
ঢাকা, ১২ মার্চ, এবিনিউজ : কমিউনিস্ট পার্টির তত্কালীন সক্রিয় নেতা অজয় রায়। জন্ম ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে। রাজনীতিবিদ ও লেখক। স্কুলজীবনেই কমিউনিস্ট নেতাদের সান্নিধ্য পান এবং তখন থেকেই সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন। ১৯৪৬ সালে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে ডিগ্রি ক্লাসে ভর্তি হন। প্রথম কারাবাস ১৯৪৮ সালে। ষাটের দশকে কারা-অভ্যন্তরে থাকা অবস্থায় এমএ পাস করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে বিশেষ অবদান। রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে কাটিয়েছেন প্রায় ১৫ বছর। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বাঙলা ও বাঙালী, আমাদের জাতীয়তার বিকাশের ধারা, বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন ১৯৪৭-৭১, গণ-আন্দোলনের নয় বছর, তীরের অন্বেষায় প্রভৃতি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। এখনো তিনি রাজনীতি ও লেখালেখিতে সক্রিয়।
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন—এই কালপর্বে কমিউনিস্ট পার্টির পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়ে পার্টির তত্কালীন সক্রিয় নেতা অজয় রায়-এর সঙ্গে সম্প্রতি একটি দৈনিকের সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলেন। তার হুবহু তুলে ধরা হলো-
সম্পাদক: শুরুতেই জানতে চাইছি, মার্ক্সবাদে কি আপনার এখনো বিশ্বাস আছে?
অজয় রায়: যদি কোনো মতবাদে বিশ্বাস থেকে থাকে—বিশেষ করে ইতিহাসের বিবর্তন সম্পর্কে কার্ল মার্ক্সের যে বক্তব্য, সমাজবিকাশের বিষয়ে যে বক্তব্য, সেই জায়গায় মার্ক্সবাদের ওপর আমার ধারণা-বিশ্বাস অবশ্যই আছে। সেটা আক্ষরিক অর্থে নয়, তাঁর মূল যে বিষয়, সেখানে বিশ্বাস অবশ্যই আছে।
সম্পাদক: মূল বিষয়টি কী? যেভাবে বলা হয়, আদিম সাম্যবাদ, দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের পরে সমাজতন্ত্র, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই যে ব্যাখ্যা এটার কথা কি আপনি বলছেন?
অজয় রায়: শুরু থেকেই একটা প্রশ্ন আমার ভেতরে ছিল। যেমন দাস-সমাজব্যবস্থা নিয়ে যেটা ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের বইতে পড়েছি, তার কোনো ধরন চীন বা ভারতে কখনো দেখিনি। তবে, মিসরসহ প্রাচীন সভ্যতার বেশির ভাগ দেশেই ছিল। শুনেছি, মিসরে পিরামিড তৈরিতে যে বিপুলসংখ্যক মানুষের শ্রম ব্যবহূত হয়েছে, এটার সবই দাসদের। স্বাভাবিকও সেটা। তবে ভারত ও চীন সম্পর্কে এটা খাটে না।
সম্পাদক: তাহলে তাজমহলে ২২ হাজার শ্রমিক ২০ বছর কাজ করেছিল, তারা কি দাস হিসেবে, না শ্রমিক হিসেবে? নাকি বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে?
অজয় রায়: তারা বনডেড লেবার (বাঁধা শ্রমিক) ছিল। বনডেড লেবার তো এখনো আছে। আগেও ভারতবর্ষে বনডেড লেবার ছিল।
সম্পাদক: হ্যাঁ, বিশ্বের বহু জায়গায় সেটা এখনো আছে।
অজয় রায়: একটা বিষয় বলা দরকার, ভারতের কমিউনিস্ট নেতা ডাঙ্গে [শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে (১৮৯৯-১৯৯১)] ছিলেন লেখাপড়া জানা লোক, সংস্কৃত জানা পণ্ডিত এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আদিযুগের পরের নেতা। তিনি যখন জেলে ছিলেন, লিখলেন ফ্রম প্রিমিটিভ কমিউনিজম টু স্ল্যাভারি। আমরা তখন ভাবলাম, এই হলো আসল কমিউনিস্ট। কিন্তু ইতিহাসবিদ ডি ডি কোসাম্বি লিখলেন যে ডাঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা হলেই ইতিহাস জানবেন, এমন কোনো কথা নেই। খুব কঠিনভাবে কথাটা বলেছিলেন তিনি।
সম্পাদক: মার্ক্সবাদের পর্ব বা এর ধারাবাহিক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যদি আপনি আসতে থাকেন, বিশেষ করে অর্থনীতি ও দর্শনের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রভাব...
অজয় রায়: আমার কাছে যেটা মনে হয় দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া সব সমাজেই যে একই রকম হবে, তার কোনো মানে নেই। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, উত্পাদিকা শক্তি এবং উত্পাদন সম্পর্কের পরস্পরের যে সংঘাত, এর মধ্য দিয়ে সমাজের যে পরিবর্তন, সেটা আমি গ্রহণ করি।
মার্ক্সবাদ শেখা নিয়ে আমাদের একটা সমস্যা আছে। কারণ আমরা মার্ক্সবাদ শিখেছি কার কাছ থেকে? আপনারা শিখেছেন পাকিস্তান আমলে। আর আমরা শিখেছি আরেকটু আগে থেকে। আমাদের উত্স ছিল প্রধানত বিলেত। বিলেত কোত্থেকে শিখেছে? উনিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকের সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএসইউ) নিয়ন্ত্রণাধীন তৃতীয় আন্তর্জাতিক অর্থাত্ মস্কো থেকে। তার পরবর্তী সময়ে আমরা আরও শিখলাম চীন থেকে। তা ছাড়াও কিন্তু মার্ক্সবাদের আরও কিছু কেন্দ্র ছিল। এর মধ্যে ছিল জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্স। পরে যেহেতু মস্কো তাদের মতভিন্নতা গ্রহণ করতে পারল না; তাই আমরাও বাতিল করলাম।
এবিএন/মাইকেল/জসিম/এমসি