বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১
logo

ভ্রান্তিবিলাসের রাজনীতিতে যার যা প্রাপ্য

ভ্রান্তিবিলাসের রাজনীতিতে যার যা প্রাপ্য

অজয় দাশগুপ্ত, ০৬ এপ্রিল, এবিনিউজ : দেশের রাজনীতির হালচাল বোঝা কঠিন। তবে এটা বুঝতে পারছি এখন আর বিএনপি সুবিধা করতে পারবে না। পারছে না এটা যেমন সত্য আর সহজে পারবে বলেও মনে হয়না। এর কারণ বোঝা কঠিন না। সাঁড়াশী আক্রমণের মুখে পড়ে দলটির বারোটা বেজেছে। এর জন্য তারা ওয়ান ইলেভেন বা আওয়ামী লীগকে দায়ী করলেও মূলত এর কারণ তাদের দলের আদর্শহীনতা। বিএনপি শুরু থেকে একধরণের সুবিধা ভোগ করে আসছিলো। সেই সুবিধা যে চিরকালীন না সেটাই তারা বোঝেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক মৃত্যুতে হতবিহ্বল বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক না। যে প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু বা তাঁর সহকর্মীদের হত্যা করে পাকিস্তান ফিরিয়ে আনা কিংবা ছায়া পাকিস্তান তৈরির চেষ্টা করেছিল তারা আজ বিগত। তাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা বা পথহারা সেনানায়কের দরকার ছিলো। সে দরকার আজ ফুরিয়েছে। আজকের বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা যত প্রকট হোকনা কেন তার সাথে তখনকার সময়ের মিল নাই। প্রতিশোধ নেয়ার রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধকে ছাড় দেয়নি বটে আজ সেও নির্মম ঐতিহাসিক প্রতিশোধে মৃতপ্রায়। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত যে ক্যারিশমা আর দলের যে রমরমা হাল তাও অস্তমিত।

তারা সবসময় বলেন সাইলেন্ট মেজরিটিতে তারা এগিয়ে। অস্বীকার করিনা। কিন্তু সে মেজরিটিতে একশতাংশ ও বুদ্ধিবৃত্তি নাই। কোন দেশ বা দেশের সরকার কেবল সাধারণ নামে পরিচিত মানুষের ইচ্ছায় চলেনা। চললে আগে বিএনপি যখন যেভাবে খুশি চলতো তাও তারা পারতো না। কারণ তখন আওয়ামী লীগের দিকে মানুষের সহানুভূতি বঙ্গবন্ধু ও ইতিহাসের ফিরে আসার জন্য মানুষের প্রাণ কাঁদলেও তারা গদী জুড়ে আরাম করেই বসেছিল। কারণ তখন সাধারণের বাইরে যে প্রশাসন, সামরিক অসামরিক আমলাতন্ত্র সবাই তাদের চাইতো। সে সময় আজ গত। ওয়ান ইলেভেন এমনি এমনি তৈরি হয়নি। খালেদা জিয়ার বড়পুত্র আর তার সাগরেদদের যে অত্যাচার সেটা মানুষ ভোলেনি। মানুষতো আম জনতা তারা প্রশাসন এমনকি সেনাবাহিনীকেও রাগিয়ে তুলেছিল। সে ক্রোধের নমুনা আমরা দেখেছি। মূলত তখন থেকেই তারেক জিয়া ও বিএনপির অধপতনের শুরু। বিএনপির বর্তমান নেতারা জানলেও মানেন না যে, মানুষ এখন আর সেইসব সময়ে ফিরতে চায়না। অথচ বর্তমান সরকারের মন্ত্রী আমলারা এমন কোন শুভকাজ বা ভালো কিছু করছেন না যাতে মানুষ তাদের মাথায় তুলে রাখবে। মূলত এরা সরকারের ভাবমূর্তি আর অর্জনকেই মাঝে মাঝে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। তারপরও মানুষ কেন বিএনপির জন্য মাঠে নামেনি?

এর উত্তর সে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা খুব ভালো জানেন। মানুষের জীবনে এক আশ্চর্য পরিবর্তন এনে দিয়েছে সময়। অতীতের যাবতীয় ভুল আর ভ্রান্তি বহন করার পরও বাংলাদেশ আজ বিশাল এক শক্তির প্রতীকে পরিণত হতে চলেছে। আমরা যারা বিদেশে থাকি সবাই দেখছি কিভাবে বদলে যাচ্ছে আমাদের জাতি ও দেশের ইমেজ। শুধু বড় বড় কথা আর প্রতিবেশীদের সাথে ঝগড়ার নামে তলে তলে দাসখত দিয়ে এগুনো যায় না। বেগম জিয়ার সেবয়স বা দলের ভেতর সে উন্মাদনাও নাই আর। দায়সারা আবেগ নির্ভর রাজনীতি থেকে মুক্ত সমাজের নেতা শেখ হাসিনা আজ তাঁর দলকে ফেলে এগিয়ে গেছেন। তাঁর উদ্যম , তাঁর দেশবোধ, তাঁর বর্তমান কনফিডেন্স একজন নেতার ভেতরও নাই। এটা তিনি একদিনে অর্জন করেননি। জীবন তাঁকে যে বেদনা ও দুঃখ উপহার দিয়েছে সে কষ্টগুলো তিনি মনে পুষে দুঃখী হবার পরিবর্তে কাজে লাগিয়ে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন। যত ই প্রগলভ বা বেশি কথার জন্য তাঁকে দায়ী করি না কেন তিনি না থাকলে বাংলাদেশের এই স্থিতাবস্থা ও অগ্রগতি সম্ভব হতোনা। ফলে প্রশাসন সরকার দেশ বিদেশের প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল মিলে এখন যে জয়রথ তাতে বিএনপির ঠাঁই নাই। তারা ঠাঁই করে নেয়ার রাজনীতি করছেনও না। ফলে খালেদা জিয়ার কারাগার মুক্তির জন্য ছোট ছেলের বৌয়ের পারিবারিক উদ্যেগ তাদের দিক থেকে বেঠিক কিছু না।

কোথাকার পানি কোথায় গড়াচ্ছে? খবরে দেখলাম বিএনপি মহাসচিব হাসি হাসি মুখে বলছেন তাঁরা আসন্ন সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে অংশ নেবেন। এটা গণতন্ত্রের জন্য সুসংবাদ বৈকি। কিন্তু খটকা থেকে যাচ্ছে। তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া এখন কারাগারে। এমন বাস্তবতা হজম করা বিএনপির কথা ছিলো না। এই দল বেশ কয়েক বার সরকারে থাকা এক শক্তিশালী দল। তৃণমূলে জনপ্রিয় নামে পরিচিত দলটির জন্ম সামরিক ছাউনীতে। একদা তাদের চ্যালেন্‌জ জানানোর মত কেউই ছিলোনা প্রায়। সে জায়গা থেকে তাদের আপোসহীন নামে পরিচিত নেত্রী বেগম জিয়া আজ কারাগারে। তাঁকে মুক্ত করার আন্দোলন দূরে থাক সহানুভূতি জন্মানোর মত কাজও দলটি করতে পারছে না। তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি যে এতটা দুর্বল সেটা আগে বোঝা যায়নি। যারা এখন নেতৃত্বে তাঁরা গদীআসীন ভদ্রলোক হলেও এদের মাঠে নামার অভ্যাস কম। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে কি হচ্ছে আসলে?

মীর্জা ফখরুল যে নির্বাচনে যাবার কথা বললেন সেই দৃশ্যে একটা বিষয় বেশ দেখার মত। একেবারে শেষদিকে এসে দায়সারা গোছের বা বলতে হবে বলে বললেন, এটা নাকি আন্দোলনের কৌশল। বিষয়টা কৌতুকের মত শুনিয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি বেগম জিয়ার সাথে দেখা করতে ব্যর্থ হলেও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো’র স্ত্রী এসে দেখা করে গিয়েছেন। তাছাড়া সরকার বা প্রশাসনের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে এটা বোঝা যায় খালেদা জিয়া এমন কোনভাবে মুক্ত হতে পারবেননা যাতে তাঁকে ঘিরে জনমত গড়ে ওঠে কিংবা তিনি তা নিয়ে রাজনীতি করে সহানুভূতি কুড়োতে পারবেন। ফলে আরো অনেক বিষয় এখন বাজারে আছে। যার কিছু সত্য মনে হ ওয়াটাই স্বাভাবিক। আসলে কি হচ্ছে পর্দার অন্তরালে? জোর গুজব বিএনপির কিছু নেতা বেরিয়ে নতুন দল বা একই নামে নির্বাচনে যাবেন। কথাটা ফখরুল সাহেব প্রকারান্তরে সমর্থন করেছেন। খবরে দেখলাম তিনি বলেছেন, কিছু নেতা বেরিয়ে গেলেও কর্মীরা যাবেনা। এই আগাম কথায় কিসের ইঙ্গিত? কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী ঠাকুরগাঁ ও তে যেসব কথা বলেছেন তাতে আক্রান্ত ফখরুল রাগ করেননি। বরং বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে মিষ্টি পাঠিয়ে দেবেন। কারণ এতে নাকি তাঁর ভোট বেড়েছে। যার মানে তলে তলে নির্বাচনে যাবার খায়েশ আছে তাঁর। মওদুদ কিংবা বাকি নেতারা নিয়ম মোতাবেক মাইকের সামনে পর্দার সামনে এসে দাঁড়ান। তারপর বাড়ি ফিরে যান। কারো চোখে মুখে উদ্বেগ বা ভয় নাই। নাই নেত্রীর জন্য দুশ্চিন্তার ছায়া। কাজেই ধরে নেয়া যেতে পারে খেলা চলছে। একদা খালেদা জিয়ার সচিব মোহন মিয়া যেটা বলেছেন যে সরকার যা চাইছে মীর্জা ফখরুল সে প্ল্যান মোতাবেক বল ঠেলে দিয়েছেন ডি বক্সে, তাই কি তবে সত্যি?

পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে আমরা কি দেখছি এখন? খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতেও দল কিছু করতে পারছে না। রাজনীতি পারছেনা কদম ওঠাতে। লাগছে পরিবারের লোকজনকে। এটা ভারতেও হয়েছিল। সন্‌জয় গাঁধির কথামত চলতে গিয়ে বিপাকে পড়া ইন্দিরাজী শুধু গদী না দলও হারিয়েছিলেন প্রায়। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কংগ্রেসের দীর্ঘ সময়ের প্রতীক গরুবাছুর বাদ দিয়ে হাত মার্কা নিয়ে লড়তে হয়েছিল তাঁকে। সে সময় থেকে মানেকা গান্ধী আর বরুণ ছিটকে পড়তে পড়তে পরে এক সময় তারা দল ঘরবাড়ি পরিবার ছেড়ে একা হয়ে গেলো। সীনে চলে এলো বড় ছেলে রাজীব গান্ধী ও তার পরিবার। আজ অবধি সে রাহুল আর তার মাই হাল ধরে আছে দলের। বিএনপি কি তবে তেমন কোন জায়গায় যাচ্ছে? তারেক জিয়া ও তার স্ত্রী কি ছিটকে পড়বে দৃশ্যপটে আসবে কনিষ্ঠ পুত্রবধূ? তবে কি এটাই সত্য ক্লান্ত পরিশ্রান্ত পুত্র হারানো খালেদা জিয়া আরো কিছু সরকার প্রধানের মত বিদেশ চলে যাচ্ছেন? এমন বাস্তবতা অস্বাভাবিক কিছু না। বিএনপি আন্দোলন জমাতে পারবে না। তাদের আদর্শ বা সংগঠন কোনটাই এখন আর কাজ করছে না। শুধু সাইলেন্ট মেজরিটির ওপর ভর করে খালেদা জিয়ার মুক্তি অসম্ভব। ফলে নেতারা যদি এসব বুঝে দলকে নতুনভাবে পরিচালনা করে নিজেরা টিকে থাকার রাজনীতি করেন অবাক হবার কিছুই থাকবে না। বিএনপি এদেশ ও ইতিহাসের ধারা মানেনি। মানেনি শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান। মানেনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মত করুণ বিষাদময় ঘটনা। তবে কি সেই পাপ আজ তাড়া করে ফিরছে তাদের? হায় খালেদা জিয়া জানি না কি আছে ভাগ্যে? তবে তাঁর বিদেশ গিয়ে জেল জরিমানা পাশ কাটানোর রাজনীতি সত্য হলে মানুষ জানবে রাজনীতিতে আসলে নীতি বলে আর কিছুই রইলো না। বাকিটা সময়ের হাতে।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

(সংগৃহীত)

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত