![‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/26/moktomot_132130.jpg)
তোফায়েল আহমেদ, ২৬ মার্চ, এবিনিউজ : ১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চ ছিল শুক্রবার। পঁচিশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর মনি ভাই রওনা দিই সেগুনবাগিচার দিকে। রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে যখন যাই তখন সংগ্রামী জনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে। সেগুনবাগিচায় একটা প্রেসে স্বাধীনতার ঘোষণাসংবলিত লিফলেট ছিল। সেই লিফলেট নিয়ে যাব ফকিরাপুলে মনি ভাইয়ের বাসায়। প্রেস পর্যন্ত গেলাম, লিফলেট নিলাম। রাস্তায় ব্যারিকেড থাকার কারণে গাড়ি রেখে অগত্যা হেঁটেই রওনা দিলাম। রাত ১২টায় মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী শুরু করেছে ইতিহাসের পৈশাচিকতম হত্যাকাণ্ড বাঙালি নিধনে গণহত্যা। চারদিকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ছাপিয়ে তখন আমার কানে কেবলই বাজছে বিদায়বেলায় বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ, ‘তোমাদেরকে যে দায়িত্ব আমি দিয়েছি, সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করো। আমার জন্য ভেবো না। আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, আমার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। ওরা অত্যাচার করবে, নির্যাতন করবে। কিন্তু আমার বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’
মার্চের ২৬ তারিখ প্রথম প্রহরেই ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। এ অবস্থার মধ্যে রাতেই খবর পেলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৭ মার্চ যখন দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করা হয় তখন আমি আর মনি ভাই জহিরুল ইসলাম সাহেবের বাসায় যাই। সেখান থেকে আমাদের ব্যাগ নিয়ে এ ইউ আহমেদের একটা ফোকসভাগেন গাড়িতে চেপে গুলিস্তান দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে সদরঘাট গিয়ে কেরানীগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করি। পেছনে পড়ে থাকে ধ্বংস আর মৃত্যু উপত্যকাসম রক্তাক্ত ঢাকা নগরী। এরপর কেরানীগঞ্জে বোরহানউদ্দীন গগনের বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিই। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, মনি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, আমি, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজসহ আমরা অনেকেই তখন সেই বাড়িতে। সকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান সাহেব এবং আমাদের অন্য নেতারা বিরামহীনভাবে ঘোষণা দিতে থাকেন যে ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।’ এরপর সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়।
টানা ২৪ দিন ধরে চলা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে অবশেষে গণহত্যার দিকে এগিয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া এবং চক্রান্তকারী পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুুট্টো। ২৫ মার্চ জিরো আওয়ারে গণহত্যা শুরুর পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন!’ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী রাত ১২টায় পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকার চারটি স্থানকে টার্গেট করে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তাঁর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো পূর্বেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’ স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে তিনি আরো লিখেছেন, “ঘোষণায় বলা হয়, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’”
প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এ রকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়ার উত্তুঙ্গ অবস্থায় পৌঁছতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দীর্ঘ ২৪টি বছর নিজেকে, দলকে এবং বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসতে হয়েছে। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণাটিই ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬ নং প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে।
১৯৭১ সালের মার্চের ১ তারিখে দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ স্থগিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভুট্টো এবং জেনারেলদের মধ্যকার ঐকমত্য জনসাধারণে প্রকাশিত হলো। এ রকম একটি ষড়যন্ত্র হতে পারে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু আগেই আমাদের ধারণা দিয়েছিলেন এবং তাঁর অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার করে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পূর্বপ্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এহেন বক্তব্যে তাত্ক্ষণিক ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। বেলা ৩টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদসভা হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় যোগদান করি। পল্টন ময়দান তখন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে বক্তৃতায় বলি, ‘আর ছয় দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ এক দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই এক দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলাম—বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’
বাঙালির ইতিহাসের পরমাকাঙ্ক্ষিত দিন ৭ মার্চ। সেদিন ছিল রবিবার। বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে দুর্গম পথের প্রান্তে অতুলনীয় স্মৃতিফলক এই দিনটি। সংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। কারো চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় প্রভুত্ব মেনে নেওয়ার জন্য, কারো কলোনি বা করদরাজ্য হিসেবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নি। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নেমেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যাঁরা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যাঁরা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত পুরনারী, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কচি-কিশোর, তরুণ-যুবক, কৃষক-শ্রমিক জনতার চোখেমুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগ্নিশিখা দেখেছিলাম, তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির পর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে তুমুল করতালি ও স্লোগানের মধ্যে তাঁকে বীরোচিত অভিনন্দন জ্ঞাপন করে।
বঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা শুরু করলেন জনসমুদ্র যেন প্রশান্ত গাম্ভীর্য নিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে গেল। এত কোলাহল, এত মুহুর্মুহু গর্জন নিমেষেই উধাও। আবার পরক্ষণেই সেই জনতাই সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উচ্চকিত হয়েছে মহাপ্রলয়ের উত্তাল জলধির মতো, যেন জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার। ৭ মার্চের রেসকোর্স বাংলার মানুষকে শুনিয়েছে স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র। সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিশপথে ভাস্বর, যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত সভাস্থলের প্রতিটি নিরস্ত্র মানুষ যেন সেদিন সশস্ত্র হয়ে ওঠে; তাদের চোখমুখ শত্রুর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের অপার মহিমায় আলোকিত হয়। নেতার বক্তৃতার শেষাংশ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, বস্তুত এটাই ছিল বীর বাঙালির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা।
আজ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিসংঘের ইউনেসকো ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। দেশকে স্বাধীন করে জাতির পিতা তাঁর জীবনের প্রথম লক্ষ্য পূরণ করেছেন। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় লক্ষ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, যা তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। সেই লক্ষ্য পূরণ হতে চলেছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। আজ আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশকে তিনি উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। আজ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি। এরই মধ্যে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা যে প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছি তার স্বীকৃতির সনদ দিয়েছে। সুতরাং এই বছরে স্বাধীনতা দিবসের আনন্দঘন ক্ষণে গভীরভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মনে পড়ে। তাঁর সেই স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হয়ে তাঁরই পরমারাধ্য স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলেছে। (সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ)
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার