![৭ই মার্চকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করুন](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/12/fazlul-haq_128654_129960.jpg)
ফজলুল হক, ১২ মার্চ, এবিনিউজ : ৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ আমাকে ফোন করেন। বলেন, ৭ মার্চ বিকেল ৪ টায় আন্দরকিল্লার চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণ প্রদান স্মরণে মহাকালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আবদারের সাথে মোছলেম বলে, আপনাকে আসতে হবে। আমি দেরী না করে বলি, আমি আসব। এবং ৭ মার্চ বেলা চারটার আধা ঘন্টা আগে আমি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে পৌঁছে যাই। আমাকে কেউ “চিফ গেস্ট” বা প্রধান আলোচক এসব বলে আমন্ত্রণ করলে আমি যেতে চাইনা। আমি কখনো “উদধণত থলর্ণ্র” হতে পারবোনা, ”উদণটয থলর্ণ্র” হতে পারব– বড় জোর। ৬ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দপ্তরের কর্মকর্তা আমজাদ ফোনে জানায়, ৭ মার্চ সকাল ১০ টায় চ.বি. বঙ্গবন্ধু চত্বরে (বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্মরণে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে) বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্প স্তবক অর্পণ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমজাদ বল্ল, মাননীয় প্রো–ভিসি ম্যাডাম আপনাকে আসতে বলেছেন। মাননীয় প্রো–ভিসি ড. শিরীন আখতার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রফেসর। উনি খুব ভাল বক্তব্য দিতে পারেন। অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহারের মানুষ। প্রো–ভিসি ম্যাডাম একজন কথা শিল্পী– লেখিকা। উনার পিতা কক্সবাজারের একজন অতি সম্মানিত ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের দুর্দিনে একজন নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী কর্মী। ত্যাগী নেতা। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ মানুষ। এম এ আজীজের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে উনার সাথে আমারও ভাল সম্পর্ক ছিল। ম্যাডাম এখন উপাচার্যের দায়িত্বে (তখন) আছেন। আমাদের উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরব গেছেন। আমি আমজাদকে বল্লাম, আমি বঙ্গবন্ধু চত্বরে আসব। ৯.৩০ টায় আমি বঙ্গবন্ধু চত্বরে উপস্থিত হই– অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আধঘণ্টা আগে। আমি গিয়ে দেখি তথ্য বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ফরহাদ সেখানে আয়োজনের খুটিনাটি দেখাশোনা করছেন। যারা একাত্তর দেখেছেন, তারা জানেন ৭ মার্চ কি।
৭১ এর সাত মার্চ ভোরের দিকে আমরা ঢাকার ডেমরা অঞ্চলে পৌঁছাই। ৬ মার্চ আমরা চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা করি। আমাদের পার্লামেন্ট সদস্য আমাদের নিয়ে যান। ৭০ এর নির্বাচনে উনার বড় ভাই পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেমব্লিতে নির্বাচনে জিতে “এমএনএ” (মেম্বার অফ ন্যাশনাল এসেমব্লি) হন। ৭১ সালের ১১ জানুয়ারি উনি মারা গেলে উপ নির্বাচনে উনার ছোট ভাই আমাদের এমএনএ (এমপি) হন। উনার উইলিস জিপে আমরা প্রিয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যাচ্ছি। শেখ হাসিনা আজ যে ঢাকা চিটাগং সিক্সলেন হাইওয়ে আমাদের উপহার দিয়েছেন, আমরা বিলাস বহুল বাসে বসে সুখ নিদ্রায় থেকে ঢাকা পৌঁছে যাই– তখন সে সুযোগ ছিলনা। বাই রোডে ঢাকা যাওয়া দোজখে ঝাঁপ দেওয়ার সমতুল্য ছিল। বাই রোডে ঢাকা যাওয়া দুঃখের দুঃস্বপ্ন ছিল। হাড্ডি মাংস একাকার হয়ে যেতো। জামায় ধুলির আস্তরন পড়ত। ৫ টির বেশী ফেরী পার হতে হতো। ৭১ এর ৬ মার্চ দাউদকান্দি ফেরী পার হতে আমাদের সাড়ে তিন ঘন্টার বেশী সময় লেগে ছিল। উইলিস জিপ কোন মার্সিডিজ বেনজ জীপ ছিলনা। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা–রুপী শাসকরা গতরওয়ালা সুন্দরীদের নিয়ে পড়ে থাকত। তাদের কাছে দেশের কোন দাম ছিলনা। খবরও ছিলনা। ইসলামের নাম ব্যবহার করে পাকিস্তানের “খবিস” জেনারেলরা কুকর্মে লিপ্ত ছিল। এখনো যারা পাকিস্তানের দালালী করে– তাদেরকে শুধু বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নয়, বাংলাদেশ থেকেই বের করে দেয়া উচিৎ। তাদেরকে “রাখার” জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। হায় তরুণরা, তোমরা জাননা, যদি তোমরা পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে আমরা কি দুর্বিষহ কষ্টে ছিলাম, তা যদি তোমরা দেখতে-, তার ছিটেফোঁটাও যদি তোমাদের উপর আসত-? তোমরা জান, বঙ্গবন্ধু– উনার জীবনের বেশীরভাগ সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। আমরা তেমনি পুরোটা সময় কষ্টের কারাগারে বন্দী ছিলাম। আমরা নাগরিক ছিলামনা– ছিলাম দাস। “স্বাধীনতা” শব্দটি আমাদের ছিলনা। রেসকোর্সে চরম উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গবন্ধু বল্লেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেদিনই “স্বাধীনতা” শব্দটি আমাদের হল। এখন আমরা আমাদের উর্বর মনো ভূমিতে, আমাদের মুক্তির কবিতা লিখতে পারি। আমাদের মানস ভূমিতে, আমাদের কল্পলোকে “স্বাধীনতার” চাষাবাদ করি। মুক্তির বীজ রোপণ করি। আমার “স্বাধীনতা” এখন মহীরুহ। ৭ মার্চকে যদি চিনতে না পারি, আমাদের গন্তব্য থেকে, আমাদের “বাতিঘর” থেকে দুরে চলে যাব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করতে ব্যর্থ হলে, কোন সাফল্য আমরা ধরে রাখতে পারবোনা।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এই সদ্য স্বাধীন দেশ শাসন করেছেন। দেশটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত ছিল। অর্থনীতি খালি পাত্রের চাইতেও শূন্য ছিল। বুদ্ধিজীবীদের মেরে ফেলা হয়েছিল। অবকাঠামো বিধ্বস্ত ছিল। প্রশাসনিক ব্যবস্থা এলোমেলো ছিল। সমস্যার পাহাড় দ্বারা বঙ্গবন্ধু পরিবেষ্টিত ছিলেন। শত্রুর উৎপাত ছিল। ষড়যন্ত্র ছিল। ব্যাংক সমূহ শুন্য ছিল। কি করে আওয়ামী লীগ দেশকে আজ এই সফল অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে? বঙ্গবন্ধু শূধু স্বাধীনতা দেননি, সমৃদ্ধিও দিয়েছেন। আফসোস আমাদের মধ্যে অনেকে রাস্তায় রাস্তায়, দেয়ালে, পিলারে বঙ্গবন্ধুর ছবির পোস্টার লাগায়, ব্যানার লাগায়। নিজের ছবিটা আরো বড় করে পোষ্টারে– ব্যানারে প্রচার করে। দেয়ালের ছবি মুছে ফেলুন। ষোল কোটি মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি বসিয়ে দিন। এটা কঠিন কাজ। এর জন্য ত্যাগের রাজনীতি লাগবে। বঙ্গবন্ধু মানুষের হৃদয়ের অধিবাসী হোক। আজ রবীন্দ্রনাথের ছবি ব্যানারে পোস্টারে লাগাতে হয়না। কার্লমার্কসের ছবি সাঁটানো লাগেনা। নেলসন ম্যান্ডেলার ছবি প্রচার লাগেনা। মার্টিন লুথার কিং– এর ছবি প্রচার লাগেনা। জীবনানন্দ দাশের ছবি নিয়ে ব্রান্ডিং লাগেনা। নির্মলেন্দু গুণের ছবি প্রচার লাগেনা। যাঁ পল সাত্রের ছবি প্রদর্শন লাগেনা। মাও এর ছবি দেখানো লাগেনা। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি কোটি কোটি তরুণ তরুণীর হৃদয়ে ঢুকিয়ে দিন। আমাদের মানসপটে আমরা বঙ্গবন্ধুকে চিরস্থায়ী করে রাখব। দেয়ালে বা পিলারে নয়। মনের মনিকোটায়।
রুশ বিপ্লবের পরের ঘটনা। তখন লেনিন “ওয়ার কম্যুনিজম” বা যুদ্ধকালীন সমাজতন্ত্র নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। রুশ স্কুলের এক শিক্ষক ছাত্রদের বল্ল, এই নাও মহামতি লেনিনের ছবি। প্রত্যেকের ঘরে মহান বিপ্লবীর ছবি টানাবে। পরদিন ছাত্রদের বল্লেন, মহামতি লেনিনের ছবি ঘরের দেয়ালে সেঁটে রেখেছ? চারজন বল্ল, ইয়েস। একজন নিশ্চুপ। শিক্ষক বল্লেন, কি হল? ছাত্রটি বল্ল, স্যার, আমাদের পাঁচ ফ্যামিলকে একটি বড় হলঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চার দেয়াল চার পরিবারের আর আমাদের পরিবার থাকে মাঝখানে। তো, মাঝখানে ছবি কি ভাবে লাগাব? মাঝখানে দেয়াল নাই। রাশিয়া এত খারাপ অবস্থায় ছিল। আজ সে রাশিয়া বিশ্বের সেরা শক্তিধর দেশ। লেনিনের মূর্তি যতই ফেলে দেননা কেন, প্রগতিশীল মানুষের মন থেকে তাকে মুছে ফেলা যাবেনা। বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করুন।
ড. অরুন কুমার দেব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। তিনি চ. বি. বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তিনি বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বল্লেন, আমার বাড়ি রাংগুনিয়া। প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় ২/৩ মাইল হেঁটে স্কুলে যেতাম। আমাদের শিক্ষক ও হেঁটে যেতেন। পথে পড়ত খাল। স্যার বলতেন, অরুন ওই দিকে তাকা, আর আমি (শিক্ষক) এদিকে তাকাচ্ছি। লুঙ্গি তুলে দুজনে খাল পার হতাম। এখন কি অবস্থা? এখন আমি মাসে এক লক্ষ বার হাজার টাকা বেতন পাই। সরকার বেতন বাড়িয়েছে। খাল নদী সর্বত্র সেতু। নদীর নীচে হবে ট্যানেল। পদ্মার উপর সেতু। যমুনার উপর সেতু। কর্ণফুলির উপর সেতু। এটা লুঙ্গি তুলে খাল পার হওয়ার বাংলাদেশ নয়। সাত মার্চ ভাষণের আগে আমরা মাথা তুলতে পারতামনা। এখন আমরা মাথা নত করিনা। এখন “স্বাধীনতা” আমাদের। কেবলই আমাদের। “বঙ্গবন্ধু” মানে মাথা নত না করা। এটা উনার শিক্ষা। দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক প্রিয় মফিজের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ছোট থেকে সে আমার প্রিয়।
মোছলেমের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের নারী নেত্রীরা কিছুক্ষন সময় নিলেন আমার সাথে সেলফি তোলার জন্য। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ কমার্স কলেজের ছাত্র ছিল। অবশ্যই মেধাবী ছাত্র। মোছলেম বয়সে আমার চাইতে কয়েক বছরের ছোট। লেখালেখি ভাল করে। সে সাহসী ঠিকানা নামে একটি পত্রিকা চালাত। মহিউদ্দিন ভাই যখন তরুণ নেতা তখন মোছলেম উনার সাথে ছিলেন। পত্রিকায় নিউজ দেয়া, ম্যাাগাজিন, লিফলেট বের করা সব মোছলেম করত। মোছলেমকে আত্মত্যাগ করতে দেখেছি। রাজনীতিতে তার যথাযথ মূল্যায়ন হলে আমি খুশী হব। আমার দৃষ্টিতে সাত মার্চের ভাষণ এক অসাধারন পরিবর্তন এনে দিয়েছিল রাজনৈতিক আন্দোলনে। তখন টিভির রেঞ্জ ছিল ঢাকার ভেতরে। ফেসবুক, টুইটার ইনষ্টাগ্রাম, ইউটিউব ছিলনা। ইন্টারনেট আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। ঢাকার পেপার একদিন পরে আসত। রেডিওতে ভাষণ প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছিল। তাহলে কেমন করে, কোন যাদুমন্ত্র বলে, বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষণের পর পরই যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল? ৭ মার্চের ঘোষণাই স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার নায়ক। এই দিনটিকে মর্যাদার সাথে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করুন।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ। অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
(সংগৃহীত)