
চৌধুরী শাহজাহান, ১৯ মার্চ, এবিনিউজ : মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির আত্ম অহংকার। শৃঙ্খল মুক্তির জন্য বাঙালি জাতি অনেক ত্যাগ স্বীকার করে। মাতুভূমিকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষার এরকম ইতিহাস বিশ্বে বিরল। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করেছে। বাংলাদেশের নাটকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভূমিকা ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। পাকিস্তানী শোষণ, সংগ্রাম, যুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নাটকের মৌল বিষয়। বিষয় ও ভাবের দিক থেকে বাংলাদেশের নাটকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি প্রকরণ পরিচর্যায়ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ–অনুসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে চমৎকারভাবে। বাংলা নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি যুদ্ধকে অবলম্বন করে আবার কখনো বা নাটকের বিষয়াংশ সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উজ্জীবন ঘটিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মমতাজ উদ্দীন আহমদ যে সব নাটক রচনা করেছেন তা নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চারটি নাটক হচ্ছে ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ (১৯৭১), ‘এবারের সংগ্রাম’ (১৯৭১), ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ (১৯৭১) এবং ‘বর্ণচোর’ (১৯৭২)। পরবর্তীকালে এসব নাটক নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ (১৯৭৬) শীর্ষক নাট্যগ্রন্থ। কিশোরদের জন্য মমতাজ উদ্দীন আহমদ লিখেছেন ‘বকুলপুরের স্বাধীনতা’ (১৯৮৬)। পাকিস্তানী শাসকের শাসন–শোষণের ফলে এ দেশের হত দরিদ্র জনগণের মধ্যে যে আবেগ ও ক্ষোভের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিলো তারই সফল নাট্যচিত্র ফুটে উঠেছে মমতাজ উদ্দীনের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ নাটকে। নাটকে ছোট দারোগা নুর মোহাম্মদ ও সিপাহী দলিলুর রহমান বিপ্লবী মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করার দায়িত্বে নিয়োজিত। সরকার বিপ্লবীকে ধরে দেওয়ার জন্য পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা করেছে। দেশ দরোদি দারোগা নুর মোহাম্মদ ছদ্মবেশী বিপ্লবী মোয়াজ্জেম হোসেনকে পেয়েও মুক্ত করে দিয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানী দোসর সহকর্মী দলিলুর রহমানকে সে গুলি করে হত্যা করেছে। এ নাটকে ছদ্মবেশী মোয়াজ্জেম ও দারোগা নুর মোহাম্মদের মধ্যে দেশপ্রেম ও শৃঙ্খলমুক্তির প্রবল আকাঙক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। ‘এবারের সংগ্রাম’ এবং ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাট্যদ্বয়ে রূপকের ব্যঞ্জনায় নাট্যকার তুলে ধরেছেন ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কাহিনী এবং একই সংগে বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। রাজা–উজির–সিপাহসালার প্রভৃতি রাজকীয় চরিত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির অত্যাচারের কাহিনী চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এ নাটকে।
‘বর্ণচোর’ নাটকে চিত্রিত হয়েছে উচ্চকণ্ঠ উচ্চারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের ভণ্ডামি,পাশবিকতা ও মনুষ্যত্বহীনতার কাহিনী। তবে মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে রচিত মমতাজ উদ্দীনের শ্রেষ্ঠ নাটক ‘বিবাহ’ ও ‘কি চাহ শঙ্খচিল’ (১৯৮৫)। ‘বিবাহ’ নাটকের কেন্দ্রীয় বিষয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হলেও ইতিহাসের ক্রমধারায় তা মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক ‘কি চাহ শঙ্খচিল’ নাটকের সংগে একীভূত ও একাত্ম। এ প্রসংগে নাট্যকার বলেন– “স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে কি চাহ শঙ্খচিলের বিষয় নির্ধারিত। বিবাহ নাটকের সখিনা এবং কি চাহ শঙ্খচিলের রোশন আরা আবেগ ও যন্ত্রণার সূত্রে আমার কাছে অভিন্ন চরিত্র। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন স্বাধীকার এবং একাত্তরের যুদ্ধ স্বাধীনতা শপথে যেমন ধারাবাহিক সূত্রে গ্রথিত তেমনি ‘বিবাহ’ ও ‘কি চাহ শঙ্খচিল’ একই আবেগ ও বেদনার ধারাবাহিক বিকাশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্য কর্তৃক নারী ধর্ষণের কলঙ্কিত ইতিহাস নিয়ে রচিত হয়েছে ‘কি চাহ শঙ্খচিল’ নাটক। নির্যাতিতা নারীদের অপরিমেয় যন্ত্রণা ও বেদনা নাট্যকার শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেছেন,তুলে ধরেছেন সর্বস্বহারা নারীদের বুকফাটা আর্তনাদ। নাটকে নায়িকা রোশন আরার অন্তিম সংলাপ উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন– ”যুদ্ধকে নিয়ে তোমরা ভাগ্য গড়ে নাও। সাধের সিংহাসন মজবুত কর,পৃথিবীর রঙকে মলিন কর–আমি তো প্রতিবাদ করিনি–আমি তো সূর্যের আলোতে মুখ দেখাতে চাইনি। কিন্তু আমার সন্তানকে নিয়ে তোমরা বাণিজ্য গড়তে চাও কেন? আমার সন্তানের পরিচয়কে তোমরা অপবিত্র কর কেন?—-স্বাধীনতা? কার স্বাধীনতা? কেমন স্বাধীনতা? মায়ের কোলে বাচ্চা নাই,মানুষের চোখে নিদ নাই। নদীর বুকে পানি নাই। কেমন স্বাধীনতা? তোমার মাথার উপর থাইক্কা উড়া জাহাজের মতোন জল্লাদ পাখি তাড়াইতে পারবা, তোমার বইনের মুখ থাইক্কা লানছনা মুছতে পারবা? আমার মাথার আগুন নিভাইতে পারবা?”
পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক নারী ধর্ষণের আলোকে লেখা হয়েছে আরো কিছু নাটক। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আলাউদ্দিন আল আজাদের ’নি:শন্দ যাত্রা’(১৯৭২), ‘নরকে লাল গোলাপ’(১৯৭৪), জিয়া হায়দারের ‘সাদা গোলাপে আগুন’(১৯৮৪),’ পঙ্কজ বিভাস’ (১৯৮২), ‘শ্যামলী চৌধুরীর কথা’ (২০০৮),নীলিমা ইব্রাহীমের ‘যে অরণ্যের আলো নেই’ (১৯৭৪), মোহাম্মদ এহসানুল্লাহর ‘কিংশুক যে মরুতে’ ইত্যাদি নাটক। উল্লেখিত নাটকগুলোর মধ্যে ‘নরকে লাল গোলাপ’, ‘সাদা গোলাপে আগুন’ এবং ‘পঙ্কজ বিভাস’ বন্দিনী নারীদের মর্মযাতনা উপস্থাপনে অন্য নাটকগুলোর তুলনায় অনেক বেশী সংহত ও শিল্পসফল। ‘নিঃশব্দ যাত্রা’ এবং ’নরকে লাল গোলাপ’ নাটক দুটোতে নাট্যকার আলাউদ্দিন আল আজাদ চিত্রায়ন করেছেন যুদ্ধে নির্যাতনের কাহিনী। ‘নিঃশব্দ যাত্রা’ নাটকে নাট্যকারের নিরীক্ষাপ্রবণ মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। নাটকে দেশপ্রেমিক ছাত্রনেতা শওকত প্রেমিকা লায়লাকে ভুলে গিয়ে মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। অন্যদিকে শওকতের বন্ধু নিজাম দেশসেবার নাম করে কলকাতা থেকে শর্টকোর্সে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে বন্ধুর প্রেমিকার প্রতি আকৃষ্ট হয়। লায়লাকে পাওয়ার জন্য শওকত সম্পর্কে নানা অপপ্রচার চালায় নিজাম। মিথ্যা প্রচার ও ছলনার মাধ্যমে নিজাম লায়লাকে বিভ্রান্ত করে এবং শেষে তাকে বিয়ে করে। এ সংবাদ শুনে শওকত আহত হয় এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধে নিহত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকের মতো নিজামও দেশপ্রেমিক সেজে আত্মপ্রকাশ করে। ‘নরকে লাল গোলাপ’ নাটকে পাকিস্তানী সেনা কর্তৃক বাঙালী নারীদের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ নাটকে ধর্ষণের শিকার হয় নারী মঞ্জুরী। তার জীবনের বেদনাময় করুণ বর্ণনা রূপ লাভ করে এভাবে-’জানো, আমার শরীরটাকে আমি ঘৃণা করি। দারুণ ঘৃণা। মনে হয় টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিই।’ ধর্ষিতা নারী মঞ্জুরীকে পথিক মেজর জলিল অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সংগে গ্রহণ করেন এবং মঞ্জুরীর প্রিয় লাল গোলাপটি মাটি থেকে তুলে তিনি তার মাথার খোপায় গুঁজে দেন। বন্দিনী ও নির্যাতিত নারীদের মর্মযাতনা প্রকাশের ক্ষেত্রে আলাউদ্দিন আল আজাদের ’নরকে লাল গোলাপ’ হৃদয়স্পর্শী ও বহুমাত্রিক ঘটনাপ্রবাহের নাটক। জিয়া হায়দারের ‘সাদা গোলাপে আগুন’ এবং’ পঙ্কজ বিভাস’ নাটকে দখলদার হানাদার বাহিনী কর্তৃক চারজন নির্যাতিতা নারীর অন্তর্বেদনার কাহিনী উপস্থাপিত। নাটকে সালমা,শানু, বেলী,কুমু প্রমুখ নারী পাকিস্তানী সৈন্য কর্তৃক ধর্ষিত হন। অনাকাঙিক্ষত সন্তান জঠরে ধারণ করে অনেকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। আগামীদিনের কথা ভেবে শংকিত হয়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্ষিতা নারীকে বীরঙ্গণা উপাধি দেওয়া হলেও সত্যিকারের সামাজিক মর্যাদা তারা কেউ পায়নি। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে অবৈধ ব্যবসায় মেতে ওঠা এক শ্রেণির মানুষের জীবনের নাট্যরূপ ফুটে উঠেছে এ নাটকে। ‘সাদা গোলাপে আগুন’ নাটকটি রচিত হয় বেলীর এবং আবিদের মানবিক সম্পর্কের টানা পোড়নকে কেন্দ্র করে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতিতা বেলীর শুধু নারীর গৌরব আর অহংকারই নষ্ট হয়নি। হারিয়েছে নারীর সামাজিক মর্যাদা, প্রেমিকের বিশ্বাস আর ভালোবাসা। বেলীর এই অভিশপ্ত জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে আবিদ। বেলী এবং আবিদের যাপিত জীবনের বৈচিত্র্যময় সংকটের বহুমুখী রূপায়ণ জিয়া হায়দারের ‘পঙ্কজ বিভাস’। নাটকে বেলীর পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান রাণী আবিদের পরিচয়ে বড় হয়ে ওঠে। বেলীর সন্তান রাণীকে নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়। এমনিভাবে নানা সমস্যার আবর্তে মুখোমুখি হতে হয় তাদেরকে। হতাশা আর স্বপ্নময়ী জীবন। এই প্রেক্ষিতে আবদুল্লাহ আল মামুন রচনা করেন ’আয়নায় বন্ধুর মুখ’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’ ’তৃতীয় পুরুষ’, বিবিসাব’, ‘দ্যাশের মানুষ’ প্রভৃতি নাটক। ’আয়নায় বন্ধুর মুখ’ নাটকে যুব সমাজের হতাশা, বেকারত্ব এবং এক িমানুষের অবৈধ পথে ধনী হয়ে ওঠার কাহিনী চিত্রিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলিত জীবনের সকরুণ চিত্র মুদ্রিত হয়েছে ‘এখনও ক্রীতদাস’ নাটকে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের বিপথগামীতার বলিষ্ঠ চিত্রায়ন লক্ষ্য করা যায় ‘তোমরাই’ নাটকে। ‘তৃতীয় পুরুষ’ নাটকে স্বার্থান্বেষী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের দূরভিসন্ধির সফল রূপায়ণ আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘দ্যাশের মানুষ’। নাটকটির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবক্ষয় এবং তা থেকে উত্তরণের আকাঙক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে সবচেয়ে সার্থক ও মঞ্চসফল নাটক লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। এ প্রসংগে বিশেষভাবে স্মরণীয় তাঁর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬) শীর্ষক কাব্যনাটক। মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তিতে আসন্ন বিজয়লগ্নে গ্রামে প্রবেশ করছে মুক্তিবাহিনী। এ সংবাদে গ্রামের মাতব্বর–যে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দালালি করেছে, এমনকি নিজের কন্যাকে তুলে দিয়েছে পাকিস্তানী সেনা অফিসারের হাতে। সে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে মাতব্বরের সামনে আত্মহত্যা করে তার আত্মজা আর মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে মাতব্বরকে। এই নাটকে মাতব্বরের বুক ফাটা কান্নায়,তার অপমানিত আর্তিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ প্রান্ত হয়েছে উন্মোচিত। কাব্যনাটকের আঙ্গিকে রচিত এই নাটক আঞ্চলিক শব্দের নিপুণ ব্যবহারে যুদ্ধকালীন উত্তর বাংলার গ্রামীণ জীবনকে যেন শব্দবন্দী করে রেখেছে। ভাষার গীতময়তা, আঞ্চলিক শব্দের কুশলী প্রয়োগ এবং যুদ্ধকালীন জীবন বাস্তবতার কাব্যিক উচ্চারণে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলাদেশের নাট্য সাহিত্যে একটি পালাবদলকারী নাটক হিসেবে বিবেচিত। নাটকের সমাপ্তিতে পাইকের সংলাপে যে প্রতিশোধের বাণী উচ্চারিত তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনও প্রাসঙ্গিক–
এদিকে,এদিকে সব আসেন এখন
দেখাইয়া দিই সব কোথায় কখন
কি গজব কি আজাবে ছিল লোকজন
জালেমের হাতে ছিল যখন শাসন
শত শত মারা গেছে আত্মীয়–স্বজন।
এদিকে,এদিকে সব আসেন এখন।
দেখাইয়া দিই সব কিভাবে কখন
মেলেটারি ঘাঁটি নিয়াছিল কয়জন
যারা যারা সঙ্গে ছিল তাদের স্বজন
অবিলম্বে সারাদেশ ঘেরা প্রয়োজন
জলদি জলদি সব চলেন এখন।
সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ (১৯৮২) নাটকে যেমন নানা কৌনিক রূপায়ণ ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের, তেমনি মুক্তিযুদ্ধোত্তর সমাজবাস্তবতার। স্বাধীনতা উত্তর বিপন্ন সময় থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সৈয়দ শামসুল হক দুশো বছর পুরনো ইতিহাস থেকে তুলে এনেছেন রংপুরের বীর কৃষক নেতা নূরলদীনকে। ১৭৮৩ সালের রংপুর–দিনাজপুর অঞ্চলের সামন্তবাদ–সামাজ্যবাদ বিরোধী কৃষক নেতা নূরলদীনের সংগ্রাম আর সাহস সংক্ষোভ নিয়ে গড়ে উঠেছে সৈয়দ হকের অবিস্মরণীয় নাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’। নূরলদীনের ব্রিটিশ বিরোধিতার সংগে সৈয়দ হক অসামান্য নৈপুণ্যে মিলিয়ে দিয়েছেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের উপনিবেশবাদ বিরোধী মুক্তিসংগ্রামকে এবং এখানেই এ নাটকের কালোত্তীর্ণ সিদ্ধি।
সৈয়দ শামসুল হক মনে করেন, ১৭৮৩ কি ১৯৫২ কিংবা ১৯৭১ সালের বাঙালির জাগরণ বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। বাঙালি জাতিসত্তার এই সংগ্রামী চেতনা উপস্থাপনের জন্যই তার নূরলদীন স্মরণ। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত পয়ার ছন্দে বিন্যস্ত ব্যতিক্রমী এই কাব্যনাট্য বাংলা নাটকের ইতিহাসে সঞ্চার করেছে এক নতুন মাত্রা। ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটক প্রসংগে সৈয়দ হকের বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ’নিজেকে দেয়া অনেকগুলো কাজের একটি এই যে, আমাদের মাটির নায়কদের নিয়ে নাটকের মাধ্যমে কিছু করা, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ লিখে তার সূত্রপাত করা গেল। যে জাতি অতীত স্মরণ করে না, সে জাতি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে না। এই কাব্যনাটকটি লিখে ফেলার পর আমার আশা এই যে,এই মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন এমন সেসব গণনায়কদের আমরা ভুলে গিয়েছি।তাদের আবার আমরা সম্মুখে দেখব এবং জানব যে,আমাদের গণআন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের ও অনেক বড় মহিমার–সবার উপরে, উনিশশ’ একাত্তরের সংগ্রাম কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।’ বাঙালী জাতিসত্তার এই সংগ্রামী চেতনা,এই প্রতিরোধ বাসনা,এই জীবন–মৃত্যু বাজি রেখে আপন মৃত্তিকায় সোজা হয়ে দাঁড়াবার ধারিাবাহিকতা নূরলদীনের শেষ সংলাপে উদ্ভাসিত–
এ দ্যাশে হামার বাড়ি উত্তরে না আছে হিমালয়
উয়ার মতন খাড়া হয় য্যান মানুষের হয়।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি দক্ষিণেতে বংগপসাগর,
ইয়ার মতন গর্জে উঠে য্যান মানুষের স্বর।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র আছে
উয়ার মতন ফির মানুষের রক্ত য্যান নাচে।
এ দ্যাশে হামার বাড়ি পশ্চিমেতে পাহাড়িয়া মাটি
উয়ার মতন শবত হয় য্যান মানুষের ঘাঁটি।
মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক আরো দুটি নাটক সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেন। ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ এবং ‘এখানে এখন’। ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ নাটকের পটভূমি বর্তমান সময় হলেও মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল দিনগুলো এতে উপস্থাপিত। নাট্যকার ফ্ল্যাশব্যাকের মধ্য দিয়ে বর্ণনা করেছেন যুদ্ধকালীন সময়ের জীবনচিত্র। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের একাকী সংগ্রামের কাহিনী এ নাটকে বিধৃত হয়েছে। সৈয়দ হকের ‘এখানে এখন’ কাব্যনাটকে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ–অনুসঙ্গ এসেছে চমৎকারভাবে। স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে যুদ্ধোত্তর সমাজ বাস্তবতা এ নাটকে পরিস্ফূট। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের আর্থ–সামাজিক অবস্থা, ক্ষমতার দম্ভ,হত্যা,ক্যু প্রভৃতি সাধারণ মানুষের জীবনকে করে তুলেছে অতিষ্ঠ। নাট্যকার সুলতানার জবানীতে তার বাস্তবসম্মত রূপ ঘটান এভাবে–
স্বাধীনতা এসেছে থেকেই দেখো
মানুষের মনে স্বস্তি নেই–এ স্বাধীনতা নিয়েই
চিনির ভেলায় তুমি কালো পিঁপড়ে ছাড়লেতো ফের
লাল পিঁপড়ে সারে সার দেখা দিচ্ছে পর মূহুর্তেই
সেটাতো আছেই,আর মানুষের কথা ভেবে দ্যাখো–
জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে ধাঁ ধাঁ করে,বাড়ছেই,
——————————————
রাষ্ট্রপতিকে যে দেশে ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে
হয়,প্রধানমন্ত্রীর ঘরে চুরি হয়, সেই দেশে,
নাগরিক স্বাভাবিক সব ভাববে কি ভাবে?
ক্ষমতা বন্দুকবাজি, খুনী পেয়ে যায় পুরস্কার,
মানুষ বাঁচতে পারে?-এই যদি হয় বর্তমান?
মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসংগ–অনুষঙ্গ নিয়ে আমাদের অন্য যে সব নাট্যকার নাটক লিখেছেন তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সাঈদ আহমদের ‘প্রতিদিন একদিন’ (১৯৭৮),কল্যাণ মিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’ (১৯৭২), ‘একটি জাতি একটি ইতিহাস’ ((১৯৭২),আল মনসুরের ‘হে জনতা আর একবার’ (১৯৭৪),রণেশ দাশগুপ্তের ‘ফেরী আসছে’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘ঘুম নেই’ (১৯৭৪), হুমায়ুন আহমদের ‘১৯৭১’ (১৯৯২),শান্তনু বিশ্বাসের ‘ইনফরমার’ (২০০২), মান্নান হীরার ‘জননী বীরাঙ্গনা’ (১৯৯৬), ‘একাত্তরের রাজকন্যা’(১৯৯৬), ‘ফেরারী নিশান’ (১৯৯৬), এস এম সোলায়মানের ‘ ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল’(২০০৪),তৌফিক হাসান ময়নার ‘যুদ্ধ স্বাধীনতা’ (২০০৪), সাইফুর রহমান মিরনের ‘এখানে এখনো’ (২০০৪), প্রদীপ দেওয়ানজীর ‘দাবি’(২০০৪),দীপক চৌধুরীর ‘স্বাধীনতার ময়না তদন্ত’(২০০২), শোভনময় ভট্টাচার্যের ‘একাত্তরের তেলেসমাতি’(১৯৮৮) ইত্যাদি। এসব নাটকে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের নানা খণ্ডচিত্র চিত্রায়িত হয়েছে কখনো আবেগী ভাষ্যে,কখনো বা শিল্পিত পরিচর্যায়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে কয়েকটি টেলিভিশন নাটক লিখেছেন হুমায়ুন আহমেদ, রাবেয়া খাতুন, মঈনুল আহসান সাবের এবং ইমদাদুল হক মিলন। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনেক নাটক রচিত হলেও আমরা এখনো কালজয়ী সৃষ্টি পাইনি,যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির সম্মিলিত চৈতন্যের জাগরণকে যথাযথভাবে চিত্রিত করতে সক্ষম হয়েছে। এরপরও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আমাদের কবি–সাহিত্যিকদের মধ্যে ভাবনার অন্ত নেই। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতিফলন ঘটেছে, তা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্রধারার সাহিত্য–মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য রচনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমানে যেমন মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে সাহিত্য রচিত হচ্ছে, তেমনি ভবিষ্যতেও রচিত হবে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম। হয়তো একদিন আমাদের নাট্যকারদের হাতে সৃষ্টি হবে আরো শিল্পসফল ও কালোত্তীর্ণ মুক্তিযুদ্ধের নাটক যা বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে নতুনরূপে নতুন মর্যাদায় চিনিয়ে দিতে পারবে।
(সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি