![রাষ্ট্রের ভাঙা-গড়া](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/03/30/sirajul-islam-ch_132902.jpg)
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ৩০ মার্চ, এবিনিউজ : এই যে ভারতবর্ষে একের পর এক রাষ্ট্রের উত্থান ও পতন, এবং তার ফলে ব্যক্তির ভাগ্যে পরিবর্তন, অল্পকিছু মানুষের সুখ বৃদ্ধি, অন্যদের দুর্ভোগ, এর রহস্য নিহিত রয়েছে রাষ্ট্রের চরিত্র এবং রাজনীতিকদের কার্যকলাপের ভেতরই; ব্যক্তি এখানে শক্তিহীন, এমনকি তাঁরাও শক্তিশালী নন রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের ফলে যাঁদের জন্য সৌভাগ্যের স্বর্ণ দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে গেছে। রাজনীতিকেরা রাষ্ট্রের পরিবর্তন নিয়েই ভেবেছেন, সমাজের পরিবর্তনের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাননি। আর রাষ্ট্রের পরিবর্তন বলতে তাঁরা বুঝেছেন রাষ্ট্র ক্ষমতার হাতবদল। সাতচল্লিশে ব্রিটিশের বড় রাষ্ট্র ভেঙে তুলনায় ছোট রাষ্ট্র খাড়া করা হয়েছে, নতুন শাসকরা এসেছেন, কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্রে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। ব্রিটিশের রাষ্ট্র ছিল গঠনের দিক থেকে আমলাতান্ত্রিক, আদর্শে পুঁজিবাদী; পাকিস্তানি রাষ্ট্রের চরিত্রও ছিল ওই রকমেরই; কথা ছিল বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক, তা হয়নি, সেই আগের রাষ্ট্রের মতোই রয়ে গেছেণ্ডগঠনে আমলাতান্ত্রিক, আদর্শে পুঁজিবাদী। আর সমাজও আছে আগের মতোই বৈষম্যমূলক; প্রবলভাবে পীড়ন করছে দুর্বলের ওপর, এবং ওই পীড়নের মধ্য দিয়েই সে আরো প্রবল হচ্ছে। রাষ্ট্র পাহারা দিচ্ছে সামাজিক বৈষম্যকে। যে রাজনীতিকেরা ক্ষমতায় আসা–যাওয়া করে এই ব্যবস্থাপনায় তারা বেশ সুখেই আছে।
এমন ব্যবস্থায় সমষ্টিগত মানুষের জন্য দুর্ভোগ অনিবার্য, এবং সেই দুর্ভোগই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের নিরন্তর বিধিলিপি। ধর্মীয় এবং জাতিসত্তাগত পরিচয়ে যারা সংখ্যালঘু এই রাষ্ট্র ও সমাজে তাদের দুর্ভোগ দ্বিমাত্রিক, একটি নাগরিক হিসেবে অপরটি সংখ্যালঘু হিসেবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পাকিস্তানে ওই দ্বিমাত্রিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে, বাংলাদেশে সে–যন্ত্রণার অবসান ঘটবে বলে আশা করা গিয়েছিল; কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি, যাতে বোঝা যায় রাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি, সে গণতান্ত্রিক হয়নি, এবং সমাজও গণতান্ত্রিক হতে পারেনি। গণতন্ত্র মোটেই ভোটের ব্যাপার নয়, নির্বাচিত স্বৈরাচার যে অনির্বাচিত স্বৈরাচারের তুলনায় কল্যাণকর তা নিশ্চিত করে বলবার উপায় নেই। গণতন্ত্র হচ্ছে সমাজের সর্বক্ষেত্রে অধিকার ও সুযোগের সাম্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় থাকবে রাষ্ট্রক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সর্বস্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন। যেসব বর্তমানে মোটেই নেই, এবং না–থাকার নিরিখেই বোঝা যাচ্ছে এদেশের মানুষ কেমন আছে।
সংখ্যালঘুদেরকে চিহ্নিত করা সহজ। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে চিহ্নিত করা কঠিন নয়, পাকিস্তান আমলে তারা বিদ্বেষের শিকার ছিল, বলা হতো তারা হলো ‘মালাউন’, এখন সে–বিদ্বেষ হয়তো আগের মতো নেই; কিন্তু তাদের জায়গাজমি ব্যবসা–বাণিজ্য সম্পত্তি দখল করার তৎপরতায় কোনো বিরাম ঘটেনি এবং এইসব দখলদারিত্ব ঘটছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়। উর্দুভাষীরা বিদ্বেষপূর্ণ ‘মাউড়া’ নাম পেয়েছিল; তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই, কিন্তু তারা যে সামাজিকভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে তেমন ব্যবস্থা করার ব্যাপারে রাষ্ট্র মোটেই আগ্রহী নয়। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো নিজেদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে এবং নীরবে চেষ্টা চলছে তাদেরকে ‘আদিবাসী’ করে মূলধারার বাইরে রাখবার।
নতুন রাষ্ট্র যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন জাতীয়তাবাদী উত্তেজনার প্রাবল্যের দরুন রাষ্ট্রের কর্ণধারদের পক্ষে এটা খেয়াল করা সম্ভব হয়নি যে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদিও রাষ্ট্রীয় অধিকার অর্জিত হয়েছে তবু বাংলাদেশে যেহেতু অবাঙালিরাও আছে, কেবল উর্দু ভাষীরা নয়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরাও, তাই এই রাষ্ট্র জাতি–রাষ্ট্র হবে না এবং বর্তমান বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই জাতি রাষ্ট্র হওয়া সম্ভব নয়। সংবিধানে নাগরিকদের বলা হয়েছিল বাঙালি এবং ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে পাহাড়িদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বাঙালি হয়ে যেতে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকে আমরা বলেছি ফ্যাসিবাদী; বলবার পেছনে একটা যুক্তি ছিল এই অভিযোগ যে, ওই রাষ্ট্র সকল নাগরিককে জোর করে পাকিস্তানি বানাতে চেয়েছিল, বাংলাদেশ যে একই রকম কাজ করতে চাইবে সেটা অপ্রত্যাশিত ছিল বটে, কিন্তু অবাস্তবিক যে ছিল না সে তো বোঝাই যাচ্ছে। আবারও বলতে হয় যে, কারণটা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের রাজনৈতিক চরিত্র; পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীদের তুলনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যে অধিক সহনশীল ছিল তা বলা যাবে না। পঁচাত্তরের পরে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে তারাও নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী বলেই নিজেদেরকে মহোৎসাহে বিজ্ঞাপিত করেছে, এবং ‘বাঙালি’র স্থলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তনে অভিলাষী হয়েছেন, উদ্দেশ্যটা কিন্তু এই নয় যে, বাংলাদেশি হিসেবে রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে তারা সমান অধিকার দিতে চেয়েছে। সেটা যে নয় তার স্পষ্ট প্রমাণ তো এই যে, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তারা কেটে ফেলে দিয়েছে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধ তাদের সময়েই তুঙ্গে উঠেছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তনের আসল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের বাঙালিত্বকে যতটা পারা যায় খর্ব করা, মোটেই বাংলাদেশের সকল নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রীয় সমমর্যাদা দান নয়। বাঙালি এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের এই দুই ধারার মধ্যে মনে হবে বিস্তর ব্যবধান, কিন্তু উভয়েই অবাঙালিদের রাজনৈতিক স্বার্থ দেখার ব্যাপারে উদাসীন, তদুপরি উভয়েই রাজনীতিতে সাফল্য লাভের জন্য ধর্মকে ব্যবহারে আগ্রহী। বলাবাহুল্য ধর্মের ওই ব্যবহার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে নিরাপত্তা দেয় না, বরঞ্চ নিরাপত্তাহীনতার বোধটাকেই বাড়িয়ে তোলে।
যেটা প্রয়োজন তা হলো সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। মানুষ সমাজে বাস করে এবং এই সমাজ সেই পুরাতন সমাজ যেখানে প্রধান সত্য হলো মানুষে মানুষে বৈষম্য। রাষ্ট্র এই বৈষম্যকে পাহারা দেয়, কেবল পাহারা দেয় না, বৃদ্ধিতে হাত লাগায়। আমাদের অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উৎপাদনের চাইতে লুণ্ঠনের প্রতাপ বেশি, এবং লুণ্ঠনকারীরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অবাধে তাদের কাজ করে চলেছে, ফলে বৈষম্য প্রতিদিন অপ্রতিহত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সমাজ ক্রমাগত মনুষ্য বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে, সাধারণ মানুষ এখানে বিপদের মধ্যে রয়েছে। বিশেষভাবে নিগৃহীত হচ্ছে সংখ্যালঘুরা। অবাঙালি জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি অত্যাবশ্যক; কিন্তু তাতেই যে ওই সংখ্যালঘুদের ভাগ্য বদলে যাবে তা নয়। ভাগ্য বদলাবে যদি সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আসে এবং সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তবেই। আর সমাজ তো বদলাবেই না যদি না রাষ্ট্রের চরিত্রে উন্নতি ঘটে। এসব ঘটনা এমনি এমনি ঘটবে না। তার জন্য আন্দোলন দরকার হবে। মূল আন্দোলনটি হবে রাজনৈতিক, এবং সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বা জাতিসত্তাগত পার্থক্য অবশ্যই থাকবে না। বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দু ভাষীরা এদেশবাসীর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাঞ্ছিতরূপে অংশগ্রহণ করতে পারেনি বলে তাদের নিজেদের ক্ষতি তো অবশ্যই হয়েছে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরও ক্ষতি হয়েছে। ব্যক্তির প্রকৃত ভাগ্য পরিবর্তন বিচ্ছিন্নতায় নেই, নিহিত রয়েছে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে। পেছনের ইতিহাস এই কথাটাই বলছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(সংগৃহীত)