বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

এনজিও : নব্য মহাজন?

এনজিও : নব্য মহাজন?

আবদুল বায়েস, ১৪ মার্চ, এবিনিউজ : বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধরনের এনজিও কাজ করে: (ক) শুধু ক্ষুদ্রঋণনির্ভর এনজিও, (খ) ক্ষুদ্রঋণ ও সমাজ উন্নয়নমূলক সেবায় সম্পৃক্ত এনজিও এবং (গ) শুধু সমাজ উন্নয়নমূলক এনজিও (সরকারি অনুদানে স্থানীয় খুব ছোট এনজিও)। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে এনজিওর সংখ্যা তিন হাজারের মতো অনুমান করা হয়। তবে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি)-তে ২০১৪ সালে প্রায় ২ কোটি ঋণগ্রহীতা নিয়ে নিবন্ধনকৃত এনজিও বা ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৭০০।

১৯৮২ সালে গ্রামীণ মোট ঋণগ্রহীতার গড়পড়তা দুই-তৃতীয়াংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস যেমন— মহাজন, ভূমির মালিক, ব্যবসায়ী, আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ গ্রহণ করত (ভূমিহীন খানা ঋণগ্রহীতার প্রায় ৯২ শতাংশ ঋণ নিত অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে)। অন্যদিকে মোট ঋণ অর্থের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এবং ভূমিহীনদের মধ্যে ৯২ শতাংশের ঋণ আসত ওই উৎস থেকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’র ঋণগ্রহীতা উপেনের চেয়ে বাংলাদেশের দরিদ্রশ্রেণীর অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না।

প্রয়াত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেনের ৬২ গ্রামের খানাভিত্তিক জরিপের প্যানেল তথ্য থেকে ঋণবাজার সম্পর্কিত তাত্পর্যপূর্ণ আলোচনা উঠে আসে। ১৯৮৮ সালে গ্রামীণ মোট খানার ৩৭ শতাংশ কোনো না কোনো উৎস থেকে ঋণ নিত, যা ২০১৪ সালে মোট খানার অর্ধেকে দাঁড়ায় ঋণগ্রহীতা। অর্থাৎ গ্রামীণ খানার প্রায় অর্ধেক ঋণনির্ভর এবং বাকি অর্ধেক ঋণনির্ভর নয়। তবে ১৯৮৮ সালে ভূমিহীন খানার (৫০ শতক পর্যন্ত যাদের জমি) প্রায় ৪০ শতাংশ ঋণ নিত, যা ২০১৪ সালে দাঁড়ায় ৫৪ শতাংশ। এর বিপরীতে যাদের জমি ৫০ শতকের ওপর, তাদের অনুপাত প্রায় একই আছে। অর্থাৎ গেল কয়েক দশকে গ্রামীণ ঋণবাজারে ভূমিহীন ও দরিদ্র খানার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সম্ভবত তা এনজিওর কারণে।

এবার প্রাপ্ত ঋণের উৎস নিয়ে কথা। একই তথ্যভাণ্ডার থেকে ঋণের উৎস পরিবর্তন লক্ষ করলে দেখা যায় যে, ১৯৮৮ সালে মোট ঋণগ্রহীতা খানার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ঋণ নিত প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে, যেমন— ব্যাংক, সমবায়, এনজিও ইত্যাদি। এর বিপরীতে ২০১৪ সালে তিন-চতুর্থাংশ ঋণ গ্রহণ করেছে ওইসব উৎস থেকে। অন্য কথায়, গেল তিন দশকে গ্রামের মোট ঋণপ্রবাহে প্রাতিষ্ঠানিক উেসর অবদান বেড়েছে ২৮ থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ এবং এর প্রায় পুরোটাই এনজিওর কারণে। লক্ষণীয় যে, একই সময়ে ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতা খানার অনুপাত হ্রাস পেয়েছে তিন গুণ, যেখানে এনজিও থেকে ঋণগ্রহীতা খানার অনুপাত বেড়েছে প্রায় নয় গুণ। অন্য কথায়, গ্রামীণ প্রাতিষ্ঠানিক ঋণপ্রবাহে প্রায় ৬০ শতাংশ হিস্যা এনজিওর ও ১২ শতাংশ ব্যাংকের। আরো দেখা গেছে যে, ১৯৮৮ সালে গ্রামীণ ঋণগ্রহীতা খানার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ঋণ নিত অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে, যা ২০১৪ সালে এসে দাঁড়ায় এক-চতুর্থাংশ। এটা নিঃসন্দেহে একটা সুখবর। তবে বিস্ময়ের বিষয় এই যে, এখনো গ্রামীণ ঋণগ্রহীতা খানার এবং মোট ঋণপ্রবাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক উেসর ওপর নির্ভরশীল।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে, ১৯৮৮ থেকে ২০১৪ সময়কালে এনজিও থেকে ঋণগ্রহীতা ভূমিহীন খানার অনুপাত প্রায় ৪ থেকে ৪৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং এদের মোট প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের অংশ ২০ থেকে ৪০ শতাংশে উঠেছে।

আগেই বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বেশকিছু এনজিও ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহের সঙ্গে সামাজিক সেবাও সরবরাহ করে। যেহেতু সব এনজিও সম্পর্কিত তথ্য আমাদের হাতে নেই, সেক্ষেত্রে এবং আপাতত সামাজিক উন্নয়ন খাতে ব্র্যাকের অবদানকে প্রতিনিধিত্বশীল হিসেবে বিবেচনা করে কিছু কথা বলা যেতে পারে। ব্র্যাকের মতো বড় বড় এনজিও দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি (অথবা ক্ষুদ্রঋণের বাইরে) সামাজিক সেবা দিয়ে থাকে। যেমন— বর্তমানে ৫০ লাখ ঋণগ্রহীতাকে ক্ষুদ্র অর্থায়ন করা ছাড়াও ব্র্যাকের বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—

(ক) হতদরিদ্র হঠানো কর্মসূচি (খ) প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিকরণ এবং শিক্ষার মানোন্নয়ন (গ) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পর্যবেক্ষণ ও পদক্ষেপ নেয়া (ঘ) সবার জন্য স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচি (সারা দেশে ১,০৫,০০০ স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে) (ঙ) যুব বয়সীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণ (চ) ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য নিরসনে কাজ করা (ছ) নারীর ক্ষমতায়ন, কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট, আইনি সহায়তা ইত্যাদি।

সরকারি উৎস ও দাতা সংস্থার উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০০২-১৬-এর মধ্যে বাংলাদেশে মোট ১১ মিলিয়ন (১.১ কোটি) চরম দরিদ্র খানা দারিদ্র্যমুক্ত হতে পেরেছে। একই সময়ে ব্র্যাকের হতদরিদ্র বা চরম দরিদ্র কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় ১৮ লাখ দরিদ্র খানার চরম দারিদ্র্যমুক্তি ঘটেছে এবং এদের মধ্যে ৯০ শতাংশের টেকসই উন্নতিও ঘটেছে বলে গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। এর অর্থ, বাংলাদেশে মোট যত খানা চরম দারিদ্র্য রেখার উপরে উঠতে পেরেছে, তার প্রায় ১৫ শতাংশ শুধু ‘ব্র্র্যাকের হতদরিদ্র কর্মসূচি’র কারণে সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। তেমনিভাবে যক্ষ্মা রোগ ব্যবস্থাপনায় ২০০২-১৬ পর্যন্ত যত লোকের যক্ষ্মা রোগসংক্রান্ত উন্নতি ঘটেছে, তার মধ্যে ব্র্যাকের অবদান ৪২ শতাংশ; ছানি রোগ নিরাময়ে ব্র্যাকের অবদান ৩৮ শতাংশ; প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনকারীদের ৯ শতাংশ এবং প্রাক-প্রাথমিক সমাপ্তকারীদের ১৫ শতাংশ ব্র্যাক স্কুল থেকে আসা। আরো কিছু পরিসংখ্যানসমেত উপমা টেনে বলা যায় বোধ হয় যে, ব্র্যাকের মতোই অন্যান্য এনজিও ক্ষুদ্রঋণের মতো গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক সেবা বিস্তৃত করছে।

এ পর্যন্ত ব্র্যাক শুধু প্রত্যন্ত অঞ্চলে (হার্ড টু রিচ) ৩০ লাখ মানুষকে নিরাপদ পানি এবং সারা দেশে পাঁচ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে প্রশিক্ষণ ও তিন কোটি খানায় স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা সরবরাহ করেছে। এমনিভাবে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থাকা এনজিওগুলো শুধু ক্ষুদ্র অর্থায়নের মাধ্যমে দরিদ্রের সেবা করছে না, তারা সামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখছে। আর সেজন্যই বোধ হয় নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন ও জে ড্রেজ বিশেষত বাংলাদেশের সামাজিক খাতে এনজিওর অবদানের প্রশংসা করেছেন।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এনজিওর ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে প্রচুর গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণ বেরিয়েছে। যেমন— নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও জি ড্রেজ মনে করেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে ভারতের উপরে অবস্থান নিয়ে আছে, তার অন্যতম কারণ বাংলাদেশে এনজিওর অবদান (বিশেষভাবে ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংক)। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর রেহমান সোবহান দরিদ্রের কাছে অধিকতর দক্ষতা ও ব্যয়সাশ্রয়ী উপায়ে সেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দরিদ্রকে বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পক্ষে মত দিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (এমআর) এক প্রতিবেদন মনে করে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র অর্থায়ন খাত শক্তি সঞ্চয় করে সামষ্টিক অর্থনীতি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। অন্য এক গবেষণায় প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও এস আর ওসমানি মনে করেন, ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্রকে বড় মাপে সাহায্য করেছে। তবে এনজিওর ক্ষমতা সম্পর্কে আকাশচুম্বী ধারণার কোনো অবকাশ নেই। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ শহিদ খন্দকার দেখিয়েছেন, শুধু ক্ষুদ্রঋণের সুযোগ পাওয়ার কারণে ২০১০ সালের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ লাখ খানা টেকসইভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হতে পেরেছে। অধ্যাপক এস আর ওসমানি দেখিয়েছেন, ক্ষুদ্র অর্থায়ন অনুপস্থিত এমন দৃশ্যের বিপরীতে ক্ষুদ্র অর্থায়নের সুযোগ টেকসইভাবে ঋণগ্রহীতার সম্পদ সংযোজন করে মোট দারিদ্র্য হ্রাসের প্রায় ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী থাকছে।

এনজিওর বিরুদ্ধে সাধারণ অভিযোগগুলো নিম্নরূপ, যা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও মনোযোগের দাবি রাখে: সুদের উঁচু হার; ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য চিরস্থায়ী করা; এনজিওর অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও অসুস্থ এবং মহিলা ঋণ নেয়, পুরুষ ব্যয় করে ইত্যাদি।

বর্তমানে বাংলাদেশের এনজিওর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিম্নরূপ: বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমহ্রাসমান সাহায্য ও অনুদান; টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বিশেষত ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে প্রথম পাঁচটি লক্ষ্য অর্জনে সরকারকে সহায়তা দেয়া; মধ্যম আয়ের দেশে পরিমাণের চেয়ে গুণগত পরিমাণের গুরুত্ব বেশি বিধায় চলমান ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন সাধন; সরকারি অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ পাওয়া; দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ; কস্ট রিকভারি ও সোস্যাল এন্টারপ্রাইজ পদ্ধতিতে উত্তরণ এবং ঋণের সঙ্গে ঋণবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সন্নিবেশকরণ। (বণিক বার্তা)

লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত