
রুহু রুহেল, ২৯ মার্চ, এবিনিউজ : বিশ্বভূখণ্ডে মানুষের স্বাধীন বসতি পদে পদে পদদলিত হয়েছে এক জাতি এক ধর্ম এক জনগোষ্ঠীর অতি অহমিকার রোষানল তাণ্ডবে। বর্তমান মায়ানমারের রাখাইন অঞ্চলটিকে ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চেয়েও অর্থনৈতিক মেরুকরণের একুশ শতকীয় সাম্রাজ্যবাদী নবধারার উত্থান ঘটে প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যেও। মায়ানমারের জান্তা সরকার ও গণতন্ত্রের মানসরুপী সন্ত্রাসমনস্ক সরকার প্রধান সুচির অমানবীয় অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে আজ বহুজনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্নের পর্যায়ে। তেমনি রাখাইন অঞ্চলটিও রোহিঙ্গামুক্ত হয়ে বাংলাদেশের উপর অমানবীয় আচরণের শিকারে পরিণত হয়েছে এ জনগোষ্ঠী। বাংলার এ সবুজ প্রান্তর আজ মানবীয় দুঃসহ বোঝায় ও বহুস্তরী সমস্যায় আক্রান্ত। এ সমস্যা থেকে কখন মুক্ত হবে এ স্বদেশ ভূমি আমরা কেউ জানিনা। এ জনগোষ্ঠীর সমস্যার গভীরে কারণগুলো সুচিহ্নিত করতে গবেষণাধর্মী চেষ্টা চালিয়েছেন গবেষক জামাল উদ্দিন। বইটিতে যথেষ্ট তথ্য ও উপাত্ত নির্ভর ইতিহাসের উপাদান সাযুজ্য রূপে বর্ণিত হয়েছে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মেরুন হরিয়াল, প্রকাশিত হয়েছে বলাকা প্রকাশন হতে, পৃষ্ঠা সংখ্যা-২৫৬, মূল্য-৩৫০ টাকা। অমর একুশে বইমেলা-২০১৮ তে প্রকাশিত হয়।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গমস্থলে সমুদ্র তীরবর্তী হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ আরাকান। ঐতিহাসিকভাবে রাজ্যটি ছিল বরাবরই স্বাধীন ও অতিশয় সমৃদ্ধশালী। ম্রোহং বা রোসাঙ্গ শহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছিল এই রাজ্যের রাজধানী। চট্টগ্রাম, পেগু ও আরাকান, এই তিন জনপদের মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে এই রাজ্যের পরিধি। ইতিহাসের পেছনে তাকালে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব দুই শতক হতেই ইয়েমেনিয় ও ব্যাবিলনিয় অঞ্চলের আরবগণ (অমুসলিম আমলের) সমুদ্র বিদ্যায় পারদর্শীতার কারণে চীন ও ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকারী ছিল। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন ভৌগোলিকভাবে চট্টগ্রাম ছিল অধুনালুপ্ত আরাকান রাজ্যের একটি অঞ্চল। এই রাজ্যের অন্যতম বন্দর শহর চট্টগ্রাম ও আকিয়াব বিশ্ব বাণিজ্যের সে সময়ের দুই সমৃদ্ধ কেন্দ্র। সুতরাং প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে চট্টগ্রাম-আরাকানে কাল-কালান্তরে বিভিন্ন জাতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ছিলো অবারিত ও অবধারিত, যা বিদেশী বণিক, যোদ্ধা, জনজাতির রক্তের নৃতাত্ত্বিক মিশ্রণও ঘটিয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব কালের দুর্ধর্ষ আর্যীকরণের প্রবল প্রভাব থেকেও এ অঞ্চল মুক্ত থাকে নি। প্রকৃতপক্ষে, সমুদ্র, মেখলা, গিরি, কুন্তলা এবং পাহাড়-পর্বতবেষ্টিত আদি আরাকান রাজ্যের বন্দর সুবিধা, বাণিজ্য প্রসার, প্রাকৃতিক অঢেল সম্পদ, ভূ-রাজনৈতিক-রণকৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান, এমনকি তৎকালীন নৌ-প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ইত্যাদির কারণে প্রাচীন শক্তিশালী সামরিক জাতিসমূহের নিকট এ অঞ্চল সবসময়েই আকর্ষণীয় ও ঈর্ষণীয় ছিলো। ফলে এ অঞ্চলের জনজীবন, সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই যে সার্বক্ষণিক সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করতো তা সহজেই অনুমেয়। অস্বীকার করা যাবে না যে, এ রাজ্যটি ছিলো সবসময়েই ঈর্র্টফণথরমলভঢ মতর্ দণ ভণধথদঠমরধভথ টবঠর্ধধমল্র বমভটরডদ’ এই তথ্য-উপাত্তের সাদামাটা অর্থ এই যে, আরাকান ও চট্টগ্রামবাসীকে সবসময়েই কোন না কোনভাবে যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যে কাটাতে এবং সংগ্রামী হতে হয়েছে। অষ্টম শতকে আরব্য বণিকরা ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে এবং ফকির-দরবেশরা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম-আরাকানে আগমন করেন। ৭৮৮ হতে ৮১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মহত ইঙ্গ চন্দ্র নামে একজন রাজা আরাকান রাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সময়ে একদল আরব বণিক পালের জাহাজে করে ‘রামরী দ্বীপে’র নিকটে পৌঁছলে ঘটনাক্রমে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে তাদের জাহাজগুলো ভেঙ্গে যায়। তখন বণিকদল বিপন্ন হয়ে তীরে অবতরণ করেন। রাজার আদেশে তারা আরাকানরাজ্যে বাস করার অধিকার পান। এই বণিকেরা স্থানীয় নারীর সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঔরশে জন্ম নেয়া সন্তান-সন্ততিরাই হলো আরাকান রাজ্যের ভূমিপুত্র বা আদি জনগোষ্ঠী, আধুনিক কালে যারা মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নামে পরিচিত। ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে অনরথ নামক এক রাজা এ অঞ্চলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করে একটি একচ্ছত্র রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং পগান প্রদেশে তিনি রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা অনরথের রাজত্বকালকে স্বর্ণকাল বলা চলে। বৌদ্ধধর্মে অতিমাত্রায় অনুরক্ত এই রাজা শহরজুড়ে অনেক মন্দির ও প্যাগোডা নির্মাণ করেন। ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে এই রাজ্যের একদিকে ‘শান’ ও আরেকদিক থেকে ‘মোঙ্গল’ জাতি দখল করে এবং একে ভেঙ্গে পুনরায় ছোট ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি দেশটি চারটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। রাজ্যগুলো হলো উচ্চ বার্মা, নিশু বার্মা, শান প্রদেশ ও আরাকান প্রদেশ। এসব প্রদেশগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকতো। আরাকানে মগধ বংশের রাজা অযুথোকে হত্যা করে তাঁরই ভাই সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু অযুথোর পুত্র যুবরাজ নরমিখলা ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে চাচাকে হত্যা করে পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে এক অবাঞ্চিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আভার রাজা মেঙৎ শোঅই (মিন কৌং) আরাকান আক্রমণ করে। তিনি নরমিখলাকে (১৪০৪-১৪৩৪) পরাজিত করে আরাকান দখল করেন। নরমিখলা বাংলার (গৌড়ের) সুলতানের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে তার রাজ্য উদ্ধারে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। নানান ঘটনা প্রবাহের কারণে আশ্রয়ের দীর্ঘ ২৪ বছর পর ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৪-১৪৩১ খ্রি.) সেনাপতি ওয়ালী খানের নেতৃত্বে গৌড়ের বিশাল সেনাবাহিনী সহ নরমিখলাকে আরাকান রাজ্যে প্রেরণ করেন। গৌড়ের সেনাবাহিনী আভার রাজা মেঙৎ শোঅই (মিন কৌং) কে পরাজিত করে নরমিখলাকে স্বরাজ্য পুনরুদ্ধার করে দেন। তখন থেকে আরাকান রাজ্য গৌড়ের করদরাজ্যে পরিণত হয়ে যায়। নরমিখলার সঙ্গে আরাকান পুনরুদ্ধাদের যুদ্ধে গৌড়ের সেনাবাহিনীসহ যেসব মুসলমান আরাকানে আসেন, তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং আরাকানের রাজধানী মোহং-এ যুদ্ধ বিজয়ের স্মারক হিসেবে ‘সন্ধিকন’ নামে একটি মসজিদও প্রতিষ্ঠিত করেন। গৌড়ের সেনাপতি ওয়ালী খান আরাকানের রাজা নরমিখলার দরবারে কাজী নিযুক্ত হন, এবং তখন থেকে আরাকানে ফার্সী ভাষা চালু হয়। মুসলিম জনপদ আরাকান রাজদরবারে এটাই প্রথম আনুষ্ঠানিক ও সক্রিয়ভাবে মুসলিম রীতি প্রবিষ্ট করে। সিংহাসন উদ্ধার করার পর নরমিখলা চার বছর (১৪৩০-১৪৩৪ খ্রি.) রাজত্ব করেন। এ সময় থেকে আরাকানরাজ নরমিখলা গৌড়ের মুসলমান সুলতানদের মত তাঁদের মুদ্রার এক পৃষ্ঠায় ফারসী অক্ষরে ইসলামী ‘কলেমা’ ও মুসলমানী নাম লেখার রীতি চালু করেন। গৌড়ের মুসলমান সুলতানদের প্রভাব বশতই নরমিখলা তাঁর রাজ্যে এই রীতি চালু করেছিলেন, যেহেতু গৌড়ে তিনি মুসলমান সুলতানের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে ছিলেন দীর্ঘ ২৪ বছর। নরমিখলার পরবর্তী রাজারাও মুদ্রার এক পৃষ্ঠে ফারসী অক্ষরে ইসলামী ‘কলেমা’ ও অপর পৃষ্ঠায় তাঁর বৌদ্ধ নাম ব্যবহার করতেন। এর সঙ্গে একটি করে মুসলমানী নামও ব্যবহার করতেন। ১৪৩০ থেকে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইসলামী নাম, উপাধি গ্রহণ করেছিলেন আরাকানের ১৭ জন রাজা। শুধু আরাকানের রাজারাই নন, রাজ-অমাত্যবর্গ, সৈন্যবিভাগের প্রধান থেকে শুরু করে প্রত্যেক বিভাগের প্রধান কর্মচারীরাও মুসলমানী নাম গ্রহণ করেছিলেন। নানা বর্ণে ও নানা রঙে উন্নত ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব আরাকানের অনুন্নত বৌদ্ধসংস্কৃতির ধারক ও বাহক শাসকগোষ্ঠী আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। আরাকান রাজ দরবারই কেবল নয়, সমগ্র আরাকান ও চট্টগ্রামব্যাপী তখন ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাবে ভরপুর হয়ে যায়। এই সকল বৌদ্ধারাজাদের যাঁরা অমাত্য, মহাজন, পাত্র-মিত্র, সৈনাধ্যক্ষ ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। আরাকানের রাজধানী ম্রোহং অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় সবাই ছিলেন বাঙালি ও ধর্মান্তরিত মুসলমান। এ সকল বাঙালি ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে থেকেই রোসাঙের বৌদ্ধ রাজারা তাঁদের অমাত্য-মহাজন, পাত্র-মিত্র নিয়োগ করতেন।
আরাকানে মুসলিম শাসন প্রাধান্য পাবার ফলে ম্বো, মিঙ্গান, কালাডন, মায়ু, নাফ প্রভৃতি নদীর উভয় তীরে মুসলিম জনপদ গড়ে ওঠে এবং মুসলিম আধিপত্য ও উপনিবেশ স্থাপিত হয়। সুফী-পীর-দরবেশরাই এখানে ইসলাম প্রচার করেন। রাজনীতি, সমরনীতি, দরবারী আদব-কায়দায় ইসলামী রীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। তাছাড়া সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনেও ইসলামী প্রভাব পরিলক্ষিত হতো। আরাকানে যে পর্দাপ্রথার প্রচলন শুরু হয়ণ্ড তা খাঁটি আরবীয় মুসলমানদের সংস্রবের ফল। নৌ-বিদ্যায় প্রাচীনকালে আরবীয় মুসলমান বণিকদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। আরাকানের বিভিন্ন স্থানের আরবী নাম, চট্টগ্রামীভাষায় কথ্য-রীতিতে আরবী শব্দের প্রয়োগ, সবই আরবীয় প্রভাব প্রসূত। সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে আরাকান রাজদরবারের কবিরা ছিলেন ইসলামী সংস্কৃতির উপাসক। কিন্তু আরাকান রাজদরবারাশ্রিত মুসলমান কবিরা কেবল সংস্কৃতি নয়, হিন্দী, আরবী, ফারসী প্রভৃতি উন্নত ভাষা-সাহিত্য থেকে অনুবাদ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি সাধন করেন। বাংলা সাহিত্যে মানবীয় প্রেমকে কেন্দ্রীয় শক্তিরূপে পরিকল্পনা করে সাহিত্য রচনার পথিকৃৎ মূলত আরাকান রাজসভার কবিরাই। ১৬২২ হতে ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ মাত্র, ছেষট্টি বছরের মধ্যে,আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা ভাষাও সাহিত্যের যে সর্বোতোমুখী বিকাশ সাধিত হয়,তার তুলনা বাঙ্গালা ভাষার আপন গৃহেও মিলে না। প্রকৃতপক্ষে আরাকান রাজসভার বাংলা সাহিত্য-সংস্কতির এত বৈভব-ঐশ্বর্য, বিষয়-বৈচিত্র্যের বিকাশ মূলত মুসলমানদের অবদানের ফল। কবিরা ছিলেন মুসলমান, সুফীধর্মাবলম্বী সাধক, তাঁদের পৃষ্ঠপোষক, আশ্রয়দাতা-আদেষ্টারাও ছিলেন একই পথের পথিক। তাঁদের কাব্য-রীতির আদর্শ ছিল আরবী-ফারসি। স্থানীয়ভাবে হিন্দু-বৌদ্ধ প্রভাবও তাতে দেখা যায়।
সুতরাং কোন সংশয় ছাড়াই বলা যায় যে, ৭৮৮ সাল থেকে ১৪৩০ সাল ও পরবর্তীতে ১৭ জন মুসলিম নাম ধারণকারী আরাকানের রাজাদের শাসনামলে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক মুসলমান ও ধর্মান্তরিত মুসলমান ও তাদের পরবর্তী বংশধররাই হলো ‘রোহিঙ্গা মুসলমান’। বংশপরম্পরায় তারা হাজার বছর ধরেই আরাকানে বসবাসরত। রোহিঙ্গা জাতির অনেক খ্যাতিমান পুরুষ আরাকান রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সামরিক বাহিনীর প্রধান ও উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একজন মুসলমানও আরাকানের রাজ সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন। উপরোক্ত তথ্যের আলোকে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, রোহিঙ্গারা কখনো আরাকানে অনুপ্রবেশ করেনি, তারা আরাকান ভূমিরই অকৃত্রিম সন্তান। বরং তাদের রাজ্যটি যারা কেড়ে নিয়েছে, তারাই আজ জোরপূর্বক রোহিঙ্গা জাতিকে নিধন করছে। ১৭৮৪ সালে স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করে বার্মার রাজা বোধপায়া। ঐ সময় আরাকান রাজ ‘থামাদা’ সপরিবারে বর্মী বাহিনীর হাতে নিহত হন। বর্মি সৈন্যরা বন্দি ২০ হাজার আরাকানী সৈন্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। একই সাথে হত্যা করে দু’লাখ নারী-পুরুষকে। আরো প্রায় দু’লক্ষ আরাকানিকে দাস হিসেবে বার্মায় প্রেরণ করে। বন্দী দাসদের সিংহভাগই ছিল রোহিঙ্গা মুসলমান। যারা এইসব হত্যাযজ্ঞ হতে অব্যাহতি লাভের আশায় জঙ্গলে পালিয়েছিল তাদেরও অনেককে বর্মী সৈন্যের হাতে, নয় বাঘের মুখে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। তখন বর্মীরাজের এরূপ চণ্ডনীতির ফলে অসংখ্য আরাকানি মগ, চাকমা, রোহিঙ্গাসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণ করে। পরবর্তীতে মৃত্যুভয়ে তারা আর স্বদেশে ফিরে যায় নি। চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চল রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারেই তারা স্থায়ী হয়ে যায়। নৃ-তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এ কথা প্রমাণ করে। ফলে তখন থেকেই দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে লোকসংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। বোধপায়া আরাকানকে বার্মার সাথে একীভূত করে বার্মার একটি প্রদেশে পরিণত করে। তখন থেকেই আরাকানিদের দুর্ভোগ আর গৃহত্যাগের সূচনা ঘটে।
সভ্যতার আলোকে এই জনপদ কতো প্রাচীন, তা আজও স্পষ্ট নয়। ইতিহাসবেত্তারা চট্টগ্রাম বন্দর ও আকিয়াব বন্দরকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের অতীত ইতিহাস নিরূপণের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতেও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে বিধায় গবেষকগণ ঐকমত্যহীনভাবে এ অঞ্চলের ইতিহাসচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।
পণ্ডিতরা এই মত পোষণ করেন যে, আট থেকে দশ হাজার বছর আগে এই জনপদে মানববসতি গড়ে উঠেছিল। সেই ইতিহাস আমাদেরকে কোন প্রাচীন যুগের গহীনে নিয়ে যাবে, তা ভেবে পুলকিত ও রোমাঞ্চিত হতে হয়। তবে পুরাকীর্তির সুরক্ষা না থাকার কারণে এবং বারংবার আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ায় আরাকান অঞ্চলের সভ্যতার স্মারক চিহ্নসমূহ বিনষ্ট হয়েছে। তদুপরি, এককালে যা দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাকীর্তি গড়ে উঠেছিল অন্যকালে তা-ই হয়ে যায় প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। কালের নিষ্ঠুর আঁচড়ে এমনটি হওয়ায় আশ্চর্য হবার কিছু নেই। যুদ্ধবিগ্রহ ও দখল-বেদখলে পরাশক্তির বর্বরতায় এমনটি ঘটেছে আরাকান রাজ্যে। প্রাকৃতিকভাবে প্রাণীর জন্ম-মৃত্যুর মতো নক্ষত্রেরও জন্মমৃত্যু আছে, ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-ভূমিকম্পের কারণে নগরের উত্থান-পতন হয়েছে একাধিক বার। দূর-ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, এক মানবগোষ্ঠী প্রয়োজনে নগর গড়েছে, আরেক জনগোষ্ঠী তাদের প্রয়োজনে সে-নগর ধ্বংস করেছে। প্রাচীন এই জনপদ শহরমাত্র ছিল না, এর সূচনাই বন্দরকে কেন্দ্র করে বিকশিত সমৃদ্ধ জনপদের মাধ্যমেই সূচিত হয়েছিল। আরাকান, চট্টগ্রাম মানে সমুদ্রপথে এশিয়া মহাদেশের এ অঞ্চলটির সঙ্গে পৃথিবীর সংযোগস্থল। সোনারগাঁও-এর সুলতান, গৌড়ের সুলতান, ত্রিপুরার রাজা, মোগল-পাঠান এমনকি হাজার মাইল দূরের ইংরেজ-পর্তুগীজরাও দখল-বেদখলের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল বন্দরের দখল-বেদখলকে কেন্দ্র করে। এই রাজ্যের রাজা-বাদশাহারা একেক সময় একেক স্থানে রাজধানী কিংবা কর্মস্থল গড়ে তুলেছিলেন। রাজ্যকে বর্ধিত বা সীমিত করেছেন। সেই ইতিহাসের অনেক কিছুই আজ আমাদের হাতে নেই। নেই সেই সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিবরণও।
এই ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে আমি ১৯৯৯ সালে ছুটে গিয়েছিলাম আরাকানে। সেখান থেকে সংগ্রহ করেছি অনেক ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিলপত্রাদি। এসব দলিল-পত্রের সূত্র ধরেই পেতে চেষ্টা করেছি হাজার বছরের আরাকান রাজ্য ও রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস। ২০০৩ সালেই গ্রন্থটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের অভাব পরিলক্ষিত হলে পরবর্তীতে আরও একাধিকবার গমন করেছি আরাকানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে গ্রন্থটির কলোবর বৃদ্ধি ঘটেছিল অতিমাত্রায় এবং নামকরণ করছিলাম ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম-আরাকান’। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে প্রায় দেড় হাজার পৃষ্ঠার গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য বার বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষু কর্তৃক রোহিঙ্গা জাতিকে তাদের মাতৃভূমি আরাকান থেকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকভাবে চরম গণহত্যা শুরু করে। ইতোমধ্যে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পূর্বে আগত ৫ লক্ষাধিকসহ এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জাতির সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ, যাদের মধ্যে স্বামী-সম্পদ হারানো নারী আর এতিম শিশুই অধিক। বিশ্বকে হতবাক করা এবং মানবতাকে লাঞ্ছিত করা এই নির্মম ঘটনার সময় সমকালীন রোহিঙ্গাদের সব ঘটনাই এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটির নামকরণ করেছি ‘লুণ্ঠিত আরাকানে রোহিঙ্গা জাতি’। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ঘটে যাওয়া নারকীয় মানবতা বিরোধী অপরাধের ঐতিহাসিক বিবরণ মানুষ জানতে পারবেন।
আশা করি গ্রন্থটি পাঠে রোহিঙ্গা জাতির হাজার বছরের ইতিহাস জানা যাবে এবং বিদ্যমান রোহিঙ্গা সমস্যার একটি ঐতিহাসিক মূল্যায়ন পাওয়া পাঠকের পক্ষে সম্ভব হবে। এখানে উল্লেখিত বিষয়গুলোর পরিচয় বইয়ের নামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এবং প্রাচীন দলিলপত্র ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তা বৈজ্ঞানিক গবেষণার নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করেই লিখিত হয়েছে। বিষয়বস্তুতে মিল আর লেখকের বক্তব্যে ঐক্য রয়েছে বলে কোন কোন বিষয়ে পুনরাবৃত্তি-দোষ যে ঘটে নি, তা নয়। লেখক নিজেই বলেছেন, অনিবার্য কারণে তা এড়ানো সম্ভব হয় নি।
(সংগৃহীত)
এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি