রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
logo

শ্রীগুরবে নমঃ

শ্রীগুরবে নমঃ

পবিত্র সরকার, ১১ মার্চ, এবিনিউজ : ‘রসিক’ কথাটার তো অনেক অর্থ আছে বাংলায়। ‘এ রসের যে রসিক’ বলতে যা বোঝায়, ‘রসেবশে’ থাকার ‘রসিক’ সে হয়তো নয়, আবার পুরুলিয়ার নাচনিদের ‘রসিক’ বলতেও বোঝায় না। পাঠকদের ভয় নেই, এই সব কথা বলতে বলতে আমি আমার দোকানদারিতে তাঁদের হাত ধরে, না, বাংলা অভিধানের মধ্যে তাঁদের হিঁচড়ে নিয়ে যাবার কোনো চেষ্টা করব না। বরং ‘রসিকতা’ কথাটায় একটু নজর দিতে বলব। আমাদের কাছে সেই হল রসিক যে রসিকতা করতে জানে। সহজে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এ কথাটা বলা দরকার এই জন্যে যে কারও কারও প্রাণপণ চেষ্টা দেখা যায় কথায় কথায় রসিকতা উগরে দেওয়ার, কিন্তু সে রসিকতায় আমরা ক্লান্ত আর বিরক্ত হই, তাকে ধমক দিয়ে চুপ করতে বলি। বা হাসির নকলে বত্রিশটা দাঁত বার করে ‘হেঁ হেঁ হেঁ’ করে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, না তার রসিকতায় আমাদের হাসি পায়নি। আর বলা বাহুল্য, আমাদের কাছে রসিকতার প্রধান একটা রূপ হল যা ভাষায় প্রকাশিত হয়, আচরণে নয়। আচরণের রসিকতাণ্ডকাতুকুতু বা দোলখেলার সময় আলু কেটে ‘গাধা’ ছাপ বসিয়ে দেওয়া বা অষ্টাবক্র নাদ ইত্যাদি, আমাদের আলোচ্য নয়। আর এই ভাষিক রসিকতা ছিল বিশুদ্ধ কৌতুক, ইংরেজিতে যাকে বলে হিউমার, যা কাউকে আঘাত করত না আক্রমণ করত না, শুধু শান্ত দিঘিতে পাথর ফেলার মত প্রবল অট্টাহাস্য সৃষ্টি করে নিজেকে সার্থক করত।

আমাদের শিক্ষক প্রমথনাথ বিশী ছিলেন (১৯০১–১৯৮৫) এই রকম এক জন্মগত আর মজ্জাগত রসিক। তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ যাঁরা পড়েছেন (না পড়লে আমি তাঁদের ‘শিক্ষিত’ বাঙালি বলতে চাইব কি না সন্দেহ), তাঁরা জানেন। শান্তিনিকেতনে বালক বয়সে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যবিদ্যালয়ে পড়েছিলেন তিনি, ক্লাসে অঙ্কের পরীক্ষার উত্তরে সমস্তই ভুল হবে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে তিনি খাতায় লিখেছিলেন একটি কবিতা, যা রবীন্দ্রনাথেরও সহানুভূতি আর প্রশংসা আকর্ষণ করেছিলণ্ড

হে হরি, হে দয়াময়,

কিছু মার্ক দিয়ো আমায়।

তোমার শরণাগত

নহি সতত,

শুধু এই পরীক্ষার সময়।

আমাদের পরিকল্পনা আমাদের স্মৃতিচারণ থেকে তাঁর কথা বলা, তাই ওই বই থেকে আর একটি উদ্ধৃতি দিয়েই তাঁর লিখিত রসভাণ্ডারের দু–একটি সূত্র মাত্র হাজির করি।

শান্তিনিকেতন আশ্রমের ‘নরসুন্দর’ (বর্জিত ‘নাপিত’ কথাটার প্রতিশব্দ) ছিল যে, তাঁর নাম গুরুদাস, কিন্তু লোকের মুখে তার নাম দাঁড়িয়েছিল আব্বাস। কেন এমন হল? প্রমথবাবুর মতে “মাঝে মাঝে অনুরুদ্ধ হইয়া সে ইংরেজি বলিত, তখন ঐ আব্বাস শব্দটা ঘনঘন বলিত। বোধ করি তাহাতেই তাহার নাম আব্বাস হইয়াছিল।”

কিন্তু এই আব্বাসের যে ধর্মীয় অভ্যাস ছিল তা এই, “ক্ষুরে কখনো সে শান দিত না। ক্ষুরের প্রথম টানেই গালে রক্ত বাহির হইত। আহত ব্যক্তি আপত্তি করিলে বলিত, “বাবু, এই যে লড়াই হচ্ছে তাতে কত লোকের হাত পা কাটা পড়ছে, কই, তারা তো আপত্তি করে নার এইটুকুতেই আপনি কাতর হচ্ছেন?”

“তা হোক বাপু, তুমি অন্য ক্ষুর বের করো।”

আব্বাস তখন দ্বিতীয় ক্ষুর বাহির করিত; সেখানা বোধ করি আরো ভোঁতা।

“আহা আব্বাস, প্রাণ যে গেল, তোমার আর কি ক্ষুর নেই?”

আব্বাস তখন তাহার শেষ অস্ত্র বাহির করিত। সেখানা ভোঁতাতম।

আহত ব্যক্তি আর কী করিবে? অর্ধেক কামাইয়া পাশে সরিতে সরিতে এক সময়ে গিয়ে দেয়ালে বাধা পাইত। আর যখন সরিবার উপায় নাই, তখন দেয়ালে ঠাসিয়া ধরিয়া আব্বাস সবলে ক্ষৌরকার্য সমাধা করিত। তার পরে আর সে ব্যক্তি বহুদিন তাহার শরণাপন্ন হইত না। আব্বাসের প্রথম ক্ষুরের নাম রক্তকিঙ্কিণী, দ্বিতীয়খানা হাড়ভেদী, তৃতীয়খানার নাম দেয়ালঠেসী।” সৌজন্যবশত প্রমথবাবু এ কথা বলেননি যে, এক সময়ে শান্তিনিকেতনে প্রবীণদের যে দাড়ি রাখার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল তাতে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এই প্রাতঃস্মরণীয় আব্বাসের (বা তার ক্ষুরগুলির) কোনো প্রেরণা ছিল কি না।

কন্যা চিরশ্রী বিশ্রীক্রবর্তী তাঁর স্মৃতিচারণে (‘কিছু স্মৃতি, কিছু বিস্মৃতি’) জানিয়েছেন, রাজশাহীর জোয়াড়ির জমিদারতনয় প্রমথনাথ শান্তিনিকেতনে আবির্ভাবের পরেই তাঁর শিক্ষকদের এমন ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন যে, জোয়াড়ি থেকে শান্তিনিকেতনে পাঠানো এক ঝুড়ি আম দীর্ঘ দিনেও না পাকাতে বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, “ওদের দেশে আম পাকে না, ছেলে পাকে।”

প্রমথনাথ প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার এম এতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন, তখনকার হিসেবে রেকর্ড মার্ক পেয়ে। ফলে চাকরির ইন্টারভিউ পেতে দেরি হয়নি। চিরশ্রী জানিয়েছেন রিপন কলেজে তাঁর ইন্টারভিউতে তাঁর সাফল্যের চমকপ্রদ বৃত্তান্ত। ঘটনা এই যে, প্রমথনাথ নিজে কোনো খেলাতেই পটু ছিলেন নাণ্ড ফুটবল মাঠে নিজের ক্লাসের বা শান্তিনিকেতনের দলের হয়ে গলা ফাটালেও নিজে খেলাধুলা নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন না। সেই প্রমথনাথকে ক্রীড়াকুশল ভেবে রিপন কলেজের (এখনকার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ইন্টারভিউতে এক ক্রীড়াবিলাসী কর্তা হঠাৎ এক টেনিস খেলোয়াড়ের নাম বলতে বললেন। প্রমথনাথ দমে যাবার পাত্র নন। তিনি ‘টেনিস’ কথাটার ওপর দাঁড়িয়ে চোখ বুজে বলে দিলেন বিখ্যাত উত্তর–রোমান্টিক ইংরেজ কবির নামণ্ডলর্ড টেনিসন! প্রশ্নকর্তা উচ্ছ্বসিত, আর তাতে প্রমথনাথও নিজে স্তম্ভিত ও হতবাক! আসলে টেনিসনের নাতি সত্যি ছিলেন তখনকার এক বিখ্যাত টেনিস খেলোয়াড়, প্রমথনাথের অন্ধকারে ছোড়া ঢিল দারুণ লক্ষ্যভাদ করেছে। কলেজে চাকরি হতে আর দেরি হল না।

এবার শিক্ষক হিসেবে আমরা যে তাঁকে পেয়েছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা কিছু নমুনা তুলে ধরি। ক্লাসে ঢুকেই তিনি গম্ভীর গলায় বলতেন, “দরজাগুলো বন্ধ করে দাও, ভালো ভালো কথা সব বাইরে বেরিয়ে যাবে।” কিন্তু তিনি যে খুব নিয়মিত ক্লাস নিতেন বা নিতে পারতেন তা নয়। তখন তিনি দিল্লিতে রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন, ফলে সংসদের অধিবেশনের সময় তাঁকে দিল্লিতে থাকতে হত। কালেভদ্রে ক্লাসে আসতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেও শিক্ষকদের ঘরে বসে গল্প করতেন, সব সময় ক্লাসে যাওয়ার কথা তাঁর মনে থাকত না।

আমরা তখন কলেজ থেকে বি এ পাসের পর সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। রুটিনে বাঘা বাঘা সব নামণ্ড শশিভূষণ দাশগুপ্ত, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোদচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রমথনাথ বিশী, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি। সকলেই মোটামুটি নিয়মিত ক্লাস নেন, কারও কারও পড়ানো আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনিণ্ড তাঁদের ক্লাস ‘কেটে’ কলকাতার বিখ্যাত কফি হাউসে যাবার, বা রাখালদার ক্যান্টিন বা ইউনিয়ন ঘরে আড্ডা দেবার ইচ্ছে হয় না। প্রমথবাবুর পড়ানোর দারুণ সুনাম শুনেছি দাদা–দিদিদের মুখে, কিন্তু তাঁর দেখা পাওয়া ভার। আমরা তক্কে তক্কে থাকি কবে বা কখন তাঁকে পাব ক্লাসে।

একদিন শুনলাম তিনি এসেছেন, কিন্তু ক্লাসের কথা তাঁর খেয়াল নেই, তিনি হেড শশীবাবুর ঘরে বসে গল্প করছেন। আমরা কিছুটা ত্যাঁদড়ামির ইচ্ছে নিয়ে তাঁকে গিয়ে ধরলাম, “স্যার, আমরা আপনার ক্লাস এখনও পাইনি, আসুন আমাদের ক্লাসে?” বলে খুব তৎপর হয়ে ক্লাসের রেজিস্টারটা তাঁর সামনে রাখলাম। শশীবাবুর সামনে তিনি তো আর অস্বীকার করতে পারেন না ক্লাসের দায়িত্ব, তবু একটু বিস্ময়ের ভান করে বললেন, “তোমাদের ক্লাস? আছে নাকি? আচ্ছা চলো যাচ্ছি।” আমরা হই হই করে ক্লাসে ফিরে গেলাম, প্রমথবাবুও এলেন। কিংবদন্তি শিক্ষক প্রমথবাবুর প্রথম ক্লাস করব আমরা। সেটা ছিল আমাদের স্পেশাল পেপার ছোটোগল্প আর উপন্যাসের ক্লাস।

প্রমথবাবু দুষ্টু দুষ্টু অথচ গম্ভীর মুখে ক্লাসে এলেন এবং ওই “দরজাগুলো বন্ধ করে দাও” ইত্যাদি বলে খুব মনোযোগ দিয়ে রোলকল করলেন। রোল করার সময় তিনি চশমার ফাঁক দিয়ে তীক্ষ্ম চোখে আমাদের মুখের দিকে তাকাতেন, মনে হয় মুগগুলো চিনে রাখার চেষ্টা করতেন। সেদিনও তাই করার পর প্রথম প্রশ্ন যা জিজ্ঞেস করলেন, তাতে আমরা সবাই ভড়কে গেলাম। বললেন, “ক্লাসের জন্যে তো আমাকে ধরে আনলে, কিন্তু তোমরা কি নিজেরা প্রস্তুত আছ ক্লাসের জন্যে? তোমরা ওয়ালটার স্কট, জেন অস্টেন, রিচার্ডসন, ডিকেন্স, টলস্টয়, ডস্টয়েভ্‌স্কি, বালজাক, উগোণ্ড এঁদের উপন্যাস কিছু পড়েছ?’

আমরা তো স্তম্ভিত! প্রথমদিন ক্লাসে এ কী অভদ্র প্রশ্ন রে বাবা! আমরা পাথরের মতো নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম। প্রমথবাবু গলায় একটু বিরক্তি এনে বললেন, “কিছুই তো পড়েনি তোমরা, তবে আর তোমাদের কী ক্লাস নেব?” বলে রেজিস্টার হাতে বেরিয়ে গেলেন।

আমরা নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। সত্যি, আমাদের মতো গোমুখ্যদের কেউ যদি পড়াতে না চান তাঁকে কেন দোষ দেব আমরা!

তার মাসখানেক পরে আবার প্রমথবাবুকে বিভাগে ধরেছি, আমাদের ক্লাস আছে স্যারণ্ড নিতে হবে। তদ্দিনে আমরা একটু চালাক হয়ে গেছি, তাঁর বলা কিছু কিছু বই পড়ে নিয়েছি। তিনি যেন আবার অতিশয় অপ্রসন্নমুখে ক্লাসে এলেন, আবার রোলকল করলেন, এবং আবার ওই একই প্রশ্ন করলেন।

এবার একটু আত্মবিশ্বাসী আমরা একে একে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমিএই পড়েছি, আমি সেই পড়েছি, আমি ওটা পড়েছি ইত্যাদি। প্রমথবাবু স্তব্ধ হয়ে শুনলেন, তারপর তীব্র গাম্ভীর্যে বলে উঠলেন, “তোমরা তো সবই পড়েছ দেখছি, তবে আর কী ক্লাস নেব তোমাদের?” বলে রেজিস্টার নিয়ে আবার বেরিয়ে গেলেন।

কিন্তু যেদিন তাঁর পড়ানোর ইচ্ছে এবং সময় হত, সেদিন আমাদের যেন আকাশে উড়িয়ে নিতেন তিনিণ্ড নানা দিগদিগন্ত ঘুরিয়ে নিয়ে আসতেন, সেটা রবীন্দ্রনাথের পাঠই হোক আর উপন্যাস–তত্ত্বের পাঠই হোক।

তাঁর মধ্যে একটা ধবযধ্রদ (ইম্প্‌ হল এক ধরনের বিলিতি ভূত, যে মজা করবার জন্যে নানা ছোটোখাটো কুকর্ম করে বেড়ায়) দুষ্টুমি ছিল, এমন কথা অনেকেই বলেছেন। তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। সেদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা হলে প্রয়াত বুদ্ধদেব বসুর একটু গুরুত্বপূর্ণ বস্তৃতা ছিল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্বন্ধে, পরে সেই বক্তৃতাগুলি ‘কাব্যে রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে গ্রন্থিত হয়েছে। সেদিনের, সম্ভবত প্রথম দিনের, সভায় প্রমথবাবুরই সভাপতিত্ব করার কথা।

কিন্তু প্রমথবাবু আর আসছেন না। হলে বুদ্ধদেববাবু এবং শ্রোতারা সভাপতির প্রতীক্ষা করছেন, ফলে আমরা ছুটে এলাম বাংলা বিভাগে, যেখানে প্রমথবাবু এসে পৌঁছেছেন বলে আমরা খবর পেয়েছি। প্রমথবাবুকে বললাম যে, ‘স্যার, দেরি হয়ে যাচ্ছে চলুন, সবাই আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে।” প্রমথবাবু বললেন, “ও হ্যাঁ, তাই তো! তা আজ বুদ্ধদেববাবুর বিষয় কী?” আমরা বললাম, আজকে কবিতা সম্বন্ধে প্রথম ভাষণ, নাম ‘কবিতার সাত সিঁড়ি’। প্রমথবাবু যেন চমকে উঠলেন। বললেন, “কী সর্বনাশ আমি তো অত সিঁড়ি ভাঙতে পারব না, আমার কোমরে বড্ড ব্যথা!” তিনি গেলেন না।

আমাদের ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ বলে একটি গল্প বলেছিলেন প্রমথবাবু, যা ভুলে যাওয়া অসম্ভব। শ–দুয়েক বছর আগে বাংলার গ্রাম থেকে তিন বয়সের তিন সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ কাশী যাচ্ছেন। পদব্রজে, কারণ তখন ট্রেন–টেন এ দেশে আসেনি। দীর্ঘ পথ। দিনের বেলা হাঁটেন, আর রাত্রে কোনো গৃহস্থের বাড়িতে অতিথি হন, গৃহস্থেরা ব্রাহ্মণদের আপ্যায়নের সুযোগ পেয়ে কৃতার্থ হন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ, গুরুস্থানীয়; একজন মধ্যবয়সী, আর একজন তরুণ। তরুণটি দুই প্রবীণের সেবাযত্ন করে, পথে তাদের রান্নাবান্না করে খাওয়ায়। সঙ্গে আতপ চাল, ঘি, লবণ ইত্যাদি হহন করছেন, পথেও সংগ্রহ করে নেন। ব্রাহ্মণের তখনকার দিনের মতো প্রচণ্ড সাত্ত্বিক, খাওয়াদাওয়ায় কঠোর নিয়ম মেনে চলেন।

একদিন দুপুর এক বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তিন জন। বেলা চড়ে গেছে, তিনজনেই ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। এক জায়গায় একটি স্বচ্ছ জলের পুকুর দেখে তরুণটি তাঁদের থামাল, বলল, “আমি এই গাছের নীচ চাল চড়িয়ে দিচ্ছি, আপনারা দুজনে স্নান করে আসুন, আহার প্রস্তুত হয়ে যাবে।” বলে গাছের নীচে উনুন খুঁড়ে সে প্রথমে চান করে এসে হাঁড়িতে চাল চাপিয়ে দিল। এক সময় ভাত ফুটলে সে হাঁড়ির মুখের সরাটা একটু সরিয়েও দিল, তার পর কলাপাতার খোঁজে গেল।

বাকি দুজন স্নান করে ফিরে আসতে সেও এসে গেল। কলাপাতা কেটে ধুয়ে সে তিনজনের জন্যে ভাত বাড়তে গিয়ে দেখে ভাতে কী একটা ফল পড়েছে, বোধ হয় ওই গাছের ফল। তখন যে মধ্যবয়সী, সেই ব্রাহ্মণ বলে উঠলেন, “সর্বনাশ, কী না কী ফল, এ ভাত খাওয়া যাবে না, এ অশুদ্ধ হয়ে গেছে।” তরুণটি বলল, “কেন অশুদ্ধ হবে কেন? এই দেখুন পাখিরা এই ফল খেয়ে মাটিতে ফেলেছে, এতে কোনো বিষ–টিশ নেই।” মধ্যবয়সী বললেন, “বিষ–টিশ না থাক, এ খাবারে অচেনা জিনিস পড়েছে, এ খাওয়া চলবে না।”

তখন শেষ দুজনের মধ্যে খুব বানানুবাদ শুরু হয়ে গেল। এদিকে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণটি যৎপরোনাস্তি কাতর হয়ে পড়েছিলেন ক্ষুধায়, এই শুদ্ধ–অশুদ্ধ নিয়ে কূটতর্ক তাঁকে আরও ক্ষুধার্ত করে তুলছিল। তিনি অধৈর্য হয়ে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “থামো, আমি বলছি এ অন্ন খাওয়া যাবে, তাতে কোনো নিয়মভঙ্গ হবে না।”

মধ্যবয়সী রক্তচক্ষু তুলে জিজ্ঞেস করলেন, “খাবেন যে, কোন্‌ শাস্ত্রের নিয়মে?”

বৃদ্ধ বললেন, “কেন? ব্যাকরণও তো শাস্ত্র, সেই শাস্ত্রের! ফলটা পড়েছে আর সিদ্ধ হয়েছে! এই তো ব্যাপার! তা হলে ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ নিয়মে। তার ওপরে আর কথা কী হে?” বলে তিনি ভাতের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

তাঁর কথা ফুরোবার নয়। আমরা তাঁর বিপরীতপন্থার রাজনীতি করতাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়, তাঁর কথায় আমাদের ঘাড় একটু বাঁদিকে ‘তেরছা’ ছিল, কিন্তু তার জন্যে তাঁর অন্তহীন স্নেহ থেকে কখনও বঞ্চিত হইনি। এম এ–তে এই অধম ছাত্রকে তাঁর ওই স্পেশাল পেপারের হাফ পেপারে মোট ৫০–এ ৪৫ নম্বর দিয়েছিলেন। তখনকার হিসেবে এ ছিল অভাবনীয়, অযৌক্তিক। তাঁকে পরের বছরের ক্লাসে কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার, এত নম্বর পায় কী করে? তিনি বিরক্তির ভান করে বলেছিলেন, “আরে পাঁচটা নম্বর তো আমি হাতে রেখে দিয়েছি!”

যে অসুস্থতায় তিনি চলে গেলেন, তার শুরুর দিকে তাঁকে দেখতে গেছি লেক গার্ডেনসের বাড়িতে। একটু আগেই কলকাতার তখনকার শ্রেষ্ঠ হার্টের ডাক্তার এসে তাঁকে দেখে গেছেন, বুক–পিঠে চাপ দিয়ে পররীক্ষা করেছেন। আমাদের কথা প্রসঙ্গে বললেন, “এই তো ডা. সেন এসেছিলেন, বুকের ওপর হারমোনিয়াম বাজিয়ে চারশো টাকা নিয়ে চলে গেলেন।”

প্রমথনাথের কথা অমৃতসমান। (সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত