
শাকিল আহমদ, ১৬ মার্চ, এবিনিউজ : কবি রেহেনা মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এবং হিমু মন’ পাঠে মনে হলো কবিতা হয়ে উঠার কলকবজা ইতোমধ্যেই তিনি রপ্ত করেছেন। কিম্বা বলতে হয় কবিত্ব শক্তি তাঁর সত্তাজুড়ে বিরাজমান। নয়তো শিক্ষাজীবনে প্রাণি বিদ্যার শাখা প্রশাখায় বিচরণ শেষে পাঠককে ‘এবং হিমু মন’– এর মতো মন্ত্রমুগ্ধ পংক্তিমালা সমর্পণ করা সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে আমার মনে পড়ে যায় কবিতাকে নিয়ে কাটা–কাটি করা কবি প্রেমী প্রাজ্ঞজন প্রয়াত সিদ্দিক আহমদের কবি ও কবিতা বিষয়ক কথকতা। একজন কবিকে তিনি সাধারণ থেকে আলাদা করেছেন এ ভাবে “সকলে কবিতা লিখতে পারে না। কবিরা পারেন। মানুষের মধ্যে কবিতা আলাদা। মানুষের সঙ্গেই তাঁদের বসবাস। তবুও তাঁদের হাবভাব আচার–আচরণ আলাদা। কারণ ঈশ্বর যেমন প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন, তেমনি প্রতিটি কবিই কবিতার মধ্যে সামাজিক প্রকৃতি সৃষ্টি করে যাচ্ছেন প্রতিদিন। শব্দ গাঁথার কৌশল রপ্ত করার দিন থেকেই কবিরা এই কাজ করে চলেছেন। (প্রবন্ধ: কবি + মস্তকবি = সমস্ত কবি, সিদ্দিক আহমদ)।
কবিতার শরীর বুননে, শব্দের পিঠে শব্দ সাজিয়ে কবিরা নির্মাণ করেন কবিতার ইমারত। তাই বলে কবিতায় শব্দের বিনা শর্তে যথেচ্ছ ব্যবহারও চলে না। শুধু মাত্র শৃঙ্খলিত শব্দের খেলায় মেতে উঠতে পারে একটি অনন্য কবিতা। আর সে কারণেই একজন কবিকে শব্দ শিকারীও হতে হয়। কবি রেহেনা মাহমুদের করোটির ভিতরেও প্রতি নিয়তই খেলা করে দুরন্ত মাছের পোনায় মতো অসংখ্য শব্দ মালা। কিন্তু সুচতুর কবি কিলবিল করা শব্দ রাজি থেকে ধার নেয় জুতসই শব্দাবলী। সে কারণেই শব্দের স্বেচছাচারী ব্যবহার তাঁর কবিতায় পরিলক্ষীত হয় না। উপযুক্ত শব্দ প্রয়োগে হয়ে উঠে তাঁর নিঠোল কবিতা খানি।
যেমনঃ
“স্বেচ্ছাচারী শব্দেরা দল বেঁধে ঢুকে পড়ে অন্দরে বিছানায়
শরীরে শরীরে খেলা করে নির্ভয়ে।
শব্দেরা ঢুকে পড়ে মনের অলিন্দে
নেচে নেচে প্রবাহিত হয় ধমনী শিরায়।
চিবুকে টোল পড়া গালে।
কি অবাধ তার বিচরণ (স্বেচ্ছাচারী শব্দেরা) এখানে শব্দের অবাধ বিচর আছে বটে। সেটি হচ্ছে কবিতাটির জীবন খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে। অবশ্যই কবিতার অবয়বে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে নয়। আর এখানেই কবি রেহেনা মাহমুদের কবিতার শরীর বুননের ক্ষেত্রে শব্দ প্রয়োগের অনন্যতা।
“কবিতা লেখা কতই সহজ এবং কতই কঠিন। কবিতা লেখার পূর্বে সব কবিই পদ্য লিখেছেন। এবং পদ্য যখন গভীর মনস্কতা দাবি করল তখনই তা কবিতা হয়ে উঠল। সহজ বোধ্য কবিতা। সহজ কবিতা কিবা দুর্বোধ্য কবিতা, কঠিন কবিতা এভাবে কবিতার সরলীকরণ ঠিক হবে না। কবিতা সহজ ও নয় কঠিনও নয়। বহিরন্দের জন্য কবিতা সহজ কঠিন হয় না। তবে বলা যেতে পারে কবিতার কোন কোন আচরণ কঠিন ঠেকার কারণ কবিতা পরিচিত জগতের বিস্তৃতি ব্যাখ্যা উন্মোচন করে না‘’ (বই: কবিতার রাজনীতি, সিদ্দিক আহমদ)
সিদ্দিক আহমদের সংজ্ঞায়িত কবিতায় আমাদের আলোচ্য কবি রেহেনা মাহমুদ– জীবনের কোন পর্যায় থেকে পদ্য লিখতে শুরু করেছেন তা আপাতত আমাদের অজানা থাকলেও তাঁর ‘এবং হিমু মন’ (প্রকাশ কাল– ফেব্রুয়ারি ২০১৮) প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই– এ শুধুমাত্র পদ্য নয়, কবিতা হয়ে উঠারও আস্বাদ পাঠক মাত্রই অনুধাবন করতে পারে। কবিতার রস আস্বাদনে বিমুগ্ধ হয়ে তাঁর কবিতার মাঝে অবগাহন করতে পারে যেমন :
“ আমার অপারগতাকে অহংকার ভেবোনা অভিমুন্য চাইলেই পারি না আমি অনেক কিছু যেমন পারি না ঘর–সংসার সমাজ ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে গৃহত্যাগী হতে বোধি পূর্ণিমার আলোয় (অপারগ)
রেহেনা মাহমুদের কবিতার অবয়ব বিমূর্ততায় আচ্ছন্ন এমনটি মনে হয় না। প্রতিদিনের চলার পথের জীবন– সংসার প্রেমের রাগ–অনুরাগ, জগৎজোড়া আবেগ–ভালোলাগা–ভালোবাসাকে তিনি ঘুরে ফিরে কবিতার অবয়বে উপমা রূপক উৎপেক্ষায় আর ভাবের খেলায় বার বার সমর্পণ করেছে। কবিমন মাত্রই কোলাহল থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায়। সুখ যেনো অপেক্ষায় আছে নাগরিক সভ্যতায় নয়। কোন নির্জনে– গোহায় অথবা পাহাড়ের চুড়ায়। তাইতো কবিমন চাইছে–
“হৃদয়স্বত্বের সাথে একটা পাহাড়ও দিস।
খুব ইচ্ছে আমার একটা পাহাড়ের মালিক হবার।
চূড়ায় পাহাড়ি ঘর বানানো কাঠের।
ইচ্ছে একটা আদিম জীবন কাঠাই।
পাহাড়ের কোলে গড়ি স্বপ্নভুবন।
তুই না হয় ঘরের দাওয়াতে বসে হুক্কা টানিস।
আমি সকাল– বিকাল ঢালুজমিতে করবো জুম চাষ।
ফলে– ফসলে ভরবে আমাদের ফসলি মাঠ।
(ভালাবাসার জুম চাষ)
পাহাড়ের চূড়ায় জুম চাষের মতো শ্রমলদ্ধ মনোভাবের কবি রেহেনা মাহমুদ যদি কবিতার চাষ–বাসে আগামী বন্ধুর পথ মারিয়ে চলতে পারে, তা হলে পরিপূর্ণ কবি হয়ে উঠাও সুুদূর পরাহত কিছু হবে না। যে কবি ভেতরে– বাইরে জগৎ সংসারে এবং প্রকৃতিতেও প্রতিনিয়ত ভাঙনের শব্দ শুনে, সে কবি ও সাধারণ মানুষের নিগঢ় ভেঙে সহসা কবিতার সাম্রাজ্যে নিজেকে অসাধরণ করে তুলতে পারবে। আমরা পাঠক কুলও সেই প্রতিক্ষাই রইলাম। অনন্য প্রকাশ থেকে ধ্রুব এষ– এর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে রেহেনা মাহমুদের প্রথম কবিতার বই ‘এবং হিমু মন’ এর পঞ্চাশটি কবিতা হাজারো পাঠকের ভালোলাগায়–ভালোবাসায় সিক্ত হোক। (সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি