছে ক্রমবর্ধমান ‘ফরেন কারেন্সী পাইপলাইন’ সমস্যাটির গভীরে গেলে। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং যে অনেক বেশি জোরদার করা প্রয়োজন তা সবাইকে বারবার মনে করিয়ে দেয়া সময়ের দাবি। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) এবারের পেমেন্ট জমা দেয়ার পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে নিঃসন্দেহে। উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো মোটেও ভাল লক্ষণ নয়।

আমাদের দেশের কিছু অর্থনীতিবিদ আমদানি প্রবাহে জোয়ার দেখা গেলে সেটাকে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধির আগাম সিগন্যাল হিসেবে বিবেচনা করতেই পছন্দ করেন, কারণ প্রধানত যন্ত্রপাতি, প্ল্যান্ট, যন্ত্রাংশ এবং ইন্টারমিডিয়েট পণ্যের মত মূলধনী পণ্যের কিংবা শিল্পের কাঁচামালের আমদানির এলসি খোলার হিড়িক পড়লে অদূর ভবিষ্যতে তা শিল্পখাতের উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল হিসেবে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে বলে একটা দৃঢ়মূল ধারণা রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে। এই ধারণাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে গত দুই দশক ধরে যেভাবে পুঁজি পাচারের প্রবণতা দিনদিন জোরদার হয়ে চলেছে তাতে এই ধারণা পোষণ বিষয়টার অতি–সরলীকরণ হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে যে মূলধনী পণ্যের আমদানিতে ‘ওভারইনভয়েসিং’ এখন বাংলাদেশে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে পড়েছে। নিউইয়র্ক ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফ আই) অত্যন্ত বিপজ্জনক তথ্য জানিয়েছে যে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় ৭৩,০০০ কোটি টাকার মত পুঁজি পাচার হয়ে গেছে বলে তাদের গবেষণায় পাওয়া গেছে। পরবর্তী বছরগুলোর তথ্য এখনো জিএফআই প্রকাশ করেনি। আমার কাছে জিএফআই–এর উপরে উল্লিখিত এই তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গত চার বছরে বাংলাদেশ থেকে বছরওয়ারী পুঁজি পাচার–প্রবাহ ১০–১১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গেছে। আর একটি চাঞ্চল্যকর খবরে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এই খবরের পেছনে ভাল গবেষণা রয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, তবে ৯–১০ বিলিয়ন ডলার করে প্রতি বছর যদি পাচার হয় তাহলে এক দশকে পাচার করা অর্থের পরিমাণটা উল্লিখিত অংকে পৌঁছে যাবে বই কী! প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স প্রেরণে গেড়ে বসে থাকা হুন্ডি পদ্ধতি দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকে ক্রমশ সহজ করে দিচ্ছে, এটাও ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। আর, হুন্ডি পদ্ধতিতে পুঁজি পাচারের গতি সঞ্চারের সরাসরি আলামত মিলছে প্রবাসী ফর্মাল চ্যানেলে বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স প্রবাহে গত তিন বছরের অবনমন কিংবাপ্রায় স্থবিরতার চিত্রে। আরো একটা আলামত হলো, ডলারের বিনিময় হারের সাম্প্রতিক অবনমন থামানো যাচ্ছে না। বিশেষত, কার্ব মার্কেটে এক ডলারের দাম মাঝে মাঝে ৮৫–৮৭ টাকায় উঠে যাচ্ছে। ২০১৮ সাল যেহেতু নির্বাচনের বছর তাই আগামী মাসগুলোতেও ক্ষমতাসীন দল ও জোটের মার্জিন আত্মসাতকারী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং দুর্নীতিবাজ আমলা–প্রকৌশলী–কর্মকর্তা–কর্মচারীরা পুঁজি পাচারে আরো সক্রিয় হবে, এতে কোনই সন্দেহ নেই।

বিশ্বের রেমিট্যান্সের–গন্তব্য দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ষষ্ঠ — ভারত, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, তুরস্ক এবং ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশের চাইতে এগিয়ে রয়েছে এ ব্যাপারে। (পাকিস্তানেরও প্রায় এক কোটি অভিবাসী বিদেশে থাকলেও ফর্মাল চ্যানেলে তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাংলাদেশের তুলনায় ক্ষুদ্রতর।) আমার গবেষণায় যে বিষয়টি রেমিট্যান্স–প্রেরণের বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে উঠে এসেছে তাহলো, বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ‘হুন্ডি’ পদ্ধতিতেই দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে চলেছেন, যার ফলে বিশ্বের দেশে দেশে যেখানেই বাংলাদেশী অভিবাসীদের ঘনত্ব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে সেখানেই হুন্ডি চক্রগুলোর হাতে অভিবাসীদের সঞ্চয়ের বিপুল একটা অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। অভিবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার এই অংশটা একটা ‘প্যারালাল বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে’ পণ্য হিসেবেও ক্রয়–বিক্রয় হয়ে চলেছে। প্রধানত মার্কিন ডলারেই এই বাজারে ক্রয়–বিক্রয় চলে বিধায় এটাকে ‘হুন্ডি ডলারের বাজার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। যোগান এবং চাহিদার শক্তিশালী কাঠামো গড়ে ওঠায় ‘হুন্ডি ডলারের’ এই বাজার দেশে–বিদেশে ক্রমপ্রসারমান। বিশেষত, গত তিন দশকে বাংলাদেশে বৈধ বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের সমান্তরালে এই ‘কার্ব মার্কেট’ প্রসারিত হয়ে দেশের বড়সড় নগরীর সীমা পেরিয়ে দেশের আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আর তেমন রাখঢাকের প্রয়োজন পড়ছেনা কার্ব মার্কেটে ডলার কেনাবেচায়, এমনকি ব্যাংকারদের মধ্যস্থতায় অতি সহজেই নগদ ডলারের ব্যবসা চলছে খোলামেলাভাবে। পত্র–পত্রিকায় ডলারের যে দাম প্রকাশিত হয়, তার চাইতে এক–দেড় টাকা বেশি দামে দেদার ডলার ক্রয় করা যায় কোন ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু, এই হুন্ডি ডলার বাজারের অপব্যবহার দেশের অর্থনীতির জন্যে মারাত্মক তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুঁজি পাচারকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে। গত অর্থবছরে ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে প্রেরিত হয়েছে বলে সরকারীভাবে তথ্য–উপাত্ত প্রকাশ করা হলেও হুন্ডি পদ্ধতিতে সারা বিশ্বের ডলার বাজারে বাংলাদেশী অভিবাসী ও অ–নিবাসী বাংলাদেশিরা কত পরিমাণ ডলার যোগান দিয়েছেন তার কোন প্রাক্কলিত তথ্য–উপাত্ত সরকারীভাবে কিংবা কোন বিশ্বাসযোগ্য গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া খুবই দুরূহ, প্রায় অসম্ভব বললে অত্যুক্তি হবেনা। এ ব্যাপারে যে অংকগুলো মাঝে মাঝে বিভিন্নজন উদ্ধৃত করে থাকেন সেগুলোর পেছনে ভাল গবেষণার অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছেনা বিধায় ওগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বোধগম্য কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য বিষয়টার গতি–প্রকৃতির কারণে। তবে, আমার গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হুন্ডি ডলার বাজারে পাচার হওয়া বাংলাদেশী অভিবাসীদের সঞ্চয়ের এই বিশাল প্রবাহটার প্রধান ফায়দাভোগীতে পরিণত হয়েছে চোরাচালানীরা এবং দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারী ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস মালিক–শিল্পপতি, দুর্নীতিবাজ আমলা ও পুঁজি–লুটেরা রাজনীতিবিদরা। যতই দেশপ্রেমের ধুয়া তোলা হোক্‌ না কেন, বাংলাদেশি অভিবাসীদের বৃহদংশের হুন্ডি পদ্ধতি ব্যবহারকে সহজে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। কারণ, হুন্ডি পদ্ধতির কতগুলো সুবিধে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হওয়াই স্বাভাবিক। যেমন, ডলারে এক/দেড় টাকা বেশি বিনিময় হার পাওয়ার পাশাপাশি অতি দ্রুত রেমিট্যান্সের টাকা প্রাপকের কাছে গোপনীয়তার সাথে পৌঁছে দেওয়া হয়। পাঠানোর কোন খরচও বহন করতে হয় না প্রেরককে। প্রতিবেশীরা বা আত্মীয়–স্বজনরা জানতেও পারে না কখন কত পরিমাণ টাকা রেমিট্যান্স পাওয়া গেছে। ফলে, চোর–ডাকাত–প্রতারকরা টের পাওয়ার আগেই প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যরা টাকাটা ব্যাংকে জমা করে দিতে পারে। এখন মোবাইল টেলিফোনে টাকা পাঠানোর খবরটা প্রাপককে জানানো যায়, তেমন কোন খরচ পড়ে না। আর, যেহেতু বিশ্বস্ততাই এই ব্যবসার আসল চাবিকাঠি, তাই টাকা মেরে দেওয়ার তেমন ঝুঁকি থাকে না। আমার গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেহেতু উপরে উল্লিখিত গোষ্ঠীগুলো হুন্ডির মাধ্যমে সংগৃহীত ডলারের চাহিদাকে চাঙা করে রাখছে তাই হুন্ডি ডলারের রমরমা ব্যবসা সহজে বন্ধ হবে না। অতএব, দেশে না আসা এহেন হুন্ডি ডলারই আমদানির ওভারইনভয়েসিংয়ের পাশাপাশি দেশ থেকে পুঁজি পাচারের বড়সড় সুযোগ সৃষ্টি করছে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

আমদানি ওভারইনভয়েসিং দেশ থেকে ব্যাংক–পুঁজি পাচারের সবচেয়ে বহুল–ব্যবহৃত পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত হলেও এর পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যাংক ঋণের একটা বিপুল অংশ যে হুন্ডি পদ্ধতিতে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে সেটা না বোঝার কোন কারণ নেই। ব্যাংক ঋণ খেলাপীদের ওপর ২০১০ সালে প্রকাশিত আমার ও মহিউদ্দিন সিদ্দিকীর গবেষণা গ্রন্থ ই যরমতধফণ মত ঈটভপ ীমটভ ঊণতটলর্ফ ধভর্ দণ রেধশর্টণ ওণর্ডমর ধভ ঈটভথফটঢণ্রদ এ উপস্থাপিত বাংলাদেশের ১২৫ টি ঋণখেলাপী প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত জরিপের সংগৃহীত তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে ঐসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকরা তাঁদের ব্যাংক ঋণের একটা বড়সড় অংশ বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। বিশেষত, ঐ বইয়ে প্রকাশিত ৩১জন ‘স্টার ঋণ খেলাপীর’ কেস স্টাডিতে পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে তাঁদের বেশিরভাগই ১৯৭২–২০০৭ পর্যায়ে ব্যাংক ঋণ বাগিয়েছেন তাঁদের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কানেকশান কিংবা দুর্নীতির বখরা ভাগাভাগির ‘সিস্টেমের’ ফায়দাভোগী হয়ে। এ প্রবণতা গত এগার বছরে আরো মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখন বাংলাদেশের ধনাঢ্য–উচ্চবিত্ত–উচ্চ মধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সামরিক–বেসামরিক আমলা ও পেশাজীবীদের ধ্যান–জ্ঞান হয়ে গেছে যে তাঁদের পরিবার–পরিজন–সন্তানদের জন্যে বাংলাদেশ আর বাসযোগ্য জায়গা বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয়, এবং তাঁদেরকে যথাসম্ভব শীঘ্রই বিদেশে পাড়ি জমাতেই হবে। বলা বাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তাঁদের বিবেচনায় স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য। কিন্তু ঐদেশে অভিবাসী হওয়াতো খুবই দুরূহ। তাই কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ইতালি এবং সম্ভব হলে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে পাড়ি জমানোর প্রাণপণ প্রয়াস এখনকার সচ্ছল পরিবারগুলোর অহর্নিশ সাধনায় পরিণত হয়েছে। এটাই এখনকার বাংলাদেশী উচ্চবিত্ত–মধ্যবিত্তের জীবনে প্রধান মিশনে রূপান্তরিত হয়েছে বলা চলে। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমার কাছে বিষয়টার আপত্তিজনক দিক হলো, দেশের ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের বৃহদংশই ব্যাংক–ঋণ পাচারকেই তাঁদের এই মিশনের মূল ‘মিকানিজম’ হিসেবে ব্যবহার করছেন, যার ফলে দেশের মহামূল্যবান বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বঞ্চিত হয়ে চলেছে। বাংলাদেশী ব্যবসায়ী–শিল্পপতি সমাজের বেশ কয়েকজন দিক্‌পাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিল্প–কারখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন দেশ থেকে পুঁজি পাচারের মাধ্যমে। (তাঁদের নাম আমার গবেষণায় উঠে এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁদের পুঁজি পাচারের হদিশ পাচ্ছে না কেন?)

ওভারইনভয়েসিং সম্পর্কে সরকার যদি তথ্য সংগ্রহে আগ্রহী হয় তাহলে গত কয়েক বছরের আমদানির রেকর্ড মোতাবেক আমদানিকৃত ক্যাপিটাল মেশিনারী দেশে সত্যিসত্যি এসেছে কিনা তার খবর মাঠ পর্যায় থেকে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা মোটেই কঠিন কাজ নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন এই কাজটি অগ্রাধিকার সহকারে করা উচিত। কাস্টমস ইনটেলিজেন্সকেও এই তথ্য পরীক্ষার দায়িত্ব প্রদান করা যায়। যেসব মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্যে ঋণপত্র খোলা হচ্ছে সেগুলোর সঠিক আন্তর্জাতিক দাম যাচাই করাও বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লবের যুগে একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, সরকারী কর্তৃপক্ষের এবং দুদকের অজানা নয় যে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এবং কাস্টমসের সাথে বখরা–ভাগাভাগির চুক্তি ছাড়া ওভারইনভয়েসিং অব ইমপোর্টস সম্ভব নয়। অতএব, সমস্যাটার কার্যকর মোকাবেলার জন্যে প্রয়োজন দুদকের সক্রিয়তা এবং সততা। দুদকের প্রতিই সেজন্যে আমাদের আকূল আবেদন, আর বিলম্ব না করে পুঁজি পাচার প্রতিরোধে এগিয়ে যান। পুঁজি পাচারকারীরা জাতির শত্রু। তাদেরকে দমন করতেই হবে। ৭ মার্চ ২০১৮

লেখক : অর্থনীতিবিদ; ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত