বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo
  • হোম
  • মুক্ত মতামত
  • উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অগ্রযাত্রাকে টেকসই করতে হলে বাংলাদেশের অর্জন করতেই হবে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অগ্রযাত্রাকে টেকসই করতে হলে বাংলাদেশের অর্জন করতেই হবে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অগ্রযাত্রাকে টেকসই করতে হলে বাংলাদেশের অর্জন করতেই হবে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’

ড. মইনুল ইসলামের কলাম, ০৫ এপ্রিল, এবিনিউজ : গত ১৬ মার্চ ২০১৮ তারিখে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের United Nations Economics and Social Council UNESCU) কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশ

যেহেতু স্বল্পোন্নত দেশের

(Least Developed Countries LDCs)

ক্যাটেগরি থেকে উন্নয়নশীল দেশের (Developing Countries) ক্যাটেগরিতে উত্তরণের জন্যে পূর্বশর্ত হিসেবে নির্ধারিত তিন ধরনের বিবিধ শর্ত পূরণ করেছে তাই ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশের এই উত্তরণ পর্ব শুরু হয়ে গেলো। এই তিন ধরনের শর্ত মাথাপিছু আয় সংক্রান্ত, মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি সংক্রান্ত। বাংলাদেশ সবগুলো শর্তই পূরণ করে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। এই উত্তরণ পর্ব আগামী ছয় বছর ধরে ঐ কমিটি মনিটর করার পর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের

সাধারণ পরিষদ

(General Assembly)

বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। তারও তিন বছর পর ২০২৭ সাল থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের জন্যে প্রযোজ্য যাবতীয় শর্ত মেনে চলবে, এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সব নিয়ম–কানুনের আওতায় আসবে। জাতিসংঘ এই স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের ক্যাটেগরীর প্রচলন করেছিল ১৯৭১ সালে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বহু সাধ্য–সাধনা করে বাংলাদেশকে এই ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্যে প্রযোজ্য অনেক ধরনের সুযোগ–সুবিধা লাভের প্রত্যাশায়, যদিও সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার কোন দেশকে সাধারণত এই ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম ছিল না। বলা বাহুল্য, ঐ সময়ের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সুবিধেগুলো পাওয়া বাংলাদেশের জন্যে অপরিহার্য বিবেচিত হয়েছিল। এটাও অবশ্য বলা প্রয়োজন যে বিশ্বের ‘মিসকিনদের ক্লাব’ কিংবা ‘ভিক্ষুকদের ক্লাব’ হিসেবে পরিচিত এই ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতে অনেক দেশ কখনোই রাজি হয়নি তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় থাকা সত্ত্বেওণ্ড–ঘানা, ভিয়েতনাম এবং জিম্বাবুয়ের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এই ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্তির পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত আশা ছিল, স্বাধীনতা–পরবর্তী চরম সংকটজনক অর্থনৈতিক অবস্থা কাটিয়ে ওঠার পর এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ এই অবমাননাকর স্বল্পোন্নত দেশের পরিচয় ঝেড়ে ফেলে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটেগরিতে উত্তরণে সক্ষম হবে। কিন্তু, এই উত্তরণপর্বে পৌঁছাতে বাংলাদেশের ৪৩ বছর লেগে গেছে।

এ–পর্যায়ে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বেশ কয়েকবছর ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে জিএনআই এর প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। ২০১৬–১৭ অর্থ–বছরে এই প্রবৃদ্ধির হার ৭.২৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে বলে সরকার দাবি করছে, এবং ২০১৭–১৮ অর্থ–বছরে তা ৭.৫ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে গত ১ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৭ সালের জুনে ১৬১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে বলে সরকার দাবি করলেও জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফ এর হিসাবে তা এখনো অনেক কম দেখানো হচ্ছে। জিএনআই প্রবৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু জিএনআই বেশি দেখানোর প্রবণতা বাংলাদেশের সব সরকারের আমলেই ছিল, এটাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কারণ, এর রাজনৈতিক ফায়দা ক্ষমতাসীন সরকারের ভাগেই যাবে। সরকারের দাবি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অবস্থানের ফারাক্‌ থাকলেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের অর্থনীতি উচ্চ জিএনআই প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্তরে প্রবেশ করেছে, যেটাকে টেকসই করাটাই এখন জাতির প্রধান চ্যালেঞ্জ।

কিন্তু, আমার আজকের কলামে আমি ফোকাস করতে চাই দেশে আয় বৈষম্য নিরসনের বিষয়টায়।গত ১৭ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অন্তভুক্ত সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস তাদের পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে ২০১৬ (HIES 2016) বা খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ এর মূল তথ্য–উপাত্তগুলো একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিল, যেগুলো ১৮ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের পত্র–পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিচালিত এবারের জরিপে ৪৬ হাজার হাউজহোল্ড বা খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে বলা হচ্ছে, যেখানে ২০১০ সালের জরিপে ১২ হাজার খানাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জরিপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ নিম্নরূপ:

১)বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০১৬ সালে ২৪.৩ শতাংশ ছিল, যে হার ২০১০ সালে ছিল ৩১.৫ শতাংশ। অতএব, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল এই ছয় বছরে দারিদ্র্য কমেছে ৭.২ শতাংশ। মানে, ঐ ছয় বছরে প্রতি বছর গড়ে ১.২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। এর আগের পাঁচ বছর মানে ২০০৫–২০১০ মেয়াদে দারিদ্র্য হ্রাসের হার ছিল প্রতি বছর ১.৭ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এদেশের দারিদ্র্য হ্রাসের হার ক্রমেই শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা দুঃসংবাদ। কিন্তু এর প্রধান কারণটাও জরিপের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে ধরা পড়েছে, সেটা হলো বাংলাদেশে আয়ের বৈষম্য বেড়ে মারাত্মক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।

২) অর্থনীতি শাস্ত্রে আয়ের বৈষম্য পরিমাপের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পরিমাপক হলো জিনি (বা গিনি) সহগ, যেটার মান এবারের জরিপে ২০১০ সালের ০.৪৬৫ এর চাইতে বেড়ে ২০১৬ সালে ০.৪৮৩ এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জিনি সহগের মান বাড়লে সেটা একটা মহাবিপদ সংকেত হিসেবে বিবেচিত হয় যে দেশে আয়ের বৈষম্য বেড়েই যাচ্ছে, এবং বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে একটি উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। যেসব দেশের জিনি সহগ ০.৫ পেরিয়ে যায়, সেসব দেশকে উন্নয়ন তত্ত্বে উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশ এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার নিজেদেরকে দরিদ্র–বান্ধব সরকার হিসেবে প্রোপাগান্ডা চালাতে সিদ্ধহস্ত, তাদের আমলে আয়–বৈষম্য বেড়ে গেছে এটা তাদের এহেন মিথ্যাচারের প্রতি চরম চপেটাঘাত বই কী!

৩) আরো একটা উপাত্ত একই সাক্ষ্য বহন করছে: ছয় বছর আগে দেশের ১০ শতাংশ উচ্চবিত্ত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দখলে দেশের মোট জিডিপি’র ৩৫.৮৪ শতাংশ ছিল, ২০১৬ সালে ঐ দশ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ৩৮.১৬ শতাংশ আয় জমা হয়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে দেশের ১০ শতাংশ দরিদ্রতম মানুষ ২০১৬ সালে মোট আয়ের মাত্র ১.১ শতাংশের মালিক হতে পারছে, যেখানে ২০১০ সালে তারা মোট আয়ের ২ শতাংশের মালিক ছিল। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠির হাতে যে জিডিপি পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছে এটা তার অকাট্য প্রমাণ। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরলে এটাই তো হবে, নয় কি?

৪) দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ২০১৬ সালে ১২.৯ শতাংশে নেমে গেছে, এই হার ২০১০ সালে ছিল ১৭.৩ শতাংশ। এটা সুসংবাদ। কিন্তু আয়বৈষম্য না বাড়লে এই হার আরো দ্রুত কমে যেতো।

৫) দেশের দরিদ্রতম ৫ শতাংশ মানুষের কাছে ২০১০ সালে ছিল ০.৭৮ শতাংশ আয়, কিন্তু ২০১৬ সালে তাদের কাছে মাত্র ০.২৩ শতাংশ আয় গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছে। তার মানে, দেশের হতদরিদ্ররা ঐ ছয় বছরে আরো দরিদ্র হয়ে গেছেন।

১৯৭৫ সাল থেকে এদেশের সরকারগুলো ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ ডামাডোলে শরীক হয়ে ব্যক্তি খাত ও বাজারীকরণকে আঁকড়ে ধরার ফলে এদেশে আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। ১৯৭২ সালে বিআইডিএস এর গবেষণায় নির্ণীত হয়েছিল যে বাংলাদেশের আয় বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ ০.৩২। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা থাকার কথা নয় যে হাউসহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে বা খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক এদেশের জিনি সহগ ২০০৫ সালে ০.৪৬৭ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, এবং ২০১০ সালের একই জরিপে ঐ সহগ ০.৪৬৫–এ রয়ে গেছে। তার মানে, ঐ পাঁচ বছরে আয় বৈষম্য আর না বাড়লেও কমানো যায়নি। আর, ২০১৬ সালে এসে জিনি সহগ ০.৪৮৩ এ পৌঁছে গেছে।১৯৭০ সালের পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি পরিবারের কথা বলা হতো, যারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের শিল্প–বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ঐ ২২ পরিবারের মধ্যে দুটো পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, তা–ও একটি ছিল অবাঙালি। ঐ বাংলাদেশেই ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব মোতাবেক ২৩,২১২ জন কোটিপতি ছিল। ২০১৪ সালে তারা ঐ সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার অতিক্রম করেছে বলে দাবি করেছে। ২০১৭ সালে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ একাউন্টে থাকা ব্যাংকের আমানতকারীদের সংখ্যা এক লাখ চৌদ্দ হাজার অতিক্রম করেছে বলে খোদ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। নিউইয়র্ক ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে,বাংলাদেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা প্রতি বছর নাকি এদেশ থেকে ৯০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিশ্বের নানা দেশে পাচার করে দিচ্ছে।এসব তথ্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল যে এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির কাছে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ার কিংবা তাদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বিপদ সংকেত পাওয়া যাচ্ছে সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারের কি কোন করণীয় নেই? সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় এই বিপদটার জানান্‌ দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে; ২) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপী বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৪) দেশের জায়গা–জমি, এপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচন্ডভাবে বেড়েছে; ৫) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মক ভাবে বাড়ছে; ৬) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা এক কোটি পঁচাত্তর লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ বা ৭০ লাখ মানুষ বস্তীবাসী; ৭) দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯) বিদেশে বাড়ীঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার খায়েশ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে;১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে: এবং ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে।

বিশ্ব ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্নয়ন দর্শন ঘোষিত হয়েছিল ‘দরিদ্র–বান্ধব প্রবৃদ্ধি কৌশল’ অবলম্বন করা হবে। ঐ পরিকল্পনা প্রণয়নে দিক্‌ নির্দেশনা প্রদানের জন্য গঠিত ‘প্যানেল অব ইকনমিস্টস’ এর অন্যতম সদস্য ছিলাম আমি। আমার অবস্থান ছিল, ঐ কৌশল একটা ফাঁকিবাজির নামান্তর, ওতে হবে না। আমাদের দেশের জন্য সরাসরি বৈষম্য নিরসনকে উন্নয়নের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, কারণ বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি ‘গণপ্রজাতন্ত্র’, এবং ২০১০ সালের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতির মধ্যে আবার সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব, ২০১০–২০১৫ মেয়াদের জন্য প্রণীত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৈষম্য নিরসনকে উন্নয়ন কৌশলের প্রধান ফোকাস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়েছিলাম আমি। ‘প্যানেল অব ইকনমিস্টস’ এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ সহ প্রায় সকল সদস্য আমাকে সমর্থন দিলেন। কিন্তু, অবাক হয়ে দেখলাম প্যানেলের আর কোন সভা না ডেকেই পরিকল্পনার খসড়া মন্ত্রিসভায় পেশ করে পাশ করে ফেলা হলো। ওখানে ‘দরিদ্র–বান্ধব প্রবৃদ্ধি’ কৌশল ঠিকই বহাল রয়ে গেলো। ২০১৬ সালের জরিপের ফলাফল জানার পর এখন তো স্বীকার করতেই হবে, বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধিকেই এদেশের উন্নয়নের মূল দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় এবং বাজেটে সুস্পষ্ট নীতি ও কর্ম–কৌশল ঘোষণা করতে হবে প্রতি বছর জিনি সহগকে কতখানি কমিয়ে আনা হবে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া এবং চিলি এখন এপথেই এগোচ্ছে।সরকারকে ঐসব দেশে আয় পুনর্বন্টনের মূল এজেন্টের ভূমিকা পালনে এখন বাধ্য করা হচ্ছে।

বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য খাতের বাজারীকরণ হলো আয় বৈষম্য বৃদ্ধির সবচেয়ে ক্ষতিকর ব্যবস্থা। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পর এই দুটো ব্যবস্থাকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে সরকারগুলো। তৃতীয় ডাইমেনশানটি হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং চতুর্থটি হলো সরকারি রাজস্ব ও ব্যয় ব্যবস্থা। দেশের বাজেটে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়কে এখনো জিডিপি’র আড়াই শতাংশেরও নিচে নামিয়ে রেখেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। স্বাস্থ্য খাতের সরকারি ব্যয়ও জিডিপি’র শতাংশ হিসেবেমোটেও বাড়ানো যাচ্ছে না বাজেটে। আর, এদেশের দারিদ্র্য সৃষ্টির সবচেয়ে বড় যে কারখানা সে কৃষিখাতেও সরকারি ব্যয় বরাদ্দ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ফরাসী অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি’র বেস্ট সেলার ক্যাপিটাল ইন দ্য টুয়েনটি ফার্স্ট সেনচুরিবইয়ে যে হাইপোথিসিসটি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য–উপাত্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তাহলো, রাষ্ট্র যদি অত্যন্ত কঠোরভাবে আয় ও সম্পদ পুনর্বন্টনকারীর ভূমিকা পালন না করে তাহলে উন্নত–অনুন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের সকল দেশে আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য বাড়তে বাড়তে অতি দ্রুত বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যাবেই। সাইমন কুজনেৎস যে এক পর্যায়ে উন্নত দেশগুলোতে বৈষম্য আর বাড়বে না বলে তত্ত্ব দিয়েছিলেন সেটাকে পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে পিকেটি’র বইয়ে। তিনি মনে করেন, অত্যন্ত প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থা, সম্পত্তি কর ব্যবস্থা এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজির উপর ‘গ্লোবাল ট্যাক্স’ বসানোর মাধ্যমে এই আসন্ন মহাবিপদকে ঠেকানোর প্রয়োজনকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। পিকেটি অবশ্য ইউরোপীয় কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোকে এ ব্যাপারে তাঁর আদর্শ মনে করেন। টমাস পিকেটি তাঁর বইয়ে কার্ল মার্ক্সকে কঠোর সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তদ্‌সত্ত্বেও বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি কৌশল অবলম্বনের জন্য তাঁর আকুতি ফুটে উঠেছে তাঁর বইয়ের উপসংহারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি কৌশল’কে কেন আমরা গ্রহণযোগ্য মনে করছি না? আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণকে টেকসই করতে হলে বাংলাদেশের প্রথম অগ্রাধিকার হতেই হবে ‘বৈষম্য নিরসন’। একটি উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ হওয়ার জন্যে একনদী রক্ত ঝরিয়ে জনগণ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেনি, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে জনগণ সাড়া দিয়েছিল। মুক্ত বাজার অর্থনীতির অহিফেনের মৌতাত ঝেড়ে ফেলুন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

লেখক : অর্থনীতিবিদ; ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত