রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২
logo

স্মরণ : শামসুন্নাহার মাহমুদ

স্মরণ : শামসুন্নাহার মাহমুদ

রহিমা আক্তার মৌ, ০৭ এপ্রিল, এবিনিউজ : কালের পরিক্রমায় সাংবাদিকতার ক্ষেত্র ও ধরণ পরিবর্তিত হয়েছে। এখন প্রযুক্তির যুগ। বেতার, টেলিভিশন ও ইন্টারনেট সাংবাদিকতায় নারীরা যুক্ত হয়ে চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে দক্ষতা ও প্রতিভার পরিচয় দিচ্ছেন পুরুষদের পাশাপাশি। কিন্তু এই পর্যায়ে আসতে নারীদের কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে তা অতীত ইতিহাস না জানলে অজানা থেকে যাবে। বাঙালি মুসলমান নারীরা কখন কীভাবে সংবাদ–সাময়িকপত্রে জড়িত হন? সম্পাদক, প্রকাশক, পৃষ্ঠপোষক, সংবাদপত্রের কর্মী, লেখক, পাঠক হিসেবে ‘এদের অবদান বা ভূমিকাই বা কী– এ সম্পর্কে অদ্যাবধি কোনো বিস্তারিত গবেষণা হয়নি। পত্র–পত্রিকায় নারীরা কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বিষয়বস্তু হিসেবে, কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা প্রতিফলিত হয়েছে, তাদের অধিকার, শিক্ষা, ক্ষমতা, আর্থসামাজিক–রাজনৈতিক–ব্যক্তিক ভাবনাই কী– এসব নিয়ে ব্যাখ্যা–বিশ্লেষক হয়নি।

মুসলমান সমাজে নারী শিক্ষা প্রসার ও অবরোধপ্রথা রহিত করার জন্য যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের একজন। যিনি একাধারে দেশের নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবিকা ? তিনি হলেন বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রথম ছাত্রী হলটির নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়ার নামে, আর দ্বিতীয় ছাত্রী হলটি নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়ারই ছাত্রী বেগম শামসুন্নাহার এর নামে। এমন ভাগ্যবতী হয় কয়জনে।

১৩৪০ (১৯৩৩ খ্রিঃ) সালে কলকাতা থেকে শামসুন্নাহার মাহমুদ ও হাবিবুল্লাহ বাহারের সম্পাদনায় বুলবুল প্রকাশিত হয়। পরে এটি মাসিক হিসেবে বের হয়। শামসুন্নাহার মাহমুদ (১৯০৮–১৯৬৪)-এর জন্ম নোয়াখালীতে। তার শৈশব –কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামে। পরে তিনি কলকাতায় যান এবং বেগম রোকেয়ার সাথে নারীমুক্তি আন্দোলনে জড়িত হন। সাহিত্যচর্চা, অধ্যাপনা ও রাজনীতি ক্ষেত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেছেন আমৃত্য। ১৯৩০ দশকে তাদের সম্পাদিত বুলবুল উচ্চাঙ্গের সাহিত্যপত্রিকা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। বুলবুল–এর প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলেন সুফিয়া কামাল, আদেলা খানম, শামসুন্নাহার মাহমুদ প্রমুখ।

১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার ফেনীর গুথুমা গ্রামে মুন্সীবাড়ীতে এক সম্‌ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শিক্ষাবিদ, লেখক শামসুন্নাহার মাহমুদ। বাবা মৌলভী মুহাম্মদ নুরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন মুন্সেফ এবং মা আছিয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন গৃহিনী। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আব্দুল আজিজ, বি. এ. ছিলেন তাঁর মাতামহ, আর ফজলুল করিম ছিলেন পিতামহ। তিনি ছিলেন পিতৃহীনা, মাত্র ৬ মাস বয়সে বাবা মারা যান। শামসুন্নাহারের বাল্য ও কৈশোর কাটে নানার বাড়িতেই। তাঁর নানা বাড়ির অনেকে ছিলো সাহিত্যপ্রেমী। মা ও খালা বিভিন্ন মাসিক পত্রিকা গুলো পড়তেন এবং তা বাঁধাই করে রাখতেন। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মাসিক সাধনা, অন্নেষা সহ বিভিন্ন পত্রিকায় তাদের লেখা ছাপা হতো। ( তথ্য : বাংলাদেশের স্মরণীয় বরণীয়, রচনা ও সম্পাদনা জাফর আলম।)

শিক্ষাজীবনের শুরুতে শামসুন্নাহার চট্টগ্রামের খাস্তগীর গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু সামাজিক অনুশাসনের কারণে তাঁর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। নানা দাদা দুইজনেই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট, তা হওয়া সত্ত্বেও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রতিবেশীর নিন্দায় তার স্কুল ছাড়তে হয়। তাঁর জন্যে বাড়িতে একজন বৃদ্ধ শিক্ষক প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়। পর্দার এপারে শিক্ষক আর ওপারে ছাত্রী বসতেন। শামসুন্নাহারের নানা এ ব্যাপারে কৈফিয়তের সুরে শিক্ষককে বলতেন,

” কিছু মনে করবেন না, সমাজের মন রক্ষার জন্য এ ব্যবস্থা। সমাজের মন রক্ষা না করে চললে যে বিয়ে হবে না।”

পরে তিনি নিজ চেষ্টায় ১৯২৬ সালে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন।

ডাক্তার ওয়াহিদ উদ্দীন মাহমুদের সঙ্গে বিবাহ হয়, তবে বিয়েতে শর্ত থাকে মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে দিতে হবে। অত:পর বিয়ে হওয়ায় তিনি উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পান। ডায়েসিমন কলেজ থেকে ১৯২৮ সালে মেধাতালিকায়য় ২০তম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে আই এ পাশ করেন। প্রাইভেটে ডিস্টিংকশনসহ ১৯৩২ সালে বিএ পাস করেন। বি এ পাস করার পর বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়া হাইস্কুল থেকে তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। পরে তিনি বেগম রোকেয়ার নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের অংশীদার হন। পুরো ১০ বছর পর ১৯৪২ সালে তিনি এম এ পাস করেন। (বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, প্রথম পুনর্মুদ্রণ এপ্রিল ২০০৩, সম্পাদনা সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম, গ্রন্থে বলা হয় ১৯৪৪ সালে তিনি এ এম.বি.ই. ডিগ্রি লাভ করেন।)

হবীবুল্লাহ বাহার আর শামসুন্নাহার সহদর ভাইবোন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাদের দুই ভাইবোনের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। শামসুন্নাহার নিয়মিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতেন। কলকাতা থাকাকালীন শামসুন্নাহার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল কর্তৃক অনুপ্রানিত হয়ে লেখা শুরু করেন। তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়, ’ আঙুর ’ পত্রিকায়। আই.এ পড়ার সময় থেকেই তিনি ’নওরোজ’ ও ’আত্মশক্তি’ পত্রিকার নারী বিষয়ক অংশের সম্পাদকের কাজ করেন। তার লেখায় সমাজ ও সংস্কৃতি–প্রীতির প্রকাশ ঘটেছে।

১৯৩৩ সালে কলকাতা থেকে শামসুন্নাহার মাহমুদ ও হাবিবুল্লাহ বাহারের সম্পাদনায় বুলবুল প্রকাশিত হয়। পরে এটি মাসিক হিসেবে বের হয়। সাহিত্যচর্চা, অধ্যাপনা ও রাজনীতি ক্ষেত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন আমৃত্য। ১৯৩০ দশকে তাদের সম্পাদিত বুলবুল উচ্চাঙ্গের সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। বুলবুল–এর প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলেন সুফিয়া কামাল, আদেলা খানম, শামসুন্নাহার মাহমুদ সহ অনেকে। ’বুলবুল’ এর মধ্যদিয়ে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁদের পরিচয় ঘনিষ্ঠাতর হয়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত বুলবুল সাময়িকী পড়তেন ও লিখতেন। শামসুন্নাহারকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

”বুলবুল পত্রিকাখানি পড়ে আশান্বিত হলুম। সর্বনাশের মদমত্ততায় আত্মবিস্মৃত দেশের উন্মত্ত কোলাহলের মাঝখানে তোমরা শুভবুদ্ধির আহবান নির্ভয়ে ঘোষণা কর। ঈশ্বরের প্রসন্নতা তোমাদের শুভবুদ্ধি উদ্যোগকে গৌরাবান্বিত করবে। কৃতজ্ঞ দেশের আশীর্বাদে তোমাদের উদ্যম জয়যুক্ত হোক।”

১৯৩২ সালে বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর পর তিনি রোকেয়া জীবনী রচনা করেন। তৎকালীন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিকগণ এ পুস্তকের প্রশংসা করেন। কর্মজীবনে তিনি ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসে যোগ দেন। শামসুন্নাহার কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে ও ঢাকা ইডেন কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা হিসাবে যোগদান করেন। শামসুন নাহার কিছুদিন নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন। কলম্বোতে ইন্টারন্যাশন্যাল কাউন্সিল অব ওমেন–এ তিনি একটি দলের নেতৃত্ব দেন। সমগ্র এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ অর্গানাইজেশনে যোগ দেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৬১ সালে পঙ্‌গু শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ১৯৬২ তে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ঢাকায় নারীদের জন্য দু’একটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বেগম ক্লাবই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সমবেত হয়ে সমাজ উন্নয়নবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও স্বাধীনভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনার সুযোগ ছিল। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কাজটা সহজ ছিল না। সামাজিক বাধা, কঠোর সমালোচনার মধ্যে সাহসের সঙ্গে সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই তারা অগ্রসর হয়েছেন।

কবি সুফিয়া কামালকে সভানেত্রী ও বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে সাধারণ সম্পাদক করে বেগম ক্লাবের যাত্রা শুরু। পরবর্তী সময়ে এই ক্লাবের হাল ধরেন বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগম। ১৯৫৭ সালে বেগম ক্লাবের শিক্ষা সাব–কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ইডেন কলেজের বিভিন্ন সমস্যার চিত্র তুলে ধরে তা প্রতিকারের আহ্বান জানানো হয়।

শামসুন্নাহার মাহমুদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো: পুণ্যময়ী , ফুলবাগিচা , বেগম মহল, রোকেয়া জীবনী , শিশুর শিক্ষা, আমার দেখা তুরষ্ক ইত্যাদি। বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ’নজরুলকে যেমন দেখেছি’ বইটি। এই বইটিতে নজরুল সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। ১৯৬৪ সালের ১০ এপ্রিল তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে সমাজসেবার জন্য মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার বেগম শামসুন নাহার মাহমুদকে মরণোত্তর, ’বেগম রোকেয়া পদক’ প্রদান করা হয়। কাজী নজরুল ইসলাম তার সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ ”বাহার ও নাহার”–কে (হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শামসুন্নাহার) উৎসর্গ করেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক পরিবেশের বেড়াজালের মধ্য থেকেও এদেশের যে কয়জন মহিলা সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শামসুন্নাহার মাহমুদ তাদের মধ্যে অন্যতম। (সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

ad

প্রধান শিরোনাম

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত