বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক হাওয়া বদল

দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক হাওয়া বদল

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ১৩ মার্চ, এবিনিউজ : দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ একটা হাওয়া পরিবর্তনের লক্ষণ এই দূর বিদেশে বসেও টের পাচ্ছি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একটানা দুই দফা ক্ষমতায় আছে, দেশের নানা উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তবু আগামী সাধারণ নির্বাচনে দলের অবস্থা কী হবে, তা জিজ্ঞাসা করলে কোনো কোনো বড় ও মাঝারি নেতা গলা খাটো করে বলতেন, ‘বলা মুশকিল। তবে আমরা জয়ী হব আশা করি।’ এই আশা ব্যক্ত করার ব্যাপারে তাঁদের মুখের ইতস্তত ভাবটা লক্ষ করতাম।

কিন্তু বিএনপির একজন পাতি নেতার চেহারায়ও দেখতাম, দৃঢ় আশার অভিব্যক্তি। জিজ্ঞাসা করলেই বলতেন, ‘বিএনপি তো জয়ী হয়ে বসে আছে। শুধু নির্বাচনটা হওয়ার অপেক্ষা। নির্বাচন ফ্রি ও ফেয়ার হলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকায় কে?’ খালেদা জিয়া জেল গমনের আগে দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় বলেই দিয়েছিলেন, ‘দেশের প্রশাসন, সামরিক, বেসামরিক বাহিনী—সবই বিএনপির পক্ষে। দলটির মহাসচিব বকেয়া বামপন্থী ছাত্রনেতা মির্জা ফখরুল তো রাত-দিন বলে বেড়াচ্ছেন, আওয়ামী লীগ ডাণ্ডাবাজি করে ক্ষমতায় আছে। নইলে ক্ষমতায় থাকার কথা তো তাঁর দলের।’

এই দুটি প্রধান দলের মাঝখানে জাতীয় পার্টির নেতা জেনারেল এরশাদের হাঁকডাক শুনে মনে হচ্ছিল, তিনি এবার এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত। তিনি ঘোষণা করেছেন, সংসদের ৩০০ আসনেই তাঁর দল এবার প্রার্থী দেবে। আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি আর করবেন না। বরং নির্বাচনে এককভাবে জয়ী হয়ে দলকে ক্ষমতায় দেখে যেতে চান। তবে এত সব কথা বলা সত্ত্বেও তাঁর দলের মন্ত্রীরা এখনো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেননি।

এত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট ছিল এটাই। আওয়ামী লীগ শিবিরে আশা-নিরাশার দোলাচল এবং বিএনপি শিবিরে সরকার তাদের ছক মেনে নির্বাচন করলে বিরাট জয় সম্পর্কে নিশ্চিত আশাবাদ। এই রাজনৈতিক দৃশ্যপট হঠাৎ করেই পরিবর্তিত হয়েছে মনে হয়। আওয়ামী লীগ শিবিরে নির্বাচনে জয়লাভ সম্পর্কে ইতস্তত ভাবটা কেটে গিয়ে জয় সম্পর্কে দৃঢ় আশাবাদ দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি শিবিরে নিশ্চিত জয়ের উল্লাসটা থিতিয়ে গিয়ে একটা অনিশ্চয়তার ভাব দেখা দিয়েছে। আগে তারা বলত, সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের ছক মেনে না নিলে তারা নির্বাচনে যাবে না। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে তারা নির্বাচনে যাবে না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই হাওয়া বদলটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড এবং গত ৭ মার্চ ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের সভায় বিশাল জনসমাবেশ হওয়ার পর। এই সফল সমাবেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সঞ্জীবনী সুধার কাজ করেছে। বিএনপি এখনো বলছে বটে, বেগম জিয়ার কারাদণ্ড হওয়ার পর দলের ঐক্য ও শক্তি আগের চেয়ে আরো বেড়েছে এবং তারা উচ্চ আদালতে আপিল ও পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলন দ্বারা তাদের নেত্রীকে জেল থেকে মুক্ত করে আনবে এবং তাদের দাবি অনুযায়ী সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য হবে, কিন্তু এসব কথা বলার ব্যাপারে তাদের গলায় আগের জোর আর নেই। এক কথায় আওয়ামী লীগ শিবিরে আত্মবিশ্বাস বাড়ছে; বিএনপি শিবিরে আত্মবিশ্বাস কমছে।

এই রাজনৈতিক হাওয়া পরিবর্তনের একটা কারণ আছে। খালেদা জিয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প পরিদর্শনের জন্য কক্সবাজার যাওয়ার সময় যে বিশাল জনসমাবেশ ঘটেছিল, তা আওয়ামী লীগ শিবিরে অস্বস্তি সৃষ্টি করেছিল বলে ঢাকার একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিন্তু ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের সভায় জনসমুদ্র এই অস্বস্তির ভাব দূর করে দলটির মনে আবার আশা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপির আশা ছিল বেগম জিয়ার নেতৃত্ব, বিদেশে বসে তারেক রহমানের তৎপরতা এবং দেশে প্রোটেস্ট ভোটের সহায়তায় তারা সরকারকে তাদের দাবি অনুযায়ী নির্বাচনসহায়ক সরকার গঠনে বাধ্য করে অনায়াসে নির্বাচনে জয়ের মালা ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু তাদের সেই আশা পূর্ণ হয়নি। বেগম জিয়া দুর্নীতির মামলায় জেলে গেছেন, তাতে দেশ-বিদেশে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি। বিএনপি যেসব দেশের কাছ থেকে বেগম জিয়ার কারাদণ্ডের ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল তারাও নীরব। তারেক রহমান নিজেই দুর্নীতির দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ লাভ করায় কচ্ছপের মতো খোলসের মধ্যে মুখ লুকিয়েছেন। অন্যদিকে ৭ মার্চের সভাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শেখ হাসিনার সভায় জনতার ঢল প্রমাণ করে, প্রোটেস্ট ভোটের সংখ্যা ক্রমেই কমছে।

বিএনপি এখন অনুধাবন করেছে, দেশে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে তারা অক্ষম। তারেকের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ব্যর্থ। কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিকদের দ্বারা শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করে তথাকথিত নির্বাচনসহায়ক সরকার গঠনের দাবি মানানোর ব্যাপারেও এখনো তারা আশা ছাড়েনি। কিন্তু আশা কমছে। কারণ এই দেশগুলো দেখছে বেগম জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পরও তাঁর নিজের দেশের মানুষের মধ্যেই কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তারা প্রতিক্রিয়া দেখাতে যাবে কেন? তা ছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঘটনা থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো বুঝে নিয়েছে, শেখ হাসিনাকে চাপের কাছে নতি স্বীকার করানো যাবে না।

তাই এ মুহূর্তে বিএনপির ঘোষিত নীতি হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে অধিক ধরনা দেওয়া। তাদের বোঝানো, বেগম জিয়াকে মিথ্যা মামলায় জেলে নেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। পশ্চিমা দেশগুলোকে এ কথা বোঝানো গেলে তাদের শেষ আশা, এই দেশগুলো বেগম জিয়ার মুক্তি ও বিএনপির ছক মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার ওপর আরো বেশি চাপ প্রয়োগ করবে। এই চাপ যদি সফল না হয়, তাই পাশাপাশি তারা নির্বাচনে যোগ দেওয়ারও প্রস্তুতি চালাচ্ছে। কারণ বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকলে আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়তে পারে। কিন্তু বিএনপি অস্তিত্ব হারাবে।

বেগম জিয়ার জেল গমনের পরপরই বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল একটু কমে গিয়ে ঐক্য ও শক্তি একটু বেড়েছে তা সত্য। কিন্তু তা স্থায়ী কোনো ব্যাপার নয়। দলের বহু নেতাকর্মীই তাদের নেত্রীর জেলে যাওয়ার শক কাটিয়ে ওঠার পর যদি বোঝে, দলটির ক্ষমতায় যাওয়ার আশু সম্ভাবনা নেই, তাহলে তারা দ্রুত রং বদলাতে পারে। এমনকি মির্জা ফখরুলদের মতো নেতারাও অতীতে মওদুদ আহমদ, কাজী জাফর যা করেছেন, তাঁদের পন্থা অনুসরণ করতে পারেন।

আরেকটি কথা। বেগম জিয়া কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশসহ কোনো কোনো ইউরোপীয় দেশও হয়তো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারত। কিন্তু সে পথটি বন্ধ করেছেন বেগম জিয়া নিজে। লন্ডনের কূটনীতিক মহলের দু-একজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে জেনেছি, বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল কোনো কোনো দেশও তারেক রহমানের শিক্ষা, যোগত্যা ও কাণ্ডকীর্তি সম্পর্কে অবহিত। তারা চায় না, তারেক রহমানের মতো লোকের নেতৃত্বে বাংলাদেশে নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হোক এবং তারেক দেশটির প্রধানমন্ত্রী হোক।

তারা আশঙ্কা করে, তারেক বাংলাদেশে ক্ষমতায় গেলে আফগানিস্তানে বাচ্চা-ই-সাক্কো একদা ক্ষমতা দখল করলে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা দেখা দেবে। বিএনপির বহু নেতাকর্মীও তা মনে করেন। শুধু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। পুত্রকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন পদে বসিয়ে বেগম জিয়া নিজেই দলের কাঁধে সিন্দবাদের দৈত্যকে সওয়ার করে দিয়েছেন। দুর্নীতির দায়ে আদালতের বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি সুদূর বিদেশে বসে শুধু টেলিফোনের মাধ্যমে দল চালাবেন এবং নির্বাচনে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে জয়ী করবেন—এটা ভাবা বিএনপিরই অনেকে বাতুলতা মনে করেন।

তবু নির্বাচনে অংশগ্রহণই বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র পথ। লন্ডনে বসে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে যে খবর পাচ্ছি, তাতে মনে হয় বিএনপির নতুন চেয়ারপারসনও একই কথা ভাবছেন। এখন তাদের কর্মসূচি হলো, শেষ পন্থা হিসেবে প্রভাবশালী দেশগুলোকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হাসিনা সরকারের ওপর আরো চাপ সৃষ্টিতে রাজি করিয়ে তাঁদের মুখরক্ষার মতো একটা ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সম্মত করা। তা যদি না-ও হয়, বর্তমান দর কষাকষিতে তাঁরা যদি মুখরক্ষা করতে না-ও পারেন, তাহলেও নির্বাচনে অংশ নেবেন। সেই প্রস্তুতিও তাঁরা চালাচ্ছেন।

আমার একটা ধারণা, বিএনপির বর্তমান শীর্ষ নেতারা যতই হম্বিতম্বি করুন, তাঁরা তারেক রহমানের নির্দেশেই নির্বাচনে অংশ নেবেন। খালেদা জিয়াও কারাগারে থাকুন আর কারামুক্ত থাকুন, তাতে সম্মতি ও আশীর্বাদ দেবেন। বিএনপির তেমন জনসমর্থন নেই, কিন্তু একটি ভোটব্যাংক আছে। নির্বাচনে তাদের জয়ী হওয়ার আদৌ সম্ভাবনা নেই—এ কথা বলা যাবে না। আর জয়ী না হলেও সংসদে তারা শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করতে পারবে। তাতে দলটির ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ খোলা থাকবে। নির্বাচনে না গেলে দলটির অস্তিত্ব সংকট দেখা দেবে। এমনও হতে পারে মুসলিম লীগের মতো ইতিহাসের আবর্জনায় তার স্থান হতে পারে।

নির্বাচন-জয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের আত্মবিশ্বাস বাড়ার কারণ আছে। বিএনপির আন্দোলন গড়ে তোলা এবং প্রভাবশালী দেশগুলোর কার্যকর ও প্রকাশ্য সমর্থন আদায়ে ব্যর্থতা এবং সেই সঙ্গে দলের সভা-সমাবেশে ক্রমবর্ধিত জনসমাবেশ তাদের আরো উৎসাহিত করেছে এবং তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের চাঙা করে তুলেছে। আওয়ামী লীগকে শুধু একটা কথাই মনে রাখতে হবে। এবার নির্বাচনে জোর লড়াই হবে। শুধু উন্নয়নের খোশখবর শুনিয়ে লাভ হবে না। নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী দিতে হবে এবং মনোনয়ন বাণিজ্য যেন না চলে। (সৌজন্যে কালের কণ্ঠ)

লন্ডন, সোমবার, ১২ মার্চ ২০১৮

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত