আহমদ রফিক, ১৫ মার্চ, এবিনিউজ : সমাজে অবক্ষয় যখন শুরু হয়, তখন প্রতিকার ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে না পারলে জীবাণু সংক্রমণের মতো অবক্ষয়ের দ্রুত বিস্তার ঘটে। সে বিস্তার সমাজের সর্ব খাতে। নীতি, নৈতিকতা, সততা সব কিছু পিছু হটে, দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। ব্যক্তি, পরিবার, সমষ্টি, সমাজচেতনা দূষিত হতে থাকে। দূষণ শাসনব্যবস্থায়ও। অনেকটা রসায়নবিদ্যার চেইন রি-অ্যাকশনের মতো।
যে শিক্ষাব্যবস্থার একসময় খ্যাতি ছিল নির্দোষ, দুর্নীতিমুক্ত খাতরূপে, এখন তার সর্বাঙ্গে ক্ষত। শিক্ষক ও শিক্ষার মানই শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়, সেখানে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাঙ্গে কালি ছিটাতে শুরু করেছে। কোচিং যেমন নানা মাত্রায় এক কালো অধ্যায়রূপে বিবেচিত, একে বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে প্রশ্ন ফাঁসের মতো চরম দুর্নীতি আর তাতে জড়িত শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
অবস্থা এমনই অধঃপতনের যে গণমাধ্যমে সমালোচনার তুমুল ঝড়। তার বিস্তার ফেসবুকে তীব্র তীক্ষ, তির্যক মন্তব্যে। সে ঝড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থা হালভাঙা নাবিকের মতো বেহাল। অথবা তুলনা চলে অতীতের বহু প্রচলিত ‘ঠুঁটো জগন্নাথের’ সঙ্গে। বিস্ময়কর ঘটনা হলো, এত সব সত্ত্বেও তারা নির্বাক, জড় পুতুলের মতো নিষ্ক্রিয়, কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
অবস্থা এ পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে শেষ পর্যন্ত ‘প্রশ্ন ফাঁসের তীব্র সমালোচনা ১৪ দলের বৈঠকে’। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের জোটে অন্তর্ভুক্ত শরিক দলের পক্ষেই এই সমালোচনা। আহ্বান অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার (৬-২-২০১৮)। শরিক দলগুলোর বিচলিত হওয়ার মূল কারণ সামনে নির্বাচন। ভোটারদের প্রশ্নের কী জবাব দেবে তারা?
দুই.
এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো, এ ঘটনা হঠাৎ বা আকস্মিক কিছু নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই এসব চলছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড, এমনকি খাস মন্ত্রণালয় পর্যন্ত নিরুত্তর ও নির্বাক ভূমিকায়। অর্থাৎ যা ঘটছে ঘটুক। মধ্যখানে শিক্ষামন্ত্রীর অবাঞ্ছিত আলটপকা মন্তব্য সমালোচনার রসদ জোগায়। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত গুটিকয় শিরোনাম ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করবে। কিন্তু বুঝতে চাইছে না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান।
যেমন—‘প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা অবক্ষয়ের চিহ্ন বহন করে’, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস মহামারি আকার লাভ করেছে’, ‘শিক্ষার গলায় প্রশ্নফাঁস’, ‘রেহাই পাচ্ছে না প্রথম শ্রেণির শিশুরাও’, ‘প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নেই’, ‘মানিকগঞ্জে ইংরেজির প্রশ্নপত্র ফাঁস’, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জীবনীশক্তি বলে আছে কি কিছু?’, ‘প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলল ফেসবুকে পাওয়া প্রশ্ন’, ‘প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানোই যাচ্ছে না’।
নমনীয় এসব শিরোনামের প্রতিবেদনে কিছু প্রতিবাদ, কিছু পরামর্শ ও দাবি প্রকাশ পেয়েছে। এসব শিরোনামের পাশাপাশি একাধিক পত্রিকায় রয়েছে চড়া শব্দের শিরোনাম : ‘শিক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করা উচিত’, ‘শিক্ষামন্ত্রী সম্পূর্ণ ব্যর্থ’, ‘ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস, ধরার কেউ নেই’, ‘সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি’। এমন অনেক দাবি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
ভাবতে হচ্ছে ‘প্রশ্ন ফাঁসের এই মহামারিতে কাদের লাভ ও পোয়াবারো’ আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোই বা কেন ব্যর্থ? এ ব্যর্থতা কি ইচ্ছাকৃত। প্রশ্ন ফাঁসে তো দুই ধরনের লাভ। প্রথমত, যারা পড়াশোনা না করে পাস করতে ও ভালো ফল পেতে চায় তাদের লাভ। দ্বিতীয়ত, মেধাবীরা এ সুযোগ গ্রহণ করলে অসাধারণ ‘রেজাল্টের’ অধিকারী।
অন্যদিকে যারা এ অপরাধে লিপ্ত তারা অঢেল অবৈধ অর্থের মালিক, যারা শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এ অর্থের কিছু কি চুইয়ে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছায়? আমাদের তা জানা নেই, অর্থাৎ সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। তবে মন্দলোকের ভাষ্য এমন কথাই বলে।
আগে একসময় পরীক্ষায় নকলবাজি দেখা গেছে, তবে ব্যাপক হারে নয়। তাদের কেউ কেউ ধরাও পড়েছে, পরীক্ষার হল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। সেসব ঘটনা এখন প্রতœতাত্ত্বিক বিষয়। একটি বিষয় দুর্বোধ্য ঠেকে যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গৃহীত বহুবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের পরও কোন জাদুকাঠির বলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েই চলেছে। এর কি কোনো সুরাহা নেই?
এরই মধ্যে সংবাদপত্রে মজার খবর : ‘এসএসসি পরীক্ষায় পর পর দুদিন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্তের জন্য উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ঘোষণা—প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকার পুরস্কার’ ঘোষণার ফলাফল শূন্য।
এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রশ্ন : দেশের গোয়েন্দা বিভাগ কি এতই দুর্বল যে তারা প্রশ্ন ফাঁসের মতো সাধারণ সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ? প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি তো ছোটখাটো বৃত্তে আবদ্ধ। অর্থাৎ যাঁরা প্রশ্নপত্র তৈরি করেন এবং যাঁরা প্রশ্নপত্র ছাপার কিংবা সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকেন তাঁরাই প্রশ্নপত্র ফাঁসের রহস্য উদ্ঘাটনে সাহায্য করতে পারবেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা, যা শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার সমালোচনা করেছেন কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক-শিক্ষাবিদ। যেমন—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্সের কথা বলে কিন্তু যেখানে শিক্ষার্থী ও জাতির ভবিষ্যৎ নিহিত সেখানে তার প্রতিফলন দেখছি না।’ পরীক্ষার্থীদের ওপর আরোপিত কয়েকটি ব্যবস্থাকে তিনি ‘অমানবিক’ ও ‘নিবর্তনমূলক’ বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক পত্রিকায় দেখেছি চমক লাগানো কয়েকটি খবর। শিরোনাম : ‘প্রশ্ন ফাঁসে ভিআইপিসহ তিন শ ফোন নম্বর শনাক্ত’। এ কাজটি করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাতে মনে হচ্ছে ফাঁসচক্রটি বেশ বড়। এর মধ্যে রয়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষক, পরীক্ষার্থী, অভিভাবক। এমনকি কোনো কোনো শিক্ষার্থী এ কাজে তাদের ভিআইপি মা-বাবার সেলফোন নম্বর ব্যবহার করেছে।
তিন.
সদিচ্ছা থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধী শনাক্ত করা ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশকে অসাধ্য সাধন করতে দেখা গেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের সুরাহা হতে দেখা যায়নি।
যেমন—সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন। এখনো মাঝেমধ্যে এ ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে সম্ভাবনামূলক খবর ছাপা হয়। তেমনি আরেকটি করুণ ঘটনা কুমিল্লা কলেজের মেধাবী ছাত্রী ধর্ষণ ও হত্যার নিষ্ঠুরতা, তাও আবার ক্যান্টনমেন্টের মতো সুরক্ষিত এলাকায়।
এমন ঘটনা এন্তার ঘটছে যে সমাজের প্রতাপশালী, বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি জঘন্য অপরাধের পরও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তদন্ত বিলম্বিত হতে থাকে বছরের পর বছর, এমনকি শেষ পর্যন্ত এমন তদন্ত প্রতিবেদনই উপস্থাপন করা হয় যে বিচারকের কিছু করার থাকে না।
যা হোক, প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে গণমাধ্যম এমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, খবর ও প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন, এমনকি সম্পাদকীয় মন্তব্য ছেপে যে সেই চাপে হয়তো গোয়েন্দা তৎপরতা গতিশীল হবে, সমস্যার জট খুলতে থাকবে। এরই মধ্যে তেমন কিছু আলামত দেখা যেতে শুরু করেছে।
একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তিন কলামের খবর : ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসে তিন ভাইয়ের ডিজিটাল চক্র!’ ‘জড়িত ১৪ আসামি রিমান্ডে’। ফেসবুক নিয়ে প্রশ্নপত্র কেলেঙ্কারির ঘটনায় এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে জড়িত থাকতে দেখা গেছে। আগেই বলেছি, উন্নত প্রযুক্তিতেও অপরাধীদের মেধা কার্যকর। অনুমান করা চলে শিক্ষিত শ্রেণিতে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যেও দুর্নীতির কালো ছায়া কত দূর প্রসারিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত আরেকটি শিরোনাম : ‘প্রশ্ন ফাঁসের হোতাদের মুখে ভয়ংকর তথ্য’। এতে দেখা যাচ্ছে যে স্কুলের ছাত্র থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং অনার্স বা মাস্টার্স কোর্সের ছাত্রদেরও কেউ কেউ এজাতীয় অপরাধে কিংবা অপরাধীচক্রের সঙ্গে জড়িত। আর গ্রেপ্তারকৃত পূর্বোক্ত তিন ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে মিলেছে লাখ লাখ টাকা।
আশা করা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বাহিনীর সদিচ্ছার মাত্রা যদি প্রসারিত হয়, তাহলে হয়তো গোটা অপরাধীচক্রই ধরা পড়বে, আইনের আওতায় আসবে। কিন্তু তাতে কি নতুন করে ব্যাপক হারে গজিয়ে ওঠা প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপরাধযাত্রা বন্ধ হবে? ওষুধের বিরুদ্ধে জীবাণুর প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার মতো নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে ফাঁসপ্রক্রিয়া শুরু হবে না তো?
হবে না, যদি সরকারি সচেতনতা ও কার্যক্রম তৎপরতাপূর্ণ সদিচ্ছায় বরাবর সচল থাকে।
আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অব্যাহত তৎপরতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শুরুতেই যে সামাজিক অবক্ষয় ও ব্যাধির কথা বলা হয়েছে, বহু ঘটনার অপতৎপরতায় তার প্রকাশ। প্রশ্নপত্র ফাঁস সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঘটন বলা চলে। কাজেই গোয়েন্দা বাহিনীর তৎপরতায় এ অপরাধের সাময়িক অবসান ঘটলে অন্য কোনো না কোনোভাবে এর বা অনুরূপ অপরাধপ্রক্রিয়ার প্রকাশ ঘটতে থাকবে।
স্থায়ীভাবে অপরাধ বা দুর্নীতির অবসান ঘটবে সমাজবদলের মাধ্যমে, সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হলে। কাজেই সাময়িক চিকিৎসার পাশাপাশি স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর না হলে আখেরে কোনো লাভ হবে না। অঘটন, অপরাধ যথারীতি ঘটতেই থাকবে। একমাত্র ন্যায়নীতিবাচক সুশাসনই অপরাধপ্রবণতা দমন করতে পারে। (কালের কণ্ঠ)
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী