![শুভ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই পারবে উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছে দিতে](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/20/gaffer_131260.jpg)
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ২০ মার্চ, এবিনিউজ : চরম দুঃসংবাদের পরপরই একটি পরম সুসংবাদ। ঢাকা থেকে নেপালগামী একটি বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ায় অসংখ্য বাঙালি ও অবাঙালি যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে দেশ যখন শোকস্তব্ধ, তার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মদিনে এলো পরম সুসংবাদ—বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (Least Developed Country) দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল (Developing) দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা ও স্বীকৃতি অর্জন করেছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ঘোষণা দিয়েছে।
আমি অর্থনীতিবিদ নই। সুতরাং একজন সাধারণ মানুষের মতো এটা বুঝতে পারি, হাসিনা সরকারের আমলে এটা দেশের জন্য একটি বিরাট অর্জন। কতটা বিরাট অর্জন তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। আমাদের তরুণ অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান কালের কণ্ঠ পত্রিকাতেই (১৭ মার্চ) ‘জয়তু উন্নয়নশীল বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে এই অর্জনের সাফল্য দেশটাকে কত দ্রুত উন্নত (Developed) দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাবে, তা বিশ্লেষণ করেছেন। হাসিনা সরকারের প্রতিশ্রুতিও তাই।
গণতন্ত্রহীন দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, স্বাধীনতার শত্রু ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদান, জঙ্গিবাদ দমন, একটি স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে দেশটিকে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছানো এবং দ্রুত উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর চেষ্টা একটি সরকারের জন্য কম কৃতিত্বের ও সাফল্যের পরিচায়ক নয়।
দেশটির এই সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘেরও চোখে পড়েছে। কিন্তু চোখে পড়ছে না আমাদেরই একটি তথাকথিত সুধীসমাজের। এই সুধীসমাজের একজন পৃষ্ঠপোষক ড. ইউনূস যখন অর্ধেক নোবেল শান্তি পুরস্কার (যে শান্তি স্থাপনে তাঁর কোনো অবদান নেই) পান, তখন চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘আমরা আজ আনন্দের এভারেস্টে আরোহণ করেছি।’ সে যাই হোক, নোবেল পুরস্কার লাভ ছিল একজন ব্যক্তির সাফল্যের স্বীকৃতি। আর ১৭ মার্চ জাতিসংঘের কাছ থেকে বাংলাদেশ যা পেল তা একটি দেশ ও জাতির অত্যল্পকালের মধ্যে অভাবনীয় সাফল্যের স্বীকৃতি। সুতরাং এক ব্যক্তির অর্ধ-নোবেল পুরস্কার অর্জনে যদি আনন্দের এভারেস্টে আরোহণ করতে হয়, তাহলে দেশটির এই পরম গৌরবময় অর্জনে, ব্যক্তি নয়, গোটা জাতির, এই সাফল্যে আমাদের কোন এভারেস্টে আরোহণ করা উচিত?
এই সুধীসমাজের অন্যান্য নেতা (ড. কামাল হোসেনসহ) এবং তাঁদের ‘নিরপেক্ষ’ মুখপত্র দুটি তো হাসিনা সরকারের কোনো ভালো কাজই দেখতে পায় না। দেশে সুশাসন নেই, আইনের শাসন নেই, মানুষের জীবনে স্বস্তি নেই, শান্তি নেই, বাক্স্বাধীনতা নেই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই—এই নেই নেই চিৎকারেই তারা চারদিক মুখরিত করে রেখেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ড. কামাল হোসেন মস্কোতে গিয়ে এক আলোচনাসভায় বলেছিলেন, ‘একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা দেশ দখল করেছে।’ কী আশ্চর্য, ড. কামাল একসময় যাদের ‘একাত্তরের পরাজিত শত্রু’ আখ্যা দিয়েছিলেন, এখন তিনি ও তাঁর সুধীসমাজ সেই পরাজিত শত্রুদেরই কোনো কোনো প্রচারণা নিজেদের কণ্ঠে ধারণ করেছেন।
আমি হাসিনা সরকারের অন্ধ সমর্থক নই। তারা মন্দ কাজ করলে তাদের সমালোচনা করি এবং এক শ্রেণির আওয়ামী লীগ নেতার ক্রোধের কবলে পড়ি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্য এই যে আওয়ামী লীগ অনেক সময় বড় ভুল করে, গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে আর বিএনপি জেনে-শুনে বড় বড় অন্যায় করে, গণতন্ত্রকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা চালায়। অনেক নাস্তিক যেমন বিপদে পড়লে আল্লাহর নাম স্মরণ করে, বিএনপিও তেমনি বিপাকে পড়লে গণতন্ত্রের নাম নেয়।
এই মুহূর্তে দেশপ্রেমিক মানুষের সামনে আওয়ামী লীগ ছাড়া বিকল্প কী আছে? আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। আবার সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করেছে এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছে। সেই গণতন্ত্র কানা-খোঁড়া যাই হোক। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়েছে, মৌলবাদের উত্থান ঠেকিয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে যতটা সম্ভব রক্ষা করেছে।
গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে ভিত্তি করে আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনো দল গড়ে উঠলে তাকে অভিনন্দন জানাতাম। কিন্তু তা তো গড়ে ওঠেনি। সুধীসমাজ তো চেষ্টা করেছিল। পারল না কেন? বিকল্প গড়ার নামে তারা স্বাধীনতার পক্ষের শিবিরে আরো বিভক্তি এনেছে। হাসিনাবিদ্বেষ ও আওয়ামী লীগবিদ্বেষে ভুগে তারা গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের শত্রুদের বাহুতে শক্তি জুগিয়েছে। দেশে নির্বাচন হলে এই সুধীসমাজ ক্ষমতায় যেতে পারে না। তাদের কোনো কোনো শীর্ষ নেতার জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়। আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে জয়ী হয় বিএনপি-জামায়াত। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তি ভাঙার চেষ্টা শুরু হয়।
আগামী সাধারণ নির্বাচনে তাই সর্বান্তঃকরণে আওয়ামী লীগ জোটের জয় কামনা করি। তাতে গণতন্ত্রের গায়ে যদি একটু ধুলো লাগে লাগুক, কিন্তু গণতন্ত্রের চরিত্র বাঁচবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী না হলে সুধীসমাজের দ্বারা গঠিত কোনো বিকল্প গণতান্ত্রিক জোট ক্ষমতায় আসবে না। আসবে ড. কামাল হোসেনের দ্বারা বর্ণিত ‘একাত্তরের পরাজিত শক্তি’। দেশে আবার শুরু হবে গ্রেনেড হামলার যুগ, হাওয়া ভবন তৈরি করার যুগ। বাংলা ভাইদের উত্থানের যুগ। ইমেলদা ও ইসাবেলাদের স্বৈরশাসনের যুগ। আমাদের একটি সুধীসমাজ ও তাদের ‘নিরপেক্ষ’ দুই পত্রিকা তাই চায় কি?
সারা বিশ্বেই আজ নেতৃত্ব সংকট চলছে। নইলে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না। টেরেসা মে হতে পারতেন না ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ও হোয়াইট হাউসে চলছে নৈরাজ্য, পদত্যাগের হিড়িক। ট্রাম্প বিশ্বের সুপারপাওয়ারের নেতার পদ থেকে উত্তর কোরিয়ার ‘লিটল রকেটম্যান’ কিমের প্রতিযোগীর ভূমিকায় নেমে এসেছেন। টেরেসা মে সংখ্যালঘু সরকারের প্রধানমন্ত্রী ‘ব্রেক্সিট প্রশ্নে তাঁর দল ও দেশও দ্বিধাবিভক্ত, দেশের রাজনীতিও স্থিতিশীল।
ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে সাম্প্রদায়িক বিজেপি দলের উত্থান এখন অপ্রতিরোধ্য। বাম গণতান্ত্রিক শক্তির শেষ দুর্গ ত্রিপুরারও পতন হয়েছে। তাতে ভারতেরও সুধীসমাজেরও একটা বড় অংশের ভূমিকা বিস্ময়কর। তারা বিজেপি-নেতাদের নান্দীপাঠে ব্যস্ত। চলছে গান্ধী, নেহরুর মতো অসাম্প্রদায়িক জাতীয় নেতাদের চরিত্র হরণ। গান্ধী-হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে বানানো হচ্ছে জাতীয় বীর। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম মৌলবাদীদের কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় টিকে আছেন। এই মৌলবাদীদের তুষ্ট রাখার জন্য তিনি হাসিনা সরকারের সঙ্গে তিস্তা নদীর বিরোধটি টিকিয়ে রেখেছেন।
এই বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব ও নীতি সংকটের যুগে বাংলাদেশের জন্য একটি স্বস্তি এই যে শেখ হাসিনার মতো এক নারীর নেতৃত্বে প্রাচীন গণতান্ত্রিক দলটি এখনো ক্ষমতায় টিকে আছে এবং দেশটাতে নেতৃত্ব সংকট দেখা দেয়নি। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে এবং তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠেছে। এখনো দেশটিতে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস সবই আছে। কিন্তু এসব শত্রুকে পরাজিত করার লক্ষ্যে দেশটি এগিয়ে চলেছে। তার গতি হয়তো ধীর, কিন্তু দেশটি লক্ষ্যে স্থির।
কিছুদিন আগে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, দেশে আইনের শাসন নেই, বাক্স্বাধীনতা নেই, নাগরিক জীবনে শান্তি ও স্বস্তি নেই। তিনি কি বলতে পারবেন, নিরঙ্কুশ স্বস্তি-শান্তি পৃথিবীর কোন দেশে এখন আছে? আর বাংলাদেশে যদি এসবের কিছুই না থাকে, তাহলে অতীতের এত শোষণ-লুণ্ঠনের মধ্যে দেশটি কিভাবে দুই দিন আগের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছতে যাচ্ছে? এবং এখন এই আশা জাগ্রত যে দেশটি হাসিনা সরকারের নেতৃত্বেই অদূর ভবিষ্যতে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছবে।
রবীন্দ্রনাথ যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান, তখন চীনের কাগজে পর্যন্ত বলা হয়েছিল, এটা শুধু ভারতের নয়, সারা এশিয়ার গৌরব। বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মানবতার জননী থেকে শুরু করে নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রদূত পর্যন্ত যত উপাধি ও খেতাব পেয়েছেন, তা কোনো ব্যক্তি বা দলের সম্মান নয়, পুরো জাতির সম্মান ও গৌরব। জাতির এই সম্মান ও গৌরবে দল-মত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষের শরিক হওয়া দরকার। দেশের রাজনীতিতে যেকোনো অশুভ শক্তির আগ্রাসন ঠেকানোসহ যে সরকারের আমলে দেশ রাজনৈতিক স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, তার হাত শক্তিশালী করা দরকার।
দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দ্বারাই নির্ধারিত হওয়া উচিত। কোনো অপশক্তির চক্রান্ত দ্বারা এটা হওয়া উচিত নয়। আমাদের সুধীসমাজ কোনো অশুভ গোপন শক্তির সহায়তাকারী হওয়ার বদলে শুভ রাজনৈতিক শক্তির শুভ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সহযোগী হোক। ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই পারবে দেশটাকে সব সংকটমুক্ত করতে এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে। (কালের কণ্ঠ)
লন্ডন, সোমবার, ১৯ মার্চ ২০১৮