বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

ব্যাংকিং সেবার অধোগতি

ব্যাংকিং সেবার অধোগতি

ডাঃ কিউ.এম. অহিদুল আলম, ১৩ মার্চ, এবিনিউজ : সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সম্মানিত শিক্ষকের সাথে চাঁদাবাজি নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। এক পর্যায়ে তিনি বললেন– চাঁদাবাজ আমার কাছে আসবে না। যদি আসে – আমি ‘অমুক’কে টেলিফোন করলে ২০জন “অ্যান্টি চাঁদা স্কোয়াড”– হাজির হবে। স্যারের সত্যি কথন শুনে খুশী হলাম। কারণ এই দেশটা কেবল সুবিধাভোগী (Priviliged) শ্রেণীর। দেশে আজ সুস্পষ্ট বিভাজন। রাজনৈতিক বিভাজন আমার আলোচ্য বিষয় নয়। একদিকে প্রিভিলাইজড শ্রেণী অপরদিকে আম জনতা। আম–জনতার জন্য টিকেট লাইন, হাসপাতালে লাইন, খাজনা–ট্যাক্সে লাইন, চাকরীতে লাইন, ব্যাংকে লাইন। কিছু মানুষ ভিআইপি কালচারে সন্তুষ্ট। আবার তাদের বৃহৎ বটগাছের মত আকৃতির করুণা কৃপায় সর্বত্র কাজ হয় দ্রুত বা গড়গড়ায়ে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এমন হওয়ার কথা ছিল না। “আমরা সবাই রাজা– আমাদেরই রাজার রাজত্বে”– এটা ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারের গান। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা। এলিটিষ্ট বিভাজনের অবসান, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের গণ–বান্ধব প্রশাসন– এসবই ছিল ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমাদের প্রজন্মের মানুষের আজ হিসাব মেলানো কঠিন।

আজকের আলোচ্য বিষয় ব্যাংকিং সেবার নিম্নমুখী অভিযাত্রা। আধুনিক সমাজে পুলিশ–আনসার যে রকম অত্যাবশ্যকীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্যাংকও সেরকম। বরং ব্যাংক বিদ্যুৎ–পানি–গ্যাসের মত নিত্য প্রয়োজনীয় সেক্টর। গ্রামে–গঞ্জে ব্যাংকিং সেবা ব্যাপ্ত হবায় একটা গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক ইন্টার একশ্যান ওয়ালা সেক্টরে পরিণত হয়েছে। তাই এখানে ব্যাংকের যাবতীয় কর্মচারীদের সেবাগ্রহীতার সন্তুষ্টির দিকে নজর রাখতে হয়। এই ক্ষেত্রেই যত ঘাপলা। ব্যাংকের ম্যানেজার, অফিসার সবাই শুধু পরিচিত, বড় ঋণখেলাপী, ছোট ঋণখেলাপীণ্ড এদেরকে চা আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকেন, যারা লাইনে দাঁড়ায় অর্থাৎ আম জনতার প্রতি সেবা দেয় অনেকটা সরকারী অফিসের কায়দায়।

প্রথমেই ধরা যাক একাউন্ট খোলার ব্যাপারে। একাউন্ট খোলার যে ফরম তাতে চার–পাঁচ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ কিছু নিয়ম কানুন থাকে। একাউন্ট খোলার সময় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এত উচ্ছ্বসিত থাকে যে, এসব নিয়ম কানুনের অন্ততঃ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটাও বলার অবকাশ পায় না। পরে লেনদেন করতে গিয়ে আঠার জটিলতার সৃষ্টি হয়। ড্রাফট–পেঅর্ডার ইত্যাদি করতে গিয়ে টেবিলে টেবিলে দক্ষতার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তার মানে দক্ষতার অভাব কি কারণে হচ্ছে তাও বলার কেউ নেই।

কোন কোন কর্মকর্তা বেশ স্মার্ট ও ভদ্রতার সাথে ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করেন, কিন্তু বেশীর ভাগই ক্লায়েন্টকে বসেন এই ভদ্রতা একটু হ্যান্ডসেক করাণ্ড এই এটিকেটও করে নাণ্ড যেটা যেকোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে কাম্য।

অধিকাংশ ব্যবহারজনিত ঘাটতি দেখা যায় ক্যাশ ও কাষ্টমার সার্ভিস কাউন্টারে। কাউকে বলে নোট এরকম কেন? কাউকে বলে নোট কয়টা লিখে দিন ইত্যাদি। এই কমিউনিকেশন গ্যাপ এর কারণ ক্লায়েন্টরা কি করতে হবে তা জানেন না। একটা ডিসপ্লে বোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ম সবার জ্ঞাতার্থে লিখে দেখানো উচিত।

যেই কথা দিয়ে শুরু করেছিলামণ্ড যারা প্রিভিলাইজড কাষ্টমার ওদেরকে ম্যানেজার–সেকেন্ডম্যান বসায়ে সব সার্ভিস দেন। এটা ভাল। কিন্তু সাধারণ কাষ্টমারদের সাথে সার্ভিস উন্নত করার চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন।

যারা ব্যাংকের নিয়োগকারী কর্মকর্তা ওদের জানা উচিত যে জিপিএ পাঁচ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল ফল সেবা প্রদানকারীর জন্য সেকেন্ড ইমপরটেন্ট ব্যাপার। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ণ্ড পাবলিক রিলেশন ও পাবলিক ইন্টার একশ্যান। একটা প্রবলেম সলিউশন না করে প্যাঁচ লাগানো হচ্ছে সরকারী দফতরের খাছিয়ত অনেক ক্ষেত্রে। এখন এই রোগ সংক্রমিত হয়েছে ব্যাংকিং সেবায়।

কাষ্টমার সন্তুষ্টির অধোগতির কারণ কি? আমার মতে বর্তমানে বেশীরভাগ রিক্রুটমেন্ট যোগ্যতার ভিত্তিতে না হয়ে অমুক–তমুকের টেলায় হয়। যার ফলে জিপিএ থাকলেও পাবলিক রিলেশন ও ইন্টারএকশনে এসব ‘বড়লোকী’ রিক্রুট নিম্ন স্কেলের। এরা চাকরী করে, বেতন পায়, স্ট্যাটাস গড়ে। সেবা গ্রহীতার সন্তুষ্টি তাদের ধাঁতে থাকবে কেন?

একদিকে ঋণখেলাপী। অন্যদিকে বহু ব্যাংকের বড় বড় কর্মকর্তারা জেল–জরিমানায় আছেন। এখন যুক্ত হয়েছে হোয়াইট কলার তরুণরা। সুবিধাভোগীরা চা–কফি খেয়ে চলছেন। আম–জনতা লাইনে দাঁড়িয়ে এসির ঠান্ডা লাগিয়েই শেষ। কাউন্টারে গেলে “বেতাইল্যা রিক্রুট”রা মনে করে আমরা এক জাত– ওরা অন্য জাত।

ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের প্রতিদিন কাজ শুরু করার আগে জেনে নেয়া উচিত ও শপথ বাক্যের মত প্রতিদিন পাঠকরা উচিতণ্ড গ্রাহকের সংজ্ঞাটা। বলাবাহুল্য পৃথিবীর অনেক দেশে কাজ শুরু করার আগে স্কুল ছাত্রদের মতো কিছু শপথ বাক্য ও নীতিবাক্য পাঠ করা হয়। গ্রাহকের এই সংজ্ঞাটা মহাত্মা গান্ধীর।

(১) গ্রাহক সেবাদাতার আঙ্গিনায় সবচেয়ে সম্মানিত আগন্তুক।

(২) তিনি সেবাদাতাদের থেকে খান না।

(৩) বরং সেবাদাতাদের রুজী গ্রাহকের উপর নির্ভরশীল।

(৪) সেবাগ্রহীতা অফিসে ইন্টারেপ্ট করতে আসেন না।

(৫) গ্রাহকরা সেবাদাতাদের পার্ট

(৬) হোয়াইট কলার তরুণরা গ্রাহকদের সেবা দিয়ে কোন ফেভার করছেন না।

(৭) গ্রাহকদের সেবা দেয়ার জন্যই কর্মকর্তাদের চাকরী।

আমাদের দেশে বর্তমানে সর্বক্ষেত্রে যে অব্যবস্থাপনা ও নিম্নমানের সেবা তার কারণ বুঝতে হলেণ্ড দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তী নেতা নেলসন মেন্ডেলার একটা উক্তি স্মরণযোগ্য, দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দেশের কালো আদমীরা বিভিন্ন রকম চাকরীতে কোটা বা সংরক্ষণের দাবী তোলে। মেন্ডেলা তার দেশবাসীকে বোঝালেন যেণ্ড যোগ্যতর ব্যক্তিকে ডিঙ্গিয়ে কম যোগ্য লোককে যেখানেই দেয়া হোক সে ঐ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করবে। অযোগ্য ডাক্তার হাসপাতাল, অযোগ্য শিক্ষক শিক্ষালয়, অযোগ্য প্রশাসক প্রশাসন, অযোগ্য ব্যাংকার ব্যাংক ধ্বংস করবে। একটা জাতিকে ধ্বংস করতে যোগ্যতর ব্যক্তিদেরকে সাইড লাইনে ঠেলে দেওয়াটাই যথেষ্ট। কোন কামান, মিসাইল ও বোমার প্রয়োজন হয় না। কম যোগ্য লোকরাই দেশ ধ্বংস করতে যথেষ্ট। মেন্ডেলার এই উক্তি আজকের বাস্তবতায় বোঝার লোকই বা কয়জন আছে? টাকা পয়সা ব্যাংকে না রেখে সিন্দুকে রাখার যুগ আসছে।

[email protected]

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত