
কামরুল হাসান বাদল, ২৬ মার্চ, এবিনিউজ : দেশভাগ উপমহাদেশের একটি ক্ষতের নাম। এ ঘটনা মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য দুটো আলাদা রাষ্ট্র করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ইতিহাসে সে এক নির্মম অধ্যায়।
দেশভাগের সবচেয়ে বেশি দাম দিতে হয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবকে। কারণ এই প্রদেশ দুটিও হিন্দু-মুসলিমের ভাগাভাগির কোপে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। এরফলে এই দুই অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ দাঙ্গা। বেশি নির্মমতা ঘটেছিল পাঞ্জাবে। বাংলা ও পাঞ্জাবে লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। বাস্তুহারা হয়েছিল কোটি মানুষ। ব্রিটিশরা যাওয়ার সময়ে এই উপমহাদেশের মানুষকে ফেলে গিয়েছিল এক অমানবিক পরিস্থিতিতে। সে হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো উপমহাদেশের শুভবৃদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিল। সে রক্তক্ষয়ী ঘটনা, দাঙ্গা নিয়ে পরবর্তীতে অনেক বিখ্যাত লেখক সৃষ্টি করেছেন অমর কথাসাহিত্য। রাজেন্দ্র সিং বেদি, খাজা আহামদ আব্বাস, কৃষণ চন্দর, সা’দত হাসান মান্টো, আহামদ নাদিম কাসমী, ইসমত চুগতাই, কুররাতুল আইন হায়দার, কুদরত উল্লাহ শাহাব, রাম লাল প্রমুখ তাঁদের লেখায় তুলে ধরেছিলেন সেসব নির্মম অধ্যায়গুলো। কিছু ছবিও নির্মাণ হয়েছে সেসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করার সাথে সাথে আরেকটি মানবিক বিপর্যয় ঘটেছিল তবে তা অত্যন্ত নীরবে এবং অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে। কিংবা প্রকাশ্যে হলেও তা নিয়ে তেমন কেউ ভাবেনি, কিংবা ভাববার অবকাশও পায়নি। এর পেছনে সামান্য ঘৃণা বা এক প্রকার প্রতিশোধ স্পৃহাও কাজ করেছিল বোধহয়। ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় প্রায় উচ্ছিষ্টের মতো এদেশে ফেলে গিয়েছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের। যারা নিজ দেহে বহন করতো একই সাথে ভারতীয় ও পশ্চিমা রক্ত প্রবাহ। এরা ধর্মে ছিল খ্রিস্টান, পোশাক পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ছিল পশ্চিমাদের প্রভাব। কথা বলতো ইংরেজিতে। শোণিতে উপমহাদেশের রক্ত প্রবাহিত হলেও এরা নিজেদের ব্রিটিশ প্রভুদের মতোই ভাবতো, কুলীন ভাবতো। ফলে সাধারণ ভারতীয় এমনকি ধর্মান্তরিত এদেশীয় খ্রিস্টানদের থেকেও তারা নিজেদের আলাদা ভাবতো। ব্রিটিশরা এদের ফেলে যাওয়ায় ’৪৭এর পর এদের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ। ভারত জুড়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর দুঃখগাথা, জীবন ও অসহায়ত্ব নিয়ে ভারতে সামান্য লেখালেখি হলেও বাংলাদেশে হয়েছে অতি সামান্য। কারণ উপমহাদেশের এই প্রান্তিক অঞ্চলে অ্যাংলোদের বেশি বসবাসও ছিল না। তবে চট্টগ্রাম নগরীর আলকরণ, পাথরঘাটা এলাকায় প্রচুর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, যারা মূলত পর্তুগিজদের উত্তরাধিকার, বসবাস করতো। তাদের স্থানীয়রা ফিরিঙ্গি নামে অভিহিত করতো। শুধু এ কারণে ওই এলাকার নামও হয়ে ওঠে ফিরিঙ্গিবাজার।
উপমহাদেশে ইংরেজদের আগে আগমন ঘটেছিল পর্তুগিজদের। পাথরঘাটা গির্জা তৈরি করেছিল পর্তুগিজরা।
‘পর্তুগিজ জলদস্যু’ ইতিহাসে তাদের এভাবেই চিনেছি আমরা। পরীর পাহাড়, আজ যেটি কোর্টবিল্ডিং সেখানে একসময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল বলে ইতিহাসে পাই। পর্তুগিজরা এদেশে বসবাসও করেছে, স্থানীয়দের সাথে সম্পর্ক গড়ে সংসারও করেছে। তাদেরই উত্তরাধিকার এই ফিরিঙ্গী বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা।
এই দীর্ঘ ভূমিকাটি দিতে হলো বইমেলায় প্রকাশিত বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাস ফুটো সম্পর্কে বলতে গিয়ে। কারণ এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান তরুণীর সঙ্গে বাঙালি মুসলমান তরুণের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। আর তাতে উঠে এসেছে ফিরিঙ্গীদের জীবন, সংস্কৃতি, অবস্থান ও নানা প্রসঙ্গ। অনেকটা ত্রিভুজ প্রেমের গল্প হলেও উপন্যাসে প্রেম ছাড়াও স্থানীয় জনগণের জীবন, সংস্কৃতি, টানাপোড়েন, সামাজিক বন্ধন এবং অবক্ষয় অনেক কিছু উঠে এসেছে। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্রের নাম মোমিনুল। পুরনো শহরের অধিকাংশ তরুণের মতো তার বেড়ে ওঠা। কৈশোরে দুরন্তপনা, তারুণ্যে ও যৌবনে উম্মাতাল আচরণ আর একটু বয়স হওয়ার পর শান্ত ও থিতু হওয়ার প্রবণতা সবকিছুই আছে তার মধ্যে। মেরি মেয়েটি খ্রিস্টান। চলাফেরায় মুক্ত ও বাধাহীন। ভালোবাসে আরেক অ্যাংলো এলেন রিবেরুকে। মোমিনুল মেরির কলিগ এবং প্রতিবেশি ভাড়াটিয়া। মোমিনুলের সঙ্গে মেরির সম্পর্ক ভালোবাসা বা প্রণয়ের নয়, তবে নিখাঁদ এক বন্ধুত্বের। কিংবা এরচেয়ে কিছুটা বেশি, কখনো মনে হতে পারে তা ব্যাখ্যাতীত।
একটি বড় কোম্পানিতে এমডির পিএস হিসেবে চাকরি করে মেরি। একসময় মেরি খুন হয় আর সে খুনের মামলায় জড়িয়ে যায় মোমিনুল। উপন্যাসটি শেষ হয় খুনের রহস্যটি পুরোপুরি উন্মোচন না করেই। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারটি লেখক পাঠকদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী একাধারে কবি, সাংবাদিক, কলাম লেখক ও কথাসাহিত্যিক। তবে যাই লেখেন তা সহজ এবং সাবলীল ভাষায় লেখেন। চিন্তা এবং দুর্বোধ্য শব্দে ও ভাবনায় তাকে ভারাক্রান্ত করেন না। তাঁর কলামের ভাষা আর উপন্যাসের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা হলেও কলাম লেখার কারণে তার যে সমাজমনস্কতা ও দায়িত্ববোধ সেখান থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হন না। একটি প্রতিবাদের ইচ্ছা এবং ভাষা তাঁর মধ্যে নিরন্তর থেকে যায়। নারীর প্রতি সমাজের একশ্রেণির মানুষের যে দৃঙ্গিভঙ্গি তার প্রতিবাদ তিনি সরাসরি করেন। এবং তা চেতনা থেকে করেন বলে তার সৃষ্ট চরিত্র মোমিনুল, যে সামান্য চাকুরে এবং জীবনবোধে খুব বেশি দীক্ষিত নয় তার মুখ দিয়েও তিনি উচ্চারণ করান, ‘একটি মেয়েকে কতটা সস্তা সহজলভ্য মনে করেন এই মানুষটি, যেন যেকোনো ভাবেই তাকে ব্যবহার করা যায়। কেন? মেয়েটি খ্রিস্টান বলে? স্কার্ট আর টপস পরে বলে, হাইহিলে শব্দ তুলে অফিসে যেত বলে?’ বর্তমান সময়ের অনেকের অভিযোগ আর তার প্রতিবাদে দেশের অজ্র শুভবোধসম্পন্ন মানুষের প্রতিবাদটি যেন মোমিনুলের ভাবনায় মূর্ত হয়ে ওঠে।
মাকোন্দা নগর এবং তার চরিত্রগুলো মার্কিজের জাদুবাস্তবতায় তৈরি, কিছুটা বাস্তব কিছুটা কল্পনা। আর ফুটো উপন্যাসের চরিত্রগুলো আমাদেরই চেনা-জানা জগতেরই। ফলে ফুটো দিয়ে মেরিকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বাথরুমে যাওয়া, খুনের ঘটনায় মোমিনের জড়িয়ে যাওয়া এবং শেষে নিজে বাঁচতে এলেনকে ফাঁসিয়ে দেওয়া কোনোটাই অস্বাভাবিক ঠেকে না আমাদের কাছে। সম্ভবত এই প্রথম কোনো একটি উপন্যাসে ফিরিঙ্গীদের জীবনচিত্র স্থান পেল। যদিও পাঠকরা তা দেখেছেন মোমিনুল জানা ও দেখার মধ্য দিয়ে। খুব বেশি বিস্তৃত নয়। তারপরও বলতে হবে ফুটো একই সঙ্গে উপন্যাস যতখানি ঠিক ততখানি একটি উপেক্ষিত ইতিহাস, একটি অজানা জীবনাচারকে জানার প্রামাণ্যচিত্র।
বইটি পড়তে ক্লান্তি লাগেনি। পাঠটা সুখকর। আর এটাই বিশ্বজিতের বৈশিষ্ট্য। তিনি যখন কবিতা লেখেন সেটিও যেমন সুখপাঠ্য তেমনি কলাম এবং ছোটগল্প বা উপন্যাসও। অর্থাৎ পাঠককে চাপ না দেওয়ার, ক্লান্ত করে না তোলার মুন্সিয়ানাটি তাঁর ভালোই জানা আছে।
তবে বইটির প্রচ্ছদ ভালো লাগেনি। ফুটো বলে প্রচ্ছদে একটি ফুটোর ছবি তুলে দিতে হবে এমন না ভাবলেই ভালো হতো।
বাংলাদেশের পাঠকরা, এমনকি চট্টগ্রামেরও, যারা কখনো ফিরিঙ্গীবাজার এবং এখানকার খ্রিস্টানদের জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত নন তারা বইটি পড়ে চমৎকৃত হবেন। অনেকে ফিরে যাবেন এরশাদবিরোধী আন্দোলন, সিটি কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রআন্দোলন এবং পাড়া ও সিনেমা হলকেন্দ্রিক মাস্তানিভরা দিনগুলোতে।
বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা। (সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি