শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
logo

‘বইমেলার মধ্য দিয়ে দেশের প্রকাশনা শিল্প চাঙ্গা হয়েছে’

‘বইমেলার মধ্য দিয়ে দেশের প্রকাশনা শিল্প চাঙ্গা হয়েছে’

ঢাকা, ১৪ মার্চ, এবিনিউজ : হয়ে গেল বাঙালির প্রাণের উৎসব ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ফেব্রুয়ারি জুড়ে সরগরম ছিল মেলার মাঠ। তেমন কোনো বিশৃঙ্খলা না থাকায় এবারের বইমেলা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বেশিরভাগ পাঠক, প্রকাশক এবং লেখক। তবে কোনো কোনো ব্যাপারে তারা কিছু প্রস্তাব রেখেছেন। একুশের বইমেলাকে ঘিরে বাংলা একাডেমির ব্যবস্থাপনা, কাজ ও দেশের প্রকাশনা শিল্প নিয়ে একটি দৈনিকের অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন : এবারের বই মেলা নিয়ে প্রকাশক, লেখক ও পাঠকরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। বইয়ের বিক্রিও বেশ ভালো। মেলায় ৪ হাজারের বেশি বই বেরিয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

শামসুজ্জামান খান : প্রতি বছরই বইয়ের মান বাড়ছে। এবারের বই মেলায় ৪৮৮টি মানসম্মত বই আমরা পেয়েছি। এই হিসেব ছিল মেলার শেষ দিনের আগ পর্যন্ত। শেষের দিনেও কিছু বই এসেছে। সেখানে আরও ৩০ থেকে ৪০টি বই মানস্মত হবে। সব মিলিয়ে পাঁচশর মতো মানসম্মত বই এবারে মেলায় বেরিয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। এছাড়া বাংলা একাডেমি থেকে বই বেরিয়েছে ৫০টি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৫৫০টির এর মতো বই প্রকাশিত হয়েছে যেগুলোকে আমরা মানসম্মত বলতে পারি। একটি মেলায় এক বছরে এতগুলো বই যদি মানসম্মত হয় তাহলে সেটাকে আমরা ইতিবাচক বিষয় বলে মনে করি।

প্রশ্ন : এই মান নির্ণয়টা কীভাবে করছেন?

শামসুজ্জামান খান : মেলার শুরু থেকেই আমরা একটা গ্রুপ করে দিয়েছি। তারা বিভিন্ন স্টলে গিয়েছে, বইয়ের তালিকা নিয়েছে, বই সংগ্রহ করেছে। এছাড়া মেলায় প্রকাশিত প্রত্যেকটা বই আমাদের কাছে জমা হয়। এমন হতে পারে হয়তো নতুন কিছু বই আমাদের কাছে জমা হয়নি। তাছাড়া সব বই-ই জমা হয়েছে। আমাদের কাছে যেসব বই জমা হয়েছে, সেখান থেকে বাচাই করে মানসম্মত বই নির্ধারণ করা হয়।

প্রশ্ন : কয়েকজন প্রকাশক বলেছেন মেলায় স্টল বরাদ্দে পুনঃবিন্যাস দরকার। স্টলগুলো এমনভাবে সাজানো দরকার যাতে মেলায় ঢুকলে একসঙ্গে সব স্টল দেখা যায়। আবার কোনো কোনো স্টল পিছনে পড়ে যাওয়ায় অনেকে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

শামসুজ্জামান খান : যারা এমন বলছেন তারা মনে হয় খুব বেশি বইমেলা দেখেননি। আমি সৌদি আরবের জেদ্দা, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট, ভারতের দিল্লি, কলকাতাসহ অনেক বইমেলায় গিয়েছি। কোনটিই সেরকম নয়। বিশাল একটি অঙ্গণে সবগুলো স্টল একসঙ্গে দেখা যাবে এটা কোনোদিনই সম্ভব নয়। মেলায় ঢুকলে একবারে দেখা যাবে- এমনভাবে যদি স্টল সাজানো হয়, তাহলে একদিকে স্টল সাজাতে হবে। মাঝখানের জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে বিশাল জায়গার দরকার। আমরা প্রচারের ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি স্টলের খোঁজ জানতে চায় তার জন্য তথ্যকেন্দ্র ছিল। বেশিরভাগ প্রকাশনাই তো নোট বই বিক্রি করে প্রকাশক হয়েছে। কেউ যদি বিজ্ঞাপন দেয়, প্রচারের ব্যবস্থা করে, তাহলে সেটা পিছনে কিংবা সামনে যেখানেই হোক না কেন পাঠক খুঁজে বের করবেই। পাঠকের যে বইটি দরকার তারা সে স্টল খুঁজে বই কিনেছে। আর এবারের বই মেলার যে স্টল বিন্যাস করা হয়েছে তা নিয়ে বড় বড় ব্যক্তিত্ব, লেখক-সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

প্রশ্ন : মেলায় বেস্ট সেলার বই, ভালো প্রচ্ছদ, ভালো প্রিন্ট, সুন্দর স্টল-এসব ক্ষেত্রে আপনারা কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

শামসুজ্জামান খান : প্রতিবছরই এর একটা মূল্যায়ন হয়। এর জন্য আলাদা কমিটি রয়েছে। 'কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার' দেওয়া হয় সুন্দর স্টলের জন্য। এবার পুরস্কারটি পেয়েছে ‘কথাপ্রকাশ’ প্রকাশনী। চারুকলার দুই শিক্ষক, একজন স্থপতি নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি বইমেলা ঘুরে স্টলের বিন্যাস এবং নান্দনিকভাবে সাজানোর ভিত্তিতেই বেস্ট স্টল নির্বাচিত করে। ‘শহীদ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’-এর আওতায় দেওয়া হয় ভালো বইয়ের পুরস্কার। এক বছর আগে প্রকাশিত বই থেকে শুরু করে এবারে মেলায় যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের স্টল থেকে পুরস্কারের জন্য বই জমা নেওয়া হয়। শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থ প্রকাশের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হয়। এখানেও তিন সদস্যের একটি কমিটি আছে। প্রকাশনা, মুদ্রণ মান-সব কিছু মিলিয়ে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। গুণগত মান বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হয়। সব পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রেই একটি করে কমিটি থাকে।

প্রশ্ন : অনেকেই বলেন, আমাদের প্রকাশনা এখন বইমেলাকেন্দ্রিক। তাই অনেক লেখক মনে করেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র পরিসরে বছরের বিভিন্ন সময় মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে বইমেলা করার কোন উদ্যোগ বা চিন্তা আছে কি বাংলা একাডেমির?

শামসুজ্জামান খান : বাংলা একাডেমির কাজ এটা নয়। প্রকাশকরা এটা করতে পারেন। কলকাতার প্রকাশকরা যদি এত বড় একটা বইমেলার আয়োজন করতে পারেন তাহলে আমাদের দেশের প্রকাশকরা কেন পারবেন না! একসময় রাজধানীতে 'ঢাকা বই মেলা' হতো। আমরা চেয়েছিলাম সেটাকেই আন্তর্জাতিক বইমেলায় পরিণত করতে। কারণ একুশের বইমেলায় আমরা অন্য দেশের বইকে সেভাবে প্রাধান্য দিই না। আন্তর্জাতিক বইমেলায় আমরা সেটা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নানা কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। এখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সরকারিভাবে জেলায় জেলায় বইমেলার আয়োজন করে। আগে প্রত্যেক জেলায় হতো। বর্তমানে বাছাই করে কয়েকটি জেলায় হয়। কিন্তু সেটা ভালো আকারে হচ্ছে না। আমার মতে, মেলাগুলো কিছুটা প্রচার বাড়িয়ে, বিজ্ঞাপন দিয়ে করা দরকার। এই বইমেলা যদি গ্রাম বাংলায়ও করা যায় তাহলে আরও ভালো হয়। বাংলা একাডেমি একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। একুশের বই মেলার জন্য আমাদের তিনমাস অস্বাভাবিক পরিশ্রম করতে হয়। এ রকম আয়োজন আরও করতে গেলে আমাদের মূল কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রশ্ন : অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?

শামসুজ্জামান খান : অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিককালে কর্মকাণ্ড জোরদার করা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানদের বিপুল জনপ্রিয় ক্লাসিক মীর মোশাররফ হোসেনের 'বিষাদ সিন্ধু' ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। এরকম আরও অনেক বই যেমন-নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরঙ্গনা বলছি’, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’, আবু ইসহাকর ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’- এগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। সিলেটের কয়েকজন কবির কবিতা অনুবাদ হয়েছে। বাইরের দেশের সাহিত্য আমরা বাংলায় অনুবাদ করছি। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ওপর গবেষণাধর্মী একটি বই ইংরেজি ও বাংলা-দুই ভাষাতেই করার পরিকল্পনা করছি। এরকম আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।

প্রশ্ন : দেশের প্রকাশনা শিল্প নিয়ে আপনার অভিমত কী?

শামসুজ্জামান খান : প্রত্যেক প্রকাশনারই দক্ষ লোকের ঘাটতি রয়েছে। হাতে গোণা ৬ থেকে ৭টি প্রকাশনা বাদে বেশিরভাগ প্রকাশনারই সম্পাদক, ভালো সম্পাদনা সহকারী ও মুদ্রণ ব্যবস্থা নেই। এসব উন্নত করা গেল প্রকাশনার মান উন্নত হবে। বইমেলার সময় মৌসুমি প্রকাশকের সংখ্যা বেড়ে যায়। যদি বইমেলার আগে প্রকাশনা সংস্থাটি কতগুলো বই প্রকাশ করেছে তার একটা হিসেব নেওয়া যেত তাহলে ভালো হতো। যদিও বাংলা একাডেমির নিয়ম অনুযায়ী বছরে ২০টি বই বেরিয়েছে এরকম একটা হিসেব তারা দেখায় বটে; কিন্তু সেইসব বই মানসম্পন্ন নয়। ওখানে আরও নিষ্ঠা, দক্ষতা, ভালো সম্পাদনা সহকারী ও সম্পাদক দরকার। তবে এই বইমেলার মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্প চাঙ্গা হয়েছে। বইয়ের একটা বাণিজ্যও তৈরি হয়েছে। এবার বইমেলায় ৭০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। বাংলা একাডেমির বই গঠনমূলক বা গবেষণামূলক বই। তারপরও ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বই মেলায় বিক্রি হয়েছে। বড় বড় প্রকাশনীর বিক্রিও এরকম। অন্যান্য প্রকাশনী স্টল, কর্মীদের খরচ বাদেও ভালো লাভ করেছে।

প্রশ্ন : বাংলা একাডেমির কাজ কেমন চলছে?

শামসুজ্জামান খান : আমাদের তো সারাবছরই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়। আমরা দেশের ক্লাসিক্যাল বইগুলো নিয়ে কাজ করি। যেসব বই একসময় বিখ্যাত ছিল এখন পাওয়া যায় না; কিন্তু দরকার- এমন বই নিয়ে আমরা কাজ করছি। যেমন-কাজী ইমদাদুল হকের ‘আবদুল্লাহ’, হুমায়ুন কবিরের ‘নদী ও নারী’, কাজী আবদুল ওদুদের ‘শ্বাশ্বত বঙ্গ’-এ ধরনের বই আমরা করেছি। শামসুর রহমানের রচনাবলী, শওকত ওসমানের রচনাবলী, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের বইগুলো করছি। এ ছাড়া ‘আলোকচিত্রে বাংলাদেশ’, ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে ইতিহাস গ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বহুমাত্রিক’ বিশ্লেষণ- এ ধরনের গবেষণামূলক বই, বাংলা একাডেমির গবেষণামূলক ত্রৈমাসিক পত্রিকা, মাসিক উত্তারাধিকারসহ অন্যান্য পত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে।

প্রশ্ন : আপনারা আপনাদের কাজ নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট?

শামসুজ্জামান খান : আমরা মোটামুটি সন্তুষ্ট; কিন্তু তৃপ্ত না। আমরা আরও কিছু কাজ করতে চাই। এই সরকারের আগের সরকারের সময়ে এখানে কিছু লোক নেওয়া হয়েছে যাদের সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে সেরকম ধারণা নেই। আমাদের জনবল কিছুটা কম আছে। বর্তমানে আমাদের ৮৫৭ জন লোকবল রয়েছে। ঘাটতি আছে ১৪০ জনের মতো। এটা পূরণ হলে আমাদের কাজের পারিধি আরও বাড়বে বলে আশা করছি। (সমকাল অনলাইন থেকে সংগৃহীত)

এবিএন/সাদিক/জসিম/এসএ

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত