রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
logo

পুঁথি ও প্রাচীন সাহিত্য গবেষক আবদুস সাত্তার চৌধুরী

পুঁথি ও প্রাচীন সাহিত্য গবেষক আবদুস সাত্তার চৌধুরী

নাজিমুদ্দীন শ্যামল, ১৩ মার্চ, এবিনিউজ : পুঁথিবিশারদ আবদুস সাত্তার চৌধুরী শুধু একজন পুঁথি সংগ্রাহকই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তিতুল্য পুঁথি গবেষক। তিনি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার হুলাইন গ্রামে ১৯১৯ সালের ৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল মজিদ ও মা ছিলেন রাফেয়া বেগম। তাঁর বংশ ছিলো সম্ভ্রান্ত। দৌলত মোহাম্মদ হামজা খাঁ চৌধুরী ছিলেন তাঁর পূর্ব পুরুষ। হামজা খাঁর ঊর্ধ্বতন তৃতীয় পুরুষ খোয়াজ মুহাম্মদ খাঁ পটিয়ার হুলাইন গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁরই দশম উত্তর পুরুষ পরম্পরায় আবদুস সাত্তার চৌধুরী জন্ম নেন।

তিনি নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে এম এ রাহাত আলী ইংরেজি স্কুলে পড়েন। সেখান থেকেই তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেন। তৎপরবর্তিতে তিনি রাউজানের গহিরা স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে পটিয়ার জিরি গ্রামের সুবেদার করম আলীর অধস্তন বংশধর ছবিলা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি ঊনাইনপুরা হাইদগাঁও, অহলা জঙ্গলখাইন, নাইখাইন, কর্তালা, বেলমুড়ি ইত্যাদি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ফলে গত শতাব্দীর ৪০ ও ৫০ এর দশকে এইসব স্কুলে অজস্র শিক্ষার্থীর শিক্ষাগুরু ও আদর্শিক গুরু হিসাবে তিনি খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন।

যে ব্যক্তি সৎ শিক্ষক হিসাবে নিজেকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, সেই ব্যক্তি কিভাবে পুঁথির সংগ্রহ ও গবেষণায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তার গল্পটি ভিন্ন। খুব ছেলে বেলায় তিনি তাঁর মায়ের কোলে বসে পুঁথি শুনতেন। একটু একটু করে বড় হতেই আবদুস সাত্তার পুঁথির সুরে নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন। আবদুস সাত্তার চৌধুরীর জীবনীকার ইসমাইল জসীম লেখেন, “এক রাতে কিশোর সাত্তার চৌধুরী যান পুঁথি পাঠের আসরে। আসর শেষে একে একে সবাই চলে গেলেন আসর ছেড়ে। রয়ে গেলেন কিশোর সাত্তার। তার ইচ্ছে হলো পুঁথির জ্বলজ্বলে শব্দগুলো নিজে দেখবেন আর পুঁথি পড়ুয়া পন্ডিত বা গায়েনের সাথে কথা বলবেন। চোখেমুখে তার বিস্ময়ের ছাপ। আধা ছেঁড়া ধূসর তুলট কাগজে লেখা কালো অক্ষর, অপরিচিত বর্ণ। দূর থেকে দেখেন গায়েনের সাথে কথা বলছেন এক বৃদ্ধ লোক। কিছুটা ভীত, কিছুটা দ্বিধা। তার পরেও মনে সাহস সঞ্চয় করে কিশোর সাত্তার গেলেন গায়েনের কাছে। গায়েন তাকে দেখে বললেন, কীরে সাত্তার কিছু বলবি? সঞ্চিত সাহসে কিশোর সাত্তার বলেন, হ্যাঁ, গায়েন সাহেব, আমি কি আপনার হাতের পুঁথিটি ধরে দেখতে পারি? কেন তুই কি পড়তে চাস? বলেন গায়েন। কিশোর মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। গায়েন তাকে পুঁথিটি পড়তে দেন। কিশোর কোনোভাবেই এ পুঁথি পড়তে পারছেন না। কীভাবে পারবেন? তারতো পুঁথির শব্দগুলোর সাথে পরিচয় নেই। বর্ণগুলো আধুনিক বাংলা বর্ণের মতো না। তারপরেও কিশোর অপার বিস্ময়ে চোখ বুলাতে থাকেন পুঁথির পাতায়। ওল্টাতে থাকেন একের পর এক পাতা। কিছু পরিচিত ও কিছু অপরিচিত শব্দ দেখে পুঁথির প্রতি তার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। মনে মনে সংকল্প করেন যে করেই হোক পুঁথির বই দুর্বোধ্য পাঠ তাকে রপ্ত করতেই হবে।”

তারপরের ইতিহাস আবদুস সাত্তার চৌধুরীর জীবনকে পুঁথি ও প্রাচীন সাহিত্য গবেষণায় নিজেকে নিবেদন করার ইতিহাস। গায়েনের সাথে কথা বলা সেই বৃদ্ধ লোকের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তিনি সাহিত্যবিশারদের বাড়ি যান। তাঁর স্নেহের সান্নিধ্য লাভ করেন। আস্তে আস্তে পুঁথি ও প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

রাহাত আলী স্কুলের ছাত্র থাকাকালে সময়ে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের স্নেহ শুধু লাভ করেননি বরং তাঁর ভাবশিষ্য হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময় একদিন তিনি তাঁরই আত্মীয় নেয়ামত আলী সাদার বাড়িতে যান। তিনি নেয়ামত আলী সাদাকে রাজি করিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটি পুঁথি নেন। তিনি পরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে সাহিত্যবিশারদকে সেই পুঁথিটি দিয়ে যান। পুঁথিটি পেয়ে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলেন সাহিত্য বিশারদ তাঁকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সাথে সাথে খুশি হয়ে বালক সাত্তারকে দুটি রূপার মুদ্রা দিয়েছিলেন। জানা যায় বালক সাত্তার সেই টাকার একটি দিয়ে একটি জামা কিনেছিলেন। তার বাকি টাকা খরচ করেছিলেন আরো পুঁথি সংগ্রহের জন্য। আর পুঁথি সংগ্রহের এই নেশা তাকে এমনভাবে পেয়ে বসেছিলো যে বালক বয়স থেকেই তিনি সবকিছু ছেড়ে পুঁথির পেছনে সময় ব্যয় করেছেন। প্রাচীন সাহিত্য আর পুরান কাহিনীর পাঠ তাঁকে সারা জীবন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

পুঁথি সংগ্রহ ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সুত্র প্রফেসর ড. আহমদ শরীফের সাথে তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল। ১৯৬১ সালে ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বাংলা একাডেমিতে পুঁথি সাহিত্য ও লোক সাহিত্য সংগ্রহের প্রকল্প শুরু হলে তিনি তাঁকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংগ্রাহক হিসাবে নিয়োগ করার প্রস্তাব দেন। সেই মতে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান তাকে উক্ত পদে নিয়োগ দেন। সেই সময় তিনি শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে সার্বক্ষণিক পুঁথি ও লোক সাহিত্য সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন। তিনি বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছেন ১৯৬১ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৭০০ এর বেশি পুঁথি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি শুধু বাংলা ভাষার পুঁথি নয়, বরং আরবী, ফার্সি, উর্দু, সংস্কৃত, পালি ও বর্মি ভাষায় অনেক প্রাচীন সাহিত্য কর্ম সংগ্রহ করে এই সময়ে সাহিত্যের ইতিহাসকে ঋদ্ধ করেছেন।

১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান তাঁকে বাংলা একাডেমি থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে নয়শ’র বেশি অর্থাৎ প্রায় এক হাজার পুঁথি সাহিত্যে সংগ্রহ করেন। এই সময় তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. আব্দুল করিমের উৎসাহে ও সহযোগিতায় দেড় শতাধিক আরবী ও উর্দু পুঁথির পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। এই কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, আবদুস সাত্তার চৌধুরীর সংগৃহিত প্রাচীন সাহিত্য ও পুঁথির পান্ডুলিপি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয় ‘দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ও পান্ডুলিপি শাখা’। আবদুস সাত্তার চৌধুরীর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই শাখার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামানের উৎসাহে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সংগৃহীত ও সংরক্ষিত পুঁথিগুলোর একটি বর্ণনাত্মক গবেষণা কর্ম ‘পুঁথি পরিচিতে’ শিরোনামে সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে প্রফেসর ড. মাহবুবুল হকের সম্পাদনায় বাংলা বিভাগের জার্নাল পান্ডুলিপিতে এই গবেষণা কর্মটি প্রকাশিত হয়েছিলো।

সম্প্রতি জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত পুঁথিগুলো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষণের জন্য নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। এই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী, বর্তমান প্রফেসর ও প্রো–ভাইস চ্যান্সেলর ড. শিরিন আক্তার আমাকে বলেছেন, এই সব পান্ডুলিপি শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অমূল্য সম্পদ নয়, বরং বাংলা সাহিত্যে ও বিশ্বসাহিত্যের দুষ্প্রাপ্য রত্ন ভান্ডার। তাই এসব রত্ন ভান্ডার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করবে।’

এই অমূল্য রত্ন ভান্ডার আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়ে গেছেন আবদুস সাত্তার চৌধুরী। তিনি পুঁথি ও প্রাচীন সাহিত্যের সংগ্রাহক, গবেষক, পাঠোদ্ধাকারী পন্ডিত ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন। ‘পুঁথি সংগ্রহ এবং পাঠ নির্ধারণ কাজে সাত্তার চৌধুরীর সমকক্ষ দ্বিতীয় ব্যক্তি বর্তমানে আর কেউ নেই।”

আবদুস সাত্তার চৌধুরীর সংগৃহীত পান্ডুলিপি বাংলা একাডেমি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় জাদুঘর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর, বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে। তিনি জীবদ্দশায় কয়েক হাজার পুঁথি, প্রাচীন সাহিত্যে, লোক সাহিত্যের পান্ডুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। শুধু সাহিত্য নয়, তাঁর সংগ্রহে চারশ বছরের পুরাতন হাতে লেখা কোরান শরীফও রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. দিলওয়ার হোসেনের লেখা থেকে জানা যায় যে, সৈয়দ আলী আহসান তার মধুমালতী, ড. আহমদ শরীফ, ‘শরীয়ত নামা’ ‘জঙ্গনামা ও বিজয় হামজা’ ইত্যাদি আবদুস সাত্তারের সংগৃহীত ও সংরক্ষিত পুঁথি থেকেই সম্পাদনা করেন। সৈয়দ আলী আহসানের সম্পাদিত আলাওলের পদ্মাবতীও বরেণ্য এই পুঁথি সংগ্রাহক সংগ্রহ করেছিলেন।

জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামানের মতে, ‘এই শ্রম সাধ্য কাজে তিনি (আবদুস সাত্তার চৌধুরী) ব্রত না হলে অনেক রচনাই লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে যেতো।’

প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন ‘আমাদের দেশের মধ্যযুগের সাহিত্য অবহেলা লাভের একটি কারণও এই সব সংগ্রাহক ও তাঁদের প্রথম পাঠোদ্ধার ইতিহাসের প্রতি অবহেলা ও অযত্ন দৃষ্টি। সাত্তার চৌধুরী সেই সব হতভাগ্যদেরই একজন অথচ, কী অমূল্য সম্পদ রাসিক সংবাদ ও তথ্যই না তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন।’

গবেষক অধ্যাপক ইলু ইলিয়াস আমাদের জানান, ১৯৯৩ সালে মোমেন চৌধুরীর সম্পাদনায় সাত্তার চৌধুরী সংগৃহীত ২৬ লোক গীতিকার মধ্যে ১৩টি দিয়ে ‘চট্টগ্রাম গীতিকা’ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আবদুস সাত্তার চৌধুরীর সংগৃহীত কয়েক হাজার পাণ্ডুলিপি এখনো শুধু সংগ্রহ শালায় সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়তো হচ্ছে, কিন্তু এসব প্রকাশনার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আবদুস সাত্তার চৌধুরীর দ্বারা উদ্ধারকৃত পাঠের পান্ডুলিপিগুলো প্রকাশিত হলেও প্রাচীন পুঁথি ও সাহিত্যের প্রথম পাঠোদ্ধারের দালিলিক ইতিহাস হয়তো সংরক্ষিত হতো। তিনি যে অমূল্য রত্নভাণ্ডার আমাদের দিয়ে গেছেন, তা হয়তো কালান্তরে আরো সমৃদ্ধ হবে এবং মূল্যায়িত হবে। কিন্তু আবদুস সাত্তার চৌধুরীকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁর জীবন ও অবদানের মূল্যায়ন করতে হবে। অন্যথায় মণিমুক্তাই থাকবে শুধু মনিকার হারিয়ে যাবে।

নাজিমুদ্দীন শ্যামল : কবি ও সাংবাদিক

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত