![বাংলাদেশে বাধার মুখে চীনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/25/afsan-si_132089.jpg)
আফসান চৌধুরী, ২৫ মার্চ, এবিনিউজ : বাংলাদেশে চীনের তিনটি বড় প্রকল্প বাধার মুখে পড়েছে। কিছু সমস্যা মারাত্মক, কিছু রুটিন সমস্যা। অনেকেই মনে করতে পারেন বাংলাদেশে চীনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো অ-অর্থনৈতিক কারণে সমস্যায় পড়ছে। এ রকম ধারণা রয়েছে যে, বাংলাদেশে চীনের যাত্রাটা মসৃণ না হওয়ার একটা কারণ হলো রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন মিয়ানমারকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে অনেকেই মনে করেন।
অন্য একটি বিষয় হতে পারে ভারতকে ভুল ইঙ্গিত পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের অনীহা। যে দেশটি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের এবং বহুমুখী সহযোগী হিসেবে টিকে আছে এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাসও রয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন যখন এগিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন দলকে তার সব বন্ধুর জন্যই একটা ইমেজ ধরে রাখতেই হবে যাতে কোন সমস্যা না হয়।
বাংলাদেশে তিনটি প্রকল্পে সবচেয়ে ধনী বিনিয়োগকারী সমস্যায় পড়ার পর চীনা বিনিয়োগের অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সবচেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা হলো ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কৌশলগত অংশীদার হওয়ার জন্য চীনের প্রচেষ্টা। এই যাত্রাটা মসৃণ হবে বলেই মনে করা হয়েছিল, কারণ চীন যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটা আরেক দরদাতা ভারতের চেয়ে যথেষ্ট বেশি ছিল। কিন্তু সরকারী নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), যেটার নিয়ন্ত্রণ করেন অর্থমন্ত্রী, তারা এই দরপত্র নিয়ে উদ্বেগ জানায়। যে কারণে স্টক মার্কেট ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত ডিএসই চীনকে এখানে নিতে পারেনি।
মিডিয়া সূত্রগুলো ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছে যে, ভারত সরকারকে এই দরপত্রের বিষয়টি প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে যদিও এখানে সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু এ ধরনের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে ভারত ও চীনের মধ্যে অর্থনীতির বাইরেও কিছু দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলো অবশ্য চীনের জন্য যথেষ্ট অনুকূল। মিডিয়াগুলো বলছে যে, বিএসইসি যে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে, চীনা বিনিয়োগকারীদের কনসোর্টিয়াম সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং পরিস্থিতি এখন অনেকটাই শান্ত মনে হচ্ছে।
আরও দুইটি বড় চীনা চুক্তি ব্যর্থ হয়েছে এবং কাজ থমকে গেছে। একটা হলো বাংলাদেশে শেভরনের গ্যাস নিষ্কাষণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দরকষাকষি। অন্যটি হলো সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরে চীনের বিনিয়োগ। শেভরন তাদের প্রস্তাব উঠিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে, সোনাদিয়া প্রস্তাবের কাজও এগুচ্ছে না।
শেভরন ও সোনাদিয়া
শেভরন এখান থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ তাদের মনে হয়েছে বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের সে সম্ভাবনা ছিল, গ্যাস রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সেই সম্ভবনাটা কমে গেছে। শেভরন এই প্রস্তাবটি চীনের একটি প্রাইভেট কোম্পানি হিমালয়া কো’কে হস্তান্তরের চেষ্টা করছে এবং এটা নিয়ে আলোচনা চলছিল। কিন্তু জানা গেছে যে বাংলাদেশের জ্বালানি কোম্পানি পেট্রোবাংলা শেভরনকে বুঝিয়েছে যাতে তারা যেন চলে না যায় এবং এ কারণে চীনা কোম্পানিটি আর এগুতে পারেনি।
শেভরন কেন ফিরে এসেছে, সেটা একটা ধাঁধাঁ কারণ পরিস্থিতি কিছুই বদলায়নি। তাছাড়া নতুন কোন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধানও মেলেনি। কিভাবে এই সিদ্ধান্ত হলো সে ব্যাপারে মুখ খোলেনি সরকার। এগুলো নিয়ে আলোচনাও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেকে বলেন, জ্বালানি খাতে ভারতের অসন্তোষের মুখে পড়েছে চীন এবং এ ব্যাপারে চাপ দিয়েছে ভারত, যদিও এ ব্যাপারেও কোন তথ্য প্রমাণ দেয়া হয়নি। এগুলো সবকিছুই এক ধরনের গুজব। কিন্তু চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে ইতিবাচক অনুমোদন দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের যে কিঞ্চিৎ অনীহা এবং এইসবকিছুকে ঘিরে যে অব্যাহত গুজব ছড়িয়ে আছে, সেগুলোকে অগ্রাহ্য করাটা কঠিন।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প থমকে গেছে যদিও বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে ২০১০ সালে সহায়তা চেয়েছিল এবং ২০১২ সাল পর্যন্ত যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছিল কাজের। কিন্তু ২০১৪ সালে একটা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা ছিল, যেটা হয়নি এবং এরপর থেকেই কাজের গতি কমে গেছে। কিন্তু ২০১৭ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করার পর, যেটা ছিল সিনো-বাংলা সম্পর্কের সুবর্ণ সময়, এখানে অ-অর্থনৈতিক বিবেচনাগুলো কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কিছু জল্পনা-কল্পনার এতে অবসান হয়নি।
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে?
এটা পরিস্কার যে, সার্বভৌম বাণিজ্যিক সহযোগিদের সাথে জটিল দর কষাকষির ব্যাপারে বাংলাদেশের তেমন ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নেই। অতিরিক্ত সতর্কতা গ্রহণ না করে বাংলাদেশ এগুতে পারে না। কিন্তু এই বিলম্ব অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা দিচ্ছে। যদি এটা দেখা যায় যে বাংলাদেশ মেগা চুক্তিগুলো নিয়ে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রস্তাবের সংখ্যা কমে যাবে।
এ ধরনের বিলম্বের পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে চীনের স্টকের যে পতন হয়েছে, এটা গোপন কোন বিষয় নয়। এটাকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এখানে চীনের ভূমিকা নিয়ে কর্মকর্তারা অখুশি। শরণার্থী সঙ্কট সরকারী আমলাদের বিশেষভাবে আঘাত করেছে। সঙ্কটের কারণে মনে হচ্ছে তারা এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। তাই, চীনের ব্যাপারে তারা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে, যেটা বোঝা যায়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে চীনের ভূমিকা ব্যাপক। কিন্তু এগুলো অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণ সম্পর্কিত চুক্তির অংশ, যেগুলো ব্যবস্থাপনা করা সহজ। তবে, চীন অবশ্যই বাংলাদেশে কৌশলগত বিনিয়োগ করতে চাইবে। কিন্তু এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকারের প্রতিক্রিয়া খুবই ধীরগতির।
চীন মূলত বাংলাদেশের ব্যবসায়ী শ্রেণীর মধ্যে নিজেদের অবস্থানকে সংহত করেছে। কিন্তু তাদের সামাজিক যোগাযোগ যথেষ্ট কম। বাণিজ্যিক জগতের বাইরে খুব কম বন্ধুই আছে তাদের। এর সাথে, মিয়ানমার নীতি চীনকে আরও অপছন্দনীয় করে তুলেছে।
বাংলাদেশে চীনের জনপ্রিয়তা নির্ভর করে ভারতের প্রভাবের বিপরীতে তাদের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতার উপর। কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কটের পর কিছু অস্পষ্ট পুনর্বিবেচনা করা হয়েছে। সে কারণে বিস্তৃত ও বড় ভারতীয় চক্র তাদের প্রভাব খাটানোর সুযোগ পেয়ে গেছে। ভারত জানে যে তারা চীনের ‘বিনিয়োগকারী ডলারের’ মোকাবেলা করতে পারবে না, কিন্তু রোহিঙ্গাদের আগমনের পর থেকে অ-অর্থনৈতিক চাপের জায়গাগুলো ভারতের পক্ষে সক্রিয় হয়েছে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চীন।
ঘটনা ঘটছে আবার থমকে যাচ্ছে কিন্তু এর সাথে সম্ভবত শুধু অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত নয়।
লেখক: কলাম লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক