![নিয়ত করে ঋণ খেলাপি](https://archive.abnews24.com/assets/images/news_images/2018/04/08/loan_134312.jpg)
প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য, ০৮ এপ্রিল, এবিনিউজ : অর্থনীতি বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামষ্টিক অর্থনীতির পাঠ্যক্রমে ‘বিনিয়োগ’ একটি অধ্যায় পড়তে হয়। ছাত্র–ছাত্রীদের বিনিয়োগ বিষয়ে ধারণা দেবার পূর্বে মূলধন ও সঞ্চয় সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিয়েই তবে বিনিয়োগ অধ্যায়টি শুরু করতে হয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে লর্ড জন মেনার্ড কেইন্স (জে.এম. কেইন্স) সঞ্চয়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেনণ্ড ‘সঞ্চয় হয় বর্তমান আয়ের সেই অংশ যা বর্তমান ভোগে ব্যবহৃত না হয়ে ভবিষ্যতে ভোগের জন্য জমা রাখে।’ কাজেই নির্বিঘ্নে বলা যায়, সঞ্চয় হয় আয়ের অব্যবহৃত একটি অংশ।
এ মাত্র বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। তবুও এদেশের মানুষের আয়ের পরিমাণ স্বল্প। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলেও জাতীয় আয়ের অসম বন্টনের কারণে একশ্রেণির লোক কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছে, আর একশ্রেণির লোক দরিদ্র লোকে পরিণত হচ্ছে। এরূপ অসম বন্টনের উদাহরণ দেবার জন্য বেশি দূরে যেতে হবে না। একবার ঢাকা শহরের বস্তিবাসীদের কথা ভেবে দেখুন। ঢাকা শহরের একদিকে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ইমারত নির্মাণ করা হচ্ছে আর একদিকে ক্রমাগত বস্তি এলাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা শহরের রাজপথ দিয়ে যখন আপনি চলাচল করবেন তখন ভাবার উপায় নেই যে, এ শহরের মানুষ দরিদ্র। কারণ রাস্তার দুই পাশে সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা, গাড়ি নিয়ে সুন্দর সুন্দর মানুষগুলো সুন্দর ইমারত ভবনে প্রবেশ করছে। মাথার উপর দিয়ে আস্ত একটা জাহাজ উড়ে চলছে, রাত্রি বেলা লাল নীল বাতি জ্বলছে। আহা– কি সুন্দর শহর! সুপ্রশস্ত রাস্তা থেকে একটা সরু রাস্তা বেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান, দেখবেন– ছোট ছোট চালা ঘর, ময়লা আবর্জনায় ভরা ছাউনিটি। সে ঘর থেকে বের হচ্ছে অসংখ্য ছোট ছোট মানব সন্তান। যাদের গায়ে তেমন কোন কাপড় নেই। মনের আনন্দে খেলাধুলা করছে। আর একটু এগিয়ে যান, দেখবেন পুঁতিময় গন্ধে আপনার মত সুন্দর মানুষটি টিকতে পারছেন না। এই আমার বাংলাদেশ। এরূপ বস্তি একটা দুইটা নয়। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে আছে প্রায় তিন হাজার বস্তি। প্রতিটি বস্তির নামও আলাদা। আর যদি আপনি এরূপ বস্তি দেখার জন্য কষ্ট করতে না চান তবে দয়া করে চট্টগ্রাম থেকে একবার ট্রেনে করে ঢাকা যান। টংঙ্গী জংশনের আগে থেকেই শুরু হবে এক একটি বস্তি এলাকা। ট্রেন যদি ঢাকা ষ্টেশনে ঢোকার আগে একটু ধীর গতিতে এগিয়ে যায় তবে আপনি দেখুন আর না দেখুন এক প্রকার গন্ধ আপনার নাকে লাগবেই। এরপর আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন প্রকৃত বাংলাদেশের অবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশ তো এগিয়ে যাচ্ছে। তবুও এদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না কেন?
প্রিয় পাঠক, আপনারা যারা চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন তারাতো সৌভাগ্যের বরপুত্র। এ অঞ্চলে কার্তিকের মঙ্গা (কার্তিক মাসের দুর্ভিক্ষ) দেখা দেয় না, বার আউলিয়ার পূণ্যভূমি খ্যাত চট্টগ্রামে সমুদ্র বন্দরের সুবাদে এখানকার লোকদের আয় বেশি। তেমন কোন খরা বা মঙ্গা এ অঞ্চলে দেখা দেয় না। একবার উত্তরবঙ্গে ঘুরে আসুন। এমন অনেক অঞ্চল আছে যাদের দুপুরে কোন রকমে ভাত খেলে বিকালে খাবার খেতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। তবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হলো কিভাবে? ঐ যে বললাম– মাথাপিছু আয় বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু আয়ের অসম বন্টনের কারণে আজ বাংলাদেশের এ অবস্থা। তবুও এদেশে মধ্যবিত্ত বলে একটা শ্রেণি আছে যাদের সংখ্যা বেশি। এ মধ্যবিত্ত গোষ্ঠি না পারে সমাজের নিম্নস্তরে নামতে, না পারে সমাজের উচ্চস্তরে উঠতে। এ শ্রেণি লোকের সংখ্যা বেশি থাকার কারণে তাদের আয়ের উদ্বৃত্ত অংশকে তাঁরা সঞ্চয় করে। অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের বর্তমান আয়ের অব্যয়িত অংশ ব্যাংকে সঞ্চয় করে। ব্যাংক সর্বসাধারণের সঞ্চিত অর্থ মূলধনে রূপান্তর করে। আর বিনিয়োগ হয় মূলধনের সেই অংশ যেই অংশটি বর্তমানে উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানেই যত সব বিপত্তি।
ব্যাংক কোন অমুনাফাধর্মী প্রতিষ্ঠান নয়। যদিও ব্যাংক সেবা সপ্তাহ পালন করে তবুও বলা যায়, সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যকে প্রাধান্য দিয়ে সেবাসপ্তাহ পালন করে। সেবা সপ্তাহ পালন করা অবস্থায় যদি আপনি একটি ডিডি করতে চান তবে উক্ত ব্যাংক ডিডি করার জন্য যথাযথ কমিশন কেটে রেখেই ডিডি করবে, বিনা কমিশনে কখনো তা করবে না। তবে কেন সেবা সপ্তাহ বলা হয়। বলা হয় এ কারণে যে ইহা একটি ব্যাংকের বিজ্ঞাপন যার উদ্দেশ্য মক্কেলকে আকৃষ্ট করা। একই উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংক জনগণের নিকট থেকে অর্থ জমা রাখে এবং এর বিনিময়ে জনগণকে প্রদেয় অর্থের তুলনায় অধিক অর্থে (সুদে) উৎপাদক বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করে থাকে। এখানেই ব্যাংকের টাকা লুটপাট করার একটা বিরাট সুযোগ তৈরি হয়। একজন উৎপাদক বা উদ্যোক্তা যদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে যে তিনি একটি শিল্প কারখানা স্থাপন করবেন যা অর্থনীতিতে অবদান রাখবে, সরকারও চায় অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে শিল্প কারখানা গড়ে উঠুক। এতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ হবে, বেকার সমস্যা সমাধান হবে, সর্বোপরি উন্নয়নের গতি ক্রমাগত বাড়বে। এ সুযোগটা গ্রহণ করে কিছু উদ্যোক্তা (সব উদ্যোক্তা নয়)। তাঁরা প্রথমে কস্ট বেনিফিট (অর্থনীতির তত্ত্ব) এনালাইসিস করে। যদি কস্ট–বেনিফিট এনালাইসিসে ধনাত্বক ফলাফল পাওয়া যায় তবেই উক্ত উদ্যোক্তা শিল্প স্থাপনের জন্য এগিয়ে যায়। শিল্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প তৈরি করে ব্যাংক লোনের জন্য সুবিধামত একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে আবেদন করে। ব্যাংক ঋণ দানের জন্য ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ কর্তৃক প্রদত্ত শর্ত মেনে নিয়ে যদি উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার উপযুক্ত মনে করে তবেই ব্যাংক ঋণ অনুমোদন করে। এর মাঝখানে আরো কতগুলো পর্যায় আছে যা এখানে আলোচনা করা হল না। যেমনণ্ড সুদের হার নির্ধারণ করা, পরিদর্শন করা, উপযুক্ত জামানত গ্রহণ করা, ঋণ ফেরৎ দানের শর্ত আরোপ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন উক্ত উদ্যোক্তা যদি অসাধু ব্যবসায়ী হয় অথবা তিনি যদি মনে মনে নিয়ত করেন যে, প্রাপ্ত ঋণ একবার যদি পেয়ে যায় তবে তা কখনো ফেরৎ দিবেন না। বরং উক্ত টাকা গ্রহণ করার পর বিদেশে পাচার করে মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ বানাবেন অথবা কানাডার ‘বেগম পাড়ায়’ স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন তবে সেই প্রদত্ত ঋণ কখনো ব্যাংকের নিকট ফেরৎ আসে না, হয়ে যান ঋণ খেলাপী।
একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর শোধ করে না। ঋণ দুর্বৃত্তদের অপকর্মের খেসারত গুণতে হচ্ছে খেলাপী হতে চান না– এমন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের। দেশে বিনিয়োগ কম হয় বলে নানা মহল থেকে যখন হতাশা ব্যক্ত করা হয় তখন ঋণ খেলাপীদের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঋণ লাভে বেগ পেতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি থেকে দেখা যায়, গত এক দশকে খেলাপী ঋণের অংকটি চারগুণ হয়েছে। সাম্প্রতিককালে খেলাপী ঋণের অবস্থা হয়েছে উদ্বেগজনক। ২০০৭ সালের শেষে যেখানে ঋণখেলাপি ছিল ২২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা সেখানে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকায়। এ কথা সত্য যে, প্রাকৃতিক বা অন্য কোন দুর্ঘটনায় ব্যবসায়ে বা উৎপাদনে উদ্যোক্তারা লোকসানের সম্মুখীন হতে পারে। অর্থাৎ ব্যবসা ক্ষেত্রে ঝুঁকি আছে। সেক্ষেত্রে খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বন্ধক রাখা জমি বা অন্য সম্পদ বিক্রয় করে বা নিলাম দিয়ে ব্যাংকের টাকা আদায় করার সুযোগ থাকে। এটাই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত রুল। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ নিয়ম পালিত হয়। অথচ বাংলাদেশে এখন অনেক ঋণ গ্রহীতাই ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছে। তাঁরা নানা অজুহাতে বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করে বা বিক্রয় করে টাকা আদায়েও বাধা দিচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করছে যা দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ। ফলে বিপাকে পড়ছে সরকারি ও বেসরকারি অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক। প্রয়োজনবোধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনেক উদ্যোক্তা এসব সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়ত করে ঋণ গ্রহণ করছে যা কোনদিন ফেরৎ দেবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে দেখা যায়, ২০০৯ সালে ঋণ খেলাপি ছিল ২২,৪৮২ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে ঋণ খেলাপীর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০,৫৮৩ কোটি টাকা। আর ২০১৬ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয় ৬২,১৭২ কোটি টাকা এবং ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয় ৮০,৩০৭ কোটি টাকা।
প্রিয় পাঠক, ২০০৭ সালে যেখানে ঋণ খেলাপির পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা সেখানে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এসব ঋণের মধ্যে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা ঝুঁকির কারণে লোকসানের সম্মুখীন হলেও অনেক ঋণগ্রহীতা লাপাত্তা। তাদের কোন সঠিক ঠিকানাও পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে এসব ব্যবসায়ীদের গ্রহণকৃত ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এরাই ঋণখেলাপি হয়েছে নিয়ত করে।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ , গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ
(সংগৃহীত)