রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
logo
আগামী ৫ এপ্রিল ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী

ঢোলের জাদুকর বিনয়বাঁশী জলদাস

ঢোলের জাদুকর বিনয়বাঁশী জলদাস

বোয়ালখালী, ০৪ এপ্রিল, এবিনিউজ : বাংলার লোকসংস্কৃতির এক উল্লেখনীয় নাম বিনয়বাঁশী জলদাস। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শাসিত সাংস্কৃতিক জগতে তিনিই প্রথম অজগ্রামের তৃণমূল শ্রেণী থেকে ওঠে আসা মৃত্তিকা সংলগ্ন এক পুরুষ। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর কোল থেকে ছিটকে পড়া একটি জলধারাকে ধারণ করেছে যে খালটি, তার নাম বোয়ালখালীর ছন্দারিয়া খাল। ঐ খাল পাড়ের জেলে পল্লীতে জালিক কৈবর্ত স¤প্রদায়ে ১৯১১ সালে পিতা উপেন্দ্র নাথ জলদাস ও মাতা সরবালা জলদাসের ঘরে বিনয়বাঁশী জলদাসের জন্ম।

প্রান্তিক পরিবারে জন্ম নেয়া বিনয়বাঁশী জলদাসের রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষাই ছিল সম্বল। একদিকে বাল্যশিক্ষা পাঠ্য, অন্যদিকে ঢোল বাজনার তালিম। দুটোকেই পরম ভক্তিতে গ্রহণ করলেন বিনয়বাঁশী। মাটি ও মানুষের সত্যিকারের শিল্পী বলে যাঁদের চিনে নেওয়া যায় বিনয়বাঁশী তাঁদেরই একজন। অশিক্ষা , গোত্রীয় নিগড়, হীনম্মন্যতা ইত্যাদি সামাজিক পশ্চাদপদত্য দারিদ্র্যপীড়িত ও শোষিত জেলে স¤প্রদায়ের নিত্যসঙ্গী, এসব প্রতিকুলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে বিনয়বাঁশী উঠে এসেছিলেন মহৎজনের সারিতে। প্রায় ৮০ বছরের জীবনের সিংহভাগই কেটেছে তাঁর ঢোলের প্রেমে।

প্রখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে পরিচয় বিনয়বাঁশীর জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত। এই লোক কবির সাহচর্যে এসেই তিনি নাগরিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সুপরিচিত হয়ে উঠেন। ১৯৪৫ সালে রমেশ শীলের সঙ্গে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘‘নিখিল বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে’ যোগ দেন। বাংলা শ্রেষ্ঠ কবিয়াল বাদক হিসেবে সঙ্গে নেন বিনয় বাঁশীকে।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রমেশ শীলের সহশিল্পী হিসেবে ৩৫ বছর ধরে একাধারে ঢোল বাজিয়েছেন বিনয়, বাংলার ঢোল নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন ভারত উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে। সানাই, বেহালা, দো তারা, করতাল, মৃদঙ্গ বাজানোতেও পারদর্শিতা ছিল তাঁর। রমেশ শীল উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবিয়াল আর বিনয়বাঁশী বাংলার বিখ্যাত ঢোলবাদক।

২০০২ সালে সরকার দুজনকেই একুশে পদতে ভূষিত করেন। ২০০২ সালের ৫ এপ্রিল নিজ বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ গুণী শিল্পী বিনয় বাঁশী জলদাস। ঢোলের জাদুকর বিনয় বাঁশী জলদাস ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর ছন্দারিয়ার জেলেপল্লীতে।

বিনয় সমাধিস্থলে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি এখনো। বিনয় বাঁশীর জন্মভিটে ইতিমধ্যে ছন্দারিয়া খালে বিলীন হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যরা নানা জনের কাছে ধরনা দিলেও কোনো কাজ হয়নি।

বিনয়বাঁশী জলদাসের স্মৃতিকে অম্লাণ রাখার মানসে বিনয়পুত্র বাবুল জলদাসের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় বর্তমানে বিনয়বাঁশী শিল্পীগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক সংগঠন যেটি এখন দেশ-বিদেশের অনুষ্ঠানে ঢোল বাজায়। এছাড়া বিনয়বাঁশী’র অপর পুত্র হরিলাল জলদাসের রয়েছে স্বনামধন্য কীর্তনীয়া দল। বাবুল জলদাস বলেন, পরিবারের উদ্যোগে ও শুভাকাঙ্খীদের সহযোগিতায় প্রতি বছর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি।

জানা গেছে ১৯৯৯ সালে লন্ডনে বাংলাদেশ উৎসবে ঢোল বাদনের জন্য সরকার আমন্ত্রণ করেছিল বিনয় বাঁশীকে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি যেতে পারেননি। তবে তাঁর যোগ্য ছেলে বাবুল জলদাস বাবার হয়ে লন্ডন মাতিয়ে এসেছিলেন। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর দলের ঢোলবাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। যোগ্য পিতার যোগ্য পুত্র বাবুল জলদাস এরিমধ্যে আমেরিকা, জার্মানী, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ভারতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঢোল বাজিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন।

বিনয়পুত্র সুখলাল জলদাস বলেন, আমাদের বাড়িটা ছন্দারিয়া খালের ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন স্থানীয় এমপিসহ অনেকেই এবং কিছু উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর আর কেউ খোঁজ নেন না। নানা ভাবে উদ্যোগ নিলেও নানা জটিলতায় করা সম্ভব হয়নি কাঙ্খিত কমপ্লেক্স।

বিনয় বাঁশী সারা জীবন ভালোবেসে গেছেন দেশকে, দেশের মানুষকে। ঢোলের প্রতি ভালোবাসা ছিল আমৃত্যু। জীবনে অনেক জ্ঞানী-গুণীর ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। কিন্তু বিত্তের দিকে ফিরে তাকাননি ভুলেও। বাজনায় মুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নটরাজ উদয় শংকর তাঁর নৃত্যদল ‘মম বাণী’তে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন বিনয়বাঁশীকে। নিজের জন্মস্থান ছন্দারিয়া গ্রাম ছেড়ে এ শিল্পী কোথাও যেতে চাননি।

২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের দুই মন্ত্রী রমেশ শীল ও বিনয়বাঁশীর সমাধিস্থলে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

আগামী ৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ২১ শে পদক প্রাপ্ত প্রখ্যাত ঢোলবাদক বিনয়বাঁশী জলদাসের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। এদিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এ গুণী শিল্পীকে।

তথ্যসূত্র- লোকবাদক বিনয়বাঁশী - হরিশংকর জলদাস ও শিল্পীর পরিবারসূত্র।

এবিএন/রাজু দে/জসিম/নির্ঝর

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত