শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
logo

নয়নতারার দিনকাল

নয়নতারার দিনকাল

দীপক বড়ুয়া, ৩০ মার্চ, এবিনিউজ : আগে আমাদের অনেক দাম ছিলো, এখন নেই। নয়নতারা সবসময় এই কথাটি বলে।

আজও বললো। হিরালাল চুপ থাকেনা। হিরালাল উত্তর দেয়, –সেইদিনে কতো পরিশ্রম করেছি।তখন চট্টগ্রাম শহর এতো বড়ো ছিলোনা। বাসার মানুষের সব মল কাঁধে নিয়ে নদীতে ফেলেছি। সবাই আমাদের মেথর ডাকতো। বাবুরা আট আনা, একটি টাকা বকশিস দিতো। খুঁজতো। ময়লা ভরলে খবর পাঠাতো। সম্মান ছিলো।

তাতেও আনন্দ ছিলো। এখন কষ্টের কাজটাতো নেই।দামের কি আসে যায়।

–তোমাকে কষ্টের কথা বলিনি। দামের কথা বলছি। এখন কি দাম আছে? সারাদিন রাস্তায় থাকি।কেউ চেনেনা, জানেনা। সেই ভোর রাতে রাস্তা পরিষ্কার করি। ঝড়ে,রোদে।

– ক্ষতি কি? পাঁচতলা বিল্ডিংএ থাকছো,খাচ্ছো। আর কি?

–তাতে তোমার পেট ভরে, আমার না।

ওরা স্বামী–স্ত্রী।

রঙ্গম সিনেমা হলের পাশের মেথর পট্টি গলিতে থাকে। সরকার ওদের থাকার, গ্যাস, জলের সুব্যবস্থা করে দিয়েছে। আর কি?

নয়নতারা মেথর হলেও স্মার্ট।

কাপড় পরা, চলাফেরা,কপাল জুড়ে বড়ো লাল টিপ দেয়া এক্কেবারে পরিপাটি। এককথায় সুন্দরভাবে চলতে পছন্দ করে। স্বামী হিরালাল একটি চেকের লুঙ্গী, হাফ চেক শার্টে সন্তুষ্ট। এটা নয়নতারার পছন্দ নয়।

নয়নতারা স্বামীকে স্মার্ট দেখতে চায়।

সেটা হিরালাল পারে না। বড়ো দুঃখ নয়নতারার।

ওদের সংসারে একটি মাত্র মেয়ে। বিন্দুবালা। পনের বছর পার করেছে। সুন্দরী। মায়ের মতই। নয়নতারা তাকে লেখাপড়া করিয়েছে। সামান্য। নিজের নাম লিখতে পারে। বাড়তি এটাওটা কিছু লিখতে পারে।

নয়নতারা বিন্দুবালার বিয়ে নিয়ে ভাবে। নয়নতারাকে মা–বাবা বিয়ে দিয়েছে মাত্র তেরো বছর বয়সে। এরকমই বয়সে ওদের বিয়ে দেয় মা–বাবারা।

তাই নয়নতারার ভাবনা।হিরালালের এবিষয়ে মাথাব্যথা নেই। সে তার পৃথিবীতে দিব্যি মজায় আছে। সন্ধ্যার পরপর মদ নিয়ে বসে ঘরে।মদ খেতখেতে রাত গভীর হয়। ভরা ঘুমে পড়ে থাকে।

রাত গভীরে খিদেয় পেট ছোঁছোঁ করে। খাবারের জন্য ছটপট করে। নয়নতারা খেতে দেয়। হিরালাল খেতে খেতে বলে,

–ভাগ্য আমার কতো ভালো, তোমার মতো বউ পেয়েছি। না হয় কখন মরে যেতাম না খেয়ে।

নয়নতারা এতো রাতে হিরালালের কথার উত্তর দেয়না।

শুয়ে পড়ে।

হিরালাল শোয় পাশে। শোবার সাথে সাথে ঘুম। নাক ডাকে অবিরাম। একসময় নয়নতারার পছন্দ হতোনা। আজকাল হিরালাল নাক না ডাকলে নয়নতারার ঘুম আসেনা। নাক ডাকার ছন্দে নয়নতারা ঘুমিয়ে পড়ে।

সেদিন শুক্রবার ছিলো।

সবাই ঘুম থেকে উঠেছে। নয়নতারা, বিন্দুবালা।

সকালের চা খেতে খেতে বিন্দুবালা বলে,

–মা,আমার নামটা কে রেখেছে? পুরনো। বিন্দুবালা কোনো নাম?

–আমাদের সমাজের নাম এরকমই হয়। যুগযুগ চলে এসেছে। চলছে। চলবে। এটাই নিয়ম।

–এই নিয়ম কেউ ভাঙতে পারেনা?

–কে ভাঙবে!

–ভাঙবে মা, ভাঙবেই। তুমি দেখো।

বিছানায় কুককুক কাঁশে হিরালাল। এটা নতুন নয়। কয়েক মাস ধরে কাঁশছে। বিছানা থেকে উঠতে চায়। পড়ে যায়। বিন্দু এগিয়ে যায়। বাবাকে ধরেই বলে,

–প্রচন্ড জ্বর। মা, তুমিতো বাবার পাশে শুয়েছিলে। বাবারযে এতোটা জ্বর তুমি জানতেনা।

–নারে,জানতাম না। একটা ডাক্তার ডেকে আন।

–মা, আমাদের ঘরে ডাক্তার কখনও আসে? আমরা সবচেয়ে নীচু জাত। সমাজে। ঘৃণা করে সবাই।

–ঠিকইতো, আমরা নীচু জাত। কেউ কি কোনদিন ভেবেছে? আমরা না থাকলে সুন্দর শহরের মুখ দেখতো? ভোরের আলো ফুটবার আগে তোর বাবা রাস্তায় নামে। রাস্তা ঝাড়ুদিতে। পরপর আমরা মেয়েরা। অসুখ হলে ডাক্তার আসতে চায়না! হায়রে মানুষের বিবেক!

বিন্দু বলে,

–মা,এখন সেটা বড়ো কথা নয়। কথা হলো বাবার চিকিৎসা। যদি ডাক্তার না আসে বাবাকে চেম্বারে নিয়ে যেতে হবে।

–তা’হলে সেটাই কর।

ট্যাক্সি করে মা মেয়ে হিরালালকে চেম্বারে নিয়ে যায়।ডাক্তার দেখে কতোগুলো পরীক্ষা দেয়। কফ্‌,রক্তের। প্রাথমিক কয়েকটা ওষুধ দেন। বলেন,

–এখন পরীক্ষাগুলো করুন। বিকেলে রিপোর্ট নিয়ে আসবেন। তখন দেখে ফাইন্যাল ওষুধ দেবো।

–ঠিক আছে ডাক্তারবাবু। বিন্দু বলে।

নয়নতারা, বিন্দু হিরালালের ডাক্তারী পরীক্ষা শেষে ওষুধ নিয়ে বাসায় ফিরে। বিকেলে রিপোর্ট নিয়ে বিন্দু চেম্বারে যায়।

ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বলেন,

– যা ভেবেছি ঠিক তাই হয়েছে।

– কি ভেবেছেন,আর কি হলো ডাক্তারবাবু? বিন্দু ডাক্তার বাবুকে জিগ্যেস করে। বিন্দু একা এসেছে। নয়নতারা হিরালালকে দেখছে।

একটু ভেবে ডাক্তার বলেন,

–টিবি, মানে যক্ষা হয়েছে। আচ্ছা, রোগী কি মদ পান করেন?

–হ্যাঁ, মদ পান করেন, বেশী।

– তা’হলেতো চিকিৎসায় সমস্যায় পড়বো।

–কি সমস্যা ডাক্তারবাবু? বিন্দু প্রশ্ন করে।

–মদ ছাড়তে হবে। না হয় ওষুধে কাজ করবেনা।

–ঠিক আছে ডাক্তারবাবু তাই হবে। আপনি ওষুধ লিখুন। আমি বাবার দেখভাল করবো।

–তবে একটি কথা,যদি আমার ওষুধে ভালো না হয়। তা’হলে মহাখালী টিবি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

–তাই হবে ডাক্তারবাবু।

বিন্দু প্রেসক্রিপসান অনুযায়ী ওষুধ নিয়ে বাসায় ফিরে।

নয়নতারা হরলালের মাথার কাছে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছিলো। বিন্দুকে দেখে প্রশ্ন করে,

– কি বলেছেন ডাক্তার?

–ওষুধ দিয়েছেন।খাওয়াতে হবে।

বিন্দু জানে, মা বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। বাবার হাজার খারাপ আচরণে মা চুপ থাকে।মা’র গায়ে হাত তুলে বাবা। চোখের সামনে মাকে হাত তোলা পছন্দ হয়না।

একদিন দুপুরে বাবা কাজে বাইরে ছিলো। নয়নতারা বিন্দুর চুলে উকুন দেখছিলো। মা বললো,

–বিন্দু, এতো উকুনতো ছিলোনা, কিভাবে বাড়লো? শ্যাম্পু করিসনা।

–করিতো! কি জানি, কেনযে বাড়ে? আচ্ছা মা একটা কথা বলবো, যদি তুমি রাগ না করো!

–হ্যাঁ,বল। রাগ করবো কেন মা।

–বাবা তোমার গায়ে হাত তোলে, তুমি চুপ থাকো।

এবং বাবা হাত তোলার কারণতো দেখিনা। সবকিছু বাবার পছন্দে করো।

–তুইতো এখনও ছোট।বিয়ের পর বুঝবি। স্বামী কি!কতো মূল্যবান! একজন মেয়ে বাবার বাড়ি থেকে সবাইকে ছেড়ে আসে।এসে শ্বশুরবাড়িকে আপন করে নেয়। নিজের বাড়ি ভেবে। সংসারকে আঁকড়ে ধরে। ঐ স্বামীর একটু ভালোবাসার জন্য।

বিন্দু মায়ের কথায় হারিয়ে যায়। ভাবে, ভালোবাসা কি? ওটা আবার কি ধরণের! মাকে টুক করে প্রশ্ন করে,

–মা ভালোবাসা কি! ওটা দেখা যায়, ছোঁয়া যায়?

বোকা মেয়ে! নয়নতারা মনেমনে বলে।

এই যুগে আরো কমবয়সী মেয়েরা ভালোবাসার পাঠে পাস করেছে সেই কবে, আর আমার মেয়েটি জিগ্যেস করে, ভালোবাসা কি?

সত্যিকথা! অনেক মেয়ে তাড়াতাড়ি সব উপলব্ধি করে, বুঝতে পারে। অনেকে পারে না। আমার বিন্দু নাপারার দলে। নয়নতারা বলে,

–ভালোবাসা এমন জিনিষ ওটাকে দেখা যায়না, ছোঁয়া যায়না, শুধু উপলব্ধি করা যায়। বিয়ে হউক, স্বামীর ভালোবাসা কি বুঝতে পারবি।

দেখনা, তোর বাবার পছন্দমতো চলি। যখন যা বলে তাই করি,তবু তোর বাবার রাগ।

বিন্দু চুপ থাকে।

অনেকদিন ধরে বিন্দুদের পাশের পাঁচতলার চিন্তাহরন ছেলেটি বিন্দু ডাকে। হাসে। কি যেন বলতে চায়।

ছেলেটি সুন্দর। স্বাস্থ্যভালো।

বিন্দু ভাবে, এটা কি সেই ভালোবাসা! একটি মেয়ে, একটি ছেলের সাথে কথা, দেখায় ভালোবাসা?

ছাদে কাপড় শুকাতে যায় বিন্দু। ঠিক দুপুর। কেউ নেই।মনেমনে গান গেয়ে রশিতে কাপড় দেয়।হুট করে হাওয়া বেগে সামনে এসে দাঁড়ায় চিন্তাহরন।

বিন্দু ভয়ে কাঁপে। চোখ দু’টো পায়ের নখের কাছে। কিছু বলার সাহস পায়না।

চিন্তাহরন বিন্দুর হাত ধরে বলে,

–বিন্দু, তুমি সত্যি সুন্দরী।

ছ্যাৎ করে উঠে বিন্দুর শরীর। এই প্রথম বাবা ছাড়া কোনো পুরুষ বিন্দুকে ছুলো।

বিন্দু কষ্টে চিন্তাহরনের চোখে নিজের চোখ রাখে। চিন্তাহরন হাসে। বিন্দু লজ্জায় হাত ছাড়িয়ে ছুটে আসে ঘরে।

বাথরুমে ঢুকে মাথায় জল দেয়। সারা শরীরেও জল দেয়, অনেকক্ষণ। গায়ের উষ্ণতা কমেনা। একসময় স্বাভাবিক হলে বাথরুম থেকে বেরোয় বিন্দু।

বিন্দুর চঞ্চলতা নেই। কথা বলেনা। কি যেন ভাবে সারাদিন! মা অবাক হয়ে বিন্দুকে প্রশ্ন করে,

–বিন্দু শরীর খারাপ! হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলি,কারণ কি?

– কিছু না মা।এমনি।

নয়নতারা কথা বাড়ায়না। নিজের কাজে চলে যায়।

বিন্দু নিজে নিজে ভাবতে শুরু করে, এটাই ভালোবাসা। সত্যিসত্যি চিন্তাহরন আমাকে ভালোবাসে? মাকে বাবা যেভাবে ভালোবাসে, কিম্বা বাবা মাকে যেরকম ভালোবাসে! এটা কি সেই ধরণের কিছু! ভালোবাসা? কি জানি!

দিনদিন হিরালালের কাঁসিটা বেড়ে যায়। গলা দিয়ে রক্ত বেরোয়। কফের সাথে। নয়নতারা, বিন্দু কাঁদতে শুরু করে। কি হবে, কি করবে। ডাক্তার বলেছেন, ভালো নাহলে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। মহাখালি টিবি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

রাতে দু’জনের কান্না শুনে চিন্তাহরনের মা আসে।

বিছানায় শুয়ে আছে হিরালাল। মা মেয়ে বিছানায় বসে কাঁদে।

চিন্তাহরনের মা ইন্দুবালা বলে,

–ভালো চিকিৎসার জন্য হিরালালকে ঢাকাতে নিয়ে যাও নয়ন। ভালো হয়ে যাবে।

–দিদি, আমারতো অতো টাকা নেই। সব টাকা ওর চিকিৎসার জন্য খরচ হয়েছে।

– তাতে কি, টাকা আমি দেবো।

–ওমা সেকি! তুমি কেন দেবে দিদি!

ইন্দুবালাদের যথেষ্ট টাকা আছে। ওর স্বামী ব্যবসা করে। দুই ছেলে চাকরি করে। চিন্তাহরন বড়ো। মিতা হরন ছোট।

–নয়ন, তুমি কিছু ভেবোনা। যত টাকা লাগে দেবো। আগে হিরালাল সুস্থ হউক, তবে টাকাটা আস্তেআস্তে শোধ করবে।

বিন্দু ভাবে, এতো আগ্রহ কেনো মাসীমার। এই দুর্মূল্যের বাজারে কেউতো টাকা ধার দেয়না।তার উপরে যত টাকা চাই, দেবে।ব্যাপার কি!

নয়নতারা বলে,

–দিদি, টাকা নাহয় দিলে। কিন্তু অসুস্থ স্বামীকে আমি কি একা ঢাকায় নিয়ে যেতে পারবো?

–বিন্দু সাথে যাবে।

–দুইজন মেয়ের পক্ষে কি সম্ভব দিদি?

–ঠিক আছে, তোমাদের সাথে চিন্তাহরন যাবে।

– তাহলেতো ভালো হয় দিদি। নয়নতারা বলে।

–কাল নাহয়, পরশুদিন যাবার ব্যবস্থা করো নয়ন। ইন্দুবালা বলে।

–ঠিক আছে দিদি, তাই হবে।

বিন্দুর কি আনন্দ! ওদের সাথে চিন্তাহরনও যাচ্ছে। অনেক কথা বলবে দু ’জন।একান্তে, নির্জনে।

বুঝতে পারবে ভালোবাসা কি?

পরদিন সকালে সুবর্ণায় উঠে।

ঠিক সাতটায় ছাড়ে সুবর্ণ।

হিরালালকে নিয়ে নয়নতারা একটি সিটে বসে। অন্য সিটে বিন্দু, চিন্তাহরনকে বসতে বলে নয়নতারা। ওরা বসে। জানালার পাশে বসে বিন্দু। এই প্রথম ট্রেনে চড়া। ওদের সবার।

সুবর্ণ ছাড়ে।

দুইজন পাশাপাশি। স্নিগ্ধ হাসি দু’জনের ঠোঁটে।

ছুটছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। জানালা খোলা। উল্টো দিক থেকে এলোমেলো বাতাস আসে। বাতাসে বিন্দুর খোলা চুল চিন্তাহরনের চোখে উড়ে। ভালো লাগে চিন্তাহরনের। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই।

সুবর্ণ ছুটছে।

বিন্দু ভাবে চিন্তাহরন কথা শুরু করবে।

আর চিন্তাহরন?

ভাবে, বিন্দুই বলবে।

তখনও পর্যন্ত কেউ কথা বলেনি।

সুবর্ণ ছুটছে!

(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত