![অর্পিত সম্পত্তি-ভাগবাটোয়ারার চিন্তা বাদ দিন](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/15/kamrul-hasan_130475.jpg)
কামরুল হাসান বাদল, ১৫ মার্চ, এবিনিউজ : একজন ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন শত্রু সম্পত্তির নামে কীভাবে হিন্দুদের সম্পত্তি জোরদখল করা হয়েছে। তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন যতই আইন করা হোক তার প্রাপ্য সম্পত্তি ফিরে পেতে তাকে কী যন্ত্রণা আর গঞ্জনা সইতে হয়। শুধু যে শত্রু সম্পত্তির মতো আইন করে হিন্দুদের জায়গা–জমি দখল করা হয়েছে তা নয়। এখনো দেশে প্রতিটি এলাকার প্রভাবশালীরা ওঁত পেতে থাকে কীভাবে হিন্দুদের জায়গা জমি দখল করা যায়। ফলে নানা ছুঁতো ও উসিলায় এখনো দেশে হিন্দুদের মন্দিরে, বসতবাড়িতে হামলা চালানো হয়। তাদের বাড়িছাড়া, দেশছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়। কীভাবে তাদের দামি জমি–জমা পানির দরে বেচে দেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়।
এই অমানবিকতা থেকে, মানুষের এই অপমান থেকে পরিত্রাণ চাই। দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সাথে ন্যায়ানুগ আচরণ করা হোক। তাদের সম্পূর্ণ অধিকার ভোগ করার সুযোগ দেওয়া হোক। দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের যোগ্য অধিকার দেওয়া হোক।
দিন যায়, বছর যায়, সরকার বদল হয় কিন্তু হিন্দুদের জায়গা–জমি দখলের পাঁয়তারা থামে না। অনেক সময় সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও আইনের মারপ্যাঁচ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে থাকে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের কার্যকর প্রয়োগ। ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছরেও এই সমস্যার সম্মানজনক ও কার্যকর সমাধান হলো না। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে ভাগাভাগি করে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার বিধান রেখে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। এই ধরনের অমানবিক অসভ্য চিন্তা কার বা কাদের মস্তিষ্ক প্রসূত তা ভেবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছি। ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে মন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এদেশ ছেড়ে অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। দেশত্যাগের এই প্রক্রিয়া কখনো বন্ধ হয়নি। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের পর এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি আসীন হওয়ার পর হিন্দুদের দেশত্যাগ আবার বাড়তে থাকে। এরপর প্রতিবার নির্বাচন এলে কিংবা নানা ছলছুতোয় হিন্দুদের মন্দির ও বসতবাড়িতে হামলা হলে অনেকে দেশত্যাগ করে। এই প্রক্রিয়া এখনো বহমান।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা ছিল অকৃত্রিম ও অবারিত। ভারত সবর্তোভাবে সহযোগিতা না করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এক প্রকার অসম্ভব হয়ে উঠতো। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত বাংলাদেশ সরকারকে সেদেশে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সুযোগ দিয়েছে। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে আর তার পাশাপাশি এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সে দেশের অন্তত ১০ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে বলে ভারত দাবি করেছে। বাংলাদেশের স্বার্থে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে ভারতের প্রচুর সামরিক ব্যয়ও হয়েছে। স্বাধীনতার পর সকল ধর্মের মানুষের জন্য অনুকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সংবিধানের মূল চার স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করেছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক চেতনার গুণে সদ্য স্বাধীন দেশে সব ধর্মের সম অধিকার প্রতিষ্ঠারও প্রচেষ্টা শুরু থেকেই নেওয়ার উদ্যোগ করেছিলেন রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পাকিস্তানিদের করা এই অমানবিক আইনটি বাতিল করা যাই নি তখনো।
১৯৬৫ সালে পাক–ভারত যুদ্ধের শুরু থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব হিন্দু নাগরিক ভারতে চলে যায় এবং ভারতে অবস্থান করছিলেন তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি আখ্যায়িত করে পাকিস্তান সরকার তা দখল করে নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের পি.ও ২৯/৭২ জারি করে শত্রু সম্পত্তি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ সরকারের ওপর ন্যস্ত হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। ১৯৭৪ সালে অর্পিত ও আদিবাসী আইন করা হয়। এর ফলে শত্রু সম্পত্তিসমূহকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৮৪ সালের ৩১ জুলাই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এরপর আর কোনো সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে ঘোষণা করা হবে না। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে অর্পিত সম্পতি প্রত্যর্পণ আইন পাশ হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে আইনটির একটি সংশোধনী গৃহীত হয়। এ সংশোধনীতে বিধান করা হয়, অর্পিত সম্পত্তির দাবিদার (মালিক/উত্তরাধিকারী) সহ অংশীদার বা স্বার্থাধিকারীগণ/ অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হতে সম্পত্তি অবমুক্তির আবেদন করতে পারবেন। মালিক/উত্তরাধিকার/স্বার্থাধিকারীকে বাংলাদেশি নাগরিক হবার বিধানের ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে শব্দটির বিলোপ করা হয়। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি জেলা কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির বিধান যুক্ত করা হয়। অর্থাৎ খ তফসিলে উল্লিখিত অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি জেলা কমিটির কাছে আবেদনের সুযোগ রাখা হয় এই সংশোধনীতে।
এরপরের অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত। যারা সম্পত্তি অবমুক্তির আবেদন করেছেন তারাই বুঝেছেন কত ধানে কত চাল। হয়রানি কত প্রকার ও কী কী। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের সাগর–রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, ১৭ বছর হলেও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইনের কার্যকর প্রয়োগ নেই। এমন কোনো উদাহরণ নেই যেখানে সত্যিকার অর্থে ভাবতে পারি যে, আইনটির যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে। ভূমি অফিসের এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের প্রতি অভিযোগ তুলে সুলতানা কামাল বলেন, উল্টো আমরা দেখতে পাই এই আইনের মাধ্যমে যারা নিজেদের জমিজমা ফেরত চাচ্ছে, তারা কী পরিমাণ হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। জমিজমা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব যাদের ওপর মোটের ওপর হয়রানিটা তারাই করছে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় ২০০১ সালের আইনের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সব প্রতিবন্ধকতা অপসারিত না হওয়ায় ভুক্তভোগীদের আশা এখনো পূর্ণ হয়নি। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে ভাগাভাগি করে জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার বিধান রেখে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের জনবিরোধী ও প্রচলিত আইনবিরোধী বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয় সম্মেলন থেকে।
শত্রু সম্পত্তি আইন বা অর্পিত সম্পত্তি আইন কিংবা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন যা বলি না কেন এমন একটি আইন কোনো সভ্য দেশ বা সমাজের বাস্তবতা হতে পারে না। যারা এদেশের ভূমিপুত্র, যারা হাজার বছর ধরে এদেশেই বসবাস করে এসেছে বংশ পরম্পরায়, এদেশের জল–হাওয়ায় যারা বড় হয়েছে তাদের শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বঞ্চিত করা হবে, তাদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি আখ্যা–দেওয়া হবে তা অত্যন্ত অমানবিক এবং মানবতার অপমান।
সরকার বা সরকার প্রধানের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এক ধরনের সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী ও এদেশের কিছু দখলবাজ মানুষের কারণে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য বা উদ্যোগ ব্যর্থ হবে তা মেনে নেওয়া যায় না। ৬০ বছরেরও অধিক সময় ধরে দেশের কিছু সংখ্যক নাগরিকের সম্পত্তি ভোগদখল হয়ে থাকবে। তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হবে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
একজন ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন শত্রু সম্পত্তির নামে কীভাবে হিন্দুদের সম্পত্তি জোরদখল করা হয়েছে। তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন যতই আইন করা হোক তার প্রাপ্য সম্পত্তি ফিরে পেতে তাকে কী যন্ত্রণা আর গঞ্জনা সইতে হয়। শুধু যে শত্রু সম্পত্তির মতো আইন করে হিন্দুদের জায়গা–জমি দখল করা হয়েছে তা নয়। এখনো দেশে প্রতিটি এলাকার প্রভাবশালীরা ওঁত পেতে থাকে কীভাবে হিন্দুদের জায়গা জমি দখল করা যায়। ফলে নানা ছুঁতো ও উসিলায় এখনো দেশে হিন্দুদের মন্দিরে, বসতবাড়িতে হামলা চালানো হয়। তাদের বাড়িছাড়া, দেশছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়। কীভাবে তাদের দামি জমি–জমা পানির দরে বেচে দেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়।
এই অমানবিকতা থেকে, মানুষের এই অপমান থেকে পরিত্রাণ চাই। দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সাথে ন্যায়ানুগ আচরণ করা হোক। তাদের সম্পূর্ণ অধিকার ভোগ করার সুযোগ দেওয়া হোক। দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের যোগ্য অধিকার দেওয়া হোক। সরকার কঠোর হলে দেশে যে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বা বিভাজন তৈরি সম্ভব নয় তার প্রমাণ সম্প্রতি শ্রীলংকার সরকার দিয়েছে। এক বৌদ্ধ নাগরিককে হত্যা এবং মুসলিমের দোকান পুড়িয়ে দেওয়ার জেরে শ্রীলংকায় জনপ্রিয় পর্যটন নগরী ক্যান্ডিতে মুসলিম বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে শ্রীলংকার সরকার রাষ্ট্রজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। এবং কঠোর হস্তে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করে। দাঙ্গা প্রশমনে শ্রীলংকার বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে সে দাঙ্গা বিস্তৃত হতে পারেনি। মূলত এটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেও এর পেছনে ধর্ম নয় অর্থনৈতিক কারণই মুখ্য বলে অনেকে বিবেচনা করছেন। কারণ ক্যান্ডির মতো জনপ্রিয় পর্যটন নগরীর ব্যবসা–বাণিজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করে মুসলিমরা। তাদের এই বাণিজ্য ও সম্পদ লুণ্ঠন করার অভিপ্রায়ে সেখানে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে যেমন বিশ্বের নানা স্থানে করা হয়ে থাকে।
আশা করব বাংলাদেশ সরকারও তার সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে। তা না হলে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি ভঙ্গ হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা মাদার অব হিউম্যানিটি উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। আমি আশা করি তিনি মায়ের মতোই তার সকল সন্তানের ভালোমন্দের খোঁজ রাখবেন। নিরাপদে রাখবেন, তাদের সবার অধিকার সমুন্নত রাখতে আন্তরিক প্রয়াস নেবেন।
(সংগৃহীত)